Total Pageviews

Thursday, January 20, 2011

নিরন্তর সংলাপগুচ্ছ ~ ঐন্দ্রিলা খানম্

অন্ধকারে শুনতে পাই বিন্দু বিন্দু জল পড়ার শব্দ। উপর থেকে জলবিন্দু নিচে জলের ওপর পড়লে যে শব্দ সৃষ্টি হয় সেরকম ভাবা যেতে পারে। সে-শব্দকে হঠাৎ কেটে দিয়ে যে-শব্দটা বেজে ওঠে তা কাঁচের কোনো বস্তু পড়ে গিয়ে ভেঙে যাবার শব্দ। একই সাথে ঘরের আলো জ্বলে ওঠে। ঘরের মাঝামাঝি জায়গায় ছোটো একটা টেবিল এবং তার উপর একটা স্টোভ। সম্ভবত ঢাকনা দিয়ে ঢাকা টেবিলের নিচেও একটা তাক আছে; যেখানে প্রয়োজনীয় শিশি, কৌটো, চামচ কাপ‌-ডিশ ইত্যাদি প্রয়োজনীয় জিনিস রাখা থাকে। ঘরের পিছনদিকে একজনের শোয়ার উপযোগী একটা তক্তপোশ, একটা বালিশ। এরই বাঁদিকে একটা বসার জায়গা। স্টোভের সামনে দাঁড়িয়ে এক যুবক। দৃষ্টি মেঝেয়। সেখানে কিছু ছড়ানো কাঁচের টুকরো আর বেশ কিছু বাদাম। তক্তপোশের কাছে প্রায় সমবয়সী এক যুবক (দ্বিতীয়), হাতে চাদর, সম্ভবত তক্তপোশে পাতার চেষ্টায় ছিল। তার দৃষ্টি অপর যুবকটির দিকে। দ্বিতীয় যুবক খাটের সামনে হাটু ভাঁজ করে বসে খাটের তলা থেকে ঝাঁটা বের করে, আর ঘটনাস্থলে এগিয়ে যায়। প্রথম যুবক নীচু হয়ে বসে বাদাম কুড়োচ্ছে।
২য়:  ওই বাদামগুলো দয়া করে আর কুড়োস না।  তার থেকে কাঁচের বড়ো টুকরোগুলো তুলে নে।  বাকিটা আমি ঝাড় দিয়ে দিচ্ছি। 
১ম:  আমার মনে হয়, কিছু বাদাম খাওয়া যেতেই পারে।  মেঝেটা তো অপরিষ্কার বলেই মনে হচ্ছে।  তাছাড়া ঝাড় দিয়ে মেঝেটাকে বাদাম-মুক্ত করাটা কিন্তু যথেষ্ট কষ্টকরই হবে। 
দ্বিতীয়, কথা না-বাড়িয়ে বড়ো কাঁচের টুকরোগুলো কুড়িয়ে নেয়।  সেগুলো তুলে টেবিলের ওপর এক জায়গায় জড়ো করে।  ঝাঁটা হাতে ঝাড় দেবার জন্য নিচু হয়। 
১ম:  একটা বড়ো কাগজ প্রয়োজন।
২য়:  বালিশের নিচে দ্যাখ।
প্রথম, বালিশের নিচ থেকে খাতা বের করে একটা পৃষ্ঠা ছিঁড়ে নেয়।  পৃষ্ঠাটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দ্যাখে। 
১ম:  এখানে একটা ফোন নম্বর লেখা আছে।  তোর প্রয়োজন কি?
২য়:  কোনো নাম লেখা নেই?
১ম:  না।  পাঁচখানা পাঁচ আছে এমন কোনো ফোন নম্বর তোর জানা আছে কী?
২য়:  ওঃ তাহলে ওটা মায়ার।
১ম:  এ-রকম অপুষ্ট স্মৃতিশক্তিই তোর উন্নতির অন্তরায়, বুঝলি।
২য়:  আমি নিশ্চিত এটা...
১ম:  ছায়ার ফোন নম্বর।  কারণ মায়ার কোনো ফোন নম্বরই ছিল না।  ছায়ার কাছে ফোন করেই ওকে খবর পাঠানো হত।
২য়:  যাক।  আপাতত এই নম্বরটা আমার কোনো কাজে আসছে না।  তুই কাগজটা নিতে পারিস। 
প্রথম, টেবিলের ওপর রাখা কাঁচগুলো কাগজটায় রাখে।  তার পর কাগজটা নিয়ে ঘরের কোণে রাখা ময়লা ফেলার ঝুড়ির দিকে এগিয়ে যায়।
১ম:  তোর বিছানার তলায় রাখা সাদা ফুলস্ক্যাপ খাতা।  তার মধ্যেকার শুধু একটা মাত্র পৃষ্ঠায় শুধু একটা মাত্র লেখা – এই ফোন নম্বরটা।  এটা কি অপ্রয়োজনীয়তার চিহ্ন?
২য়:  তোর কথাবার্তা আজকাল আমি বুঝতে পারি না।  তুই কী জানতে চাইছিস?
১ম:  এখনও কতগুলো বাদাম ছড়িয়ে রয়েছে আনাচে-কানাচে।  ওই ফোন নম্বরটা ঠিক কবে থেকে তোর কাছে অপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠল?  আচ্ছা মায়া সংক্রান্ত কিছু কি তোর মনে পড়ে?
২য়:  আমি কিছুই মনে করতে পারছি না।  কিচ্ছু না।
১ম:  আমি জানি তোর স্মৃতিশক্তি দুর্বল।  সময় এবং ব্যস্ততার সাথে তা আরও বেড়ে গ্যাছে।  তা ঠিক আছে, আমি তোকে মনে করতে সাহায্য করছি।
২য়:  তবুও আমি মনে করতে পারব না।
দ্বিতীয় দুহাতে মুখ ঢাকে।  নিশ্চুপ হয়ে যায়। 
১ম:  নিশ্চয়ই পারবি।  এর আগেও অনেক ক্ষেত্রে তোকে অনেক কিছুই মনে করতে হয়েছে।  কোনো ক্ষেত্রে পেরেছিস, কোনো ক্ষেত্রে পারিসনি।  দুটোর কোনোটাতেই তোর খুব বেশি লাভ-লোকসান কিছুই হয়নি।  বরঞ্চ মনে করার চেষ্টাটা, পরিশ্রমটা বেশ উপভোগ্য হয়ে উঠেছিল।  আমার তো তাই মনে হয়।  নয় কী?  আমি চা বানাচ্ছি।  গরম চা-এর সাথে খেলাটা জমবে ভালো। 
২য়:  খেলা! 
১ম:  হ্যাঁ তাই।  অন্তত আমার তো তাই মনে হয়।  অত্যন্ত স্পোর্টিং মনোভাব নিয়েই স্মৃতিচারণ করা উচিত।  আচ্ছা তোর মনে পড়ে, মায়াদের বাড়ির ঠিক সামনেই একটা অদ্ভুত গলি ছিল। 
২য়:  দিনের বেলা, গলির মোড়ে একজন বুড়ো লোক মুরগির মাংস বেচতো।  ওখান দিয়ে গেলেই সেই কাঁচা মাংসের রক্তমাখা পালকের গন্ধ পেতাম।  রাতের বেলা শিউলি ফুল ফুটত নর্দমার ধারে।  গন্ধ পেয়েছি, যত বার গিয়েছি। 
১ম:  শুনেছি, বুড়ো মারা গ্যাছে।
২য়:  কিন্তু শেষ বার যখন গিয়েছি, তখনও তো ছিল মনে হয়। 
১ম:  তার মানে বুড়ো মারা যাওয়ার আগেই তোর ওখানে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে আসছিল।
২য়:  অবান্তর।  ওর সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই।
১ম:  জানি।  আমি শুধু সময়টা মেনশন করতে চাইছি। 
২য়:  মায়া শিউলি ফুল পছন্দ করত।
১ম:  আমার তো মনে হয় ওর টগর ফুলই বেশি পছন্দ ছিল।
২য়:  হিমাংশু টগর ফুল বেশি পছন্দ করত।
১ম:  মায়া কি হিমাংশুকে পছন্দ করত?
২য়:  আমার তা মনে হয় না।  সেটা কেবল হিমাংশুর ভাবনা ছিল।
১ম:  হিমাংশু বলত, মায়ার বাঁ পায়ের গোড়ালিতে কোনো সিরিয়্যস প্রবলেম আছে।  মাঝে মাঝেই নাকি ওর হাঁটতে কষ্ট হত। 
২য়:  ওঃ আমাকে গুলিয়ে দিচ্ছিস।  ওটা শতাব্দীর সমস্যা ছিল।
১ম:  চা।  বাদামগুলো কুড়িয়ে রাখবো?  ১৯৯১, তোর সাথে আমার পরিচয়।  তুই মায়াকে চিনতিস।  আমিও।  আমি ছায়াকেও চিনতাম, তুইও।  বছর গড়ায়।  সুমন, হিমাংশু, নাজিমদা...
২য়:  সফর, শতাব্দী...
১ম:  বিশু, পর্ণা, অর্কদা...
২য়:  ঋতমও তো চিনত মায়াকে।
১ম:  অনেকে, আরও অনেকে, আসে বসে, বাদাম চা বিস্কুট সিগারেট... তারপর চলে যায়।  যারা যায় না, কিংবা গিয়েও ফিরে আসে, তোর সাথে তাদের ঘনিষ্ঠতা।  তুই তাদের গল্প শোনাস আমায়।  তার পর ভুলে যাস।  আর আমি মনে রাখি গল্পগুলো।
২য়:  তার পর তুই যখন সে গল্প আমায় মনে করাতে চাস, পাল্টে যায় গল্পগুলো।  এমনকী তুই মানুষগুলোকেও পাল্টে দিস। 
১ম:  খেলাটা জমে ওঠার মুখে!
২য়:  কিন্তু আমি জমে উঠতে দেবো না।  আমি আর পারছি না।  প্রতি কটা দিন গরম চা আর অসংখ্য সিগারেটের সাথে স্মৃতিচারণের ককটেল ইমপসিব্‌ল।  প্লিজ, তুই আর আসিস না কাল থেকে।  লেট মি লিভ অ্যালোন। 
১ম:  তার মানে তোর স্মৃতি-কল্প-গল্পগুলোয় আমার মতো একজন চরিত্রকে তুই পেতে চাস।  গুড।  আমি দেখছি, খেলাটাকে রীতিমতো এনজয় করতে শুরু করেছিস তুই।  একটা সেফ্‌‌টিপিন হবে?
২য়:  না, হবে না।  কারণ ওই সেফ্‌‌টিপিন থেকে তুই কারও অপারেশন-এর প্রসঙ্গে পৌঁছে যাবি।
১ম:  রাইট-রাইট।  ১৪ অগস্ট।  মনে আছে।  মায়ার বাঁ পায়ের গোড়ালিতে অপারেশন হয়েছিল। 
২য়:  মায়ার মা কাঁদছিল, প্রচণ্ড।  ওনার এক মেয়ে মারা গিয়েছিল, নার্সিংহোমে।
১ম:  অসাধারণ।  ক্যারি অন।  দ্যাখ বোতলটা যদি না ভাঙত, তাহলে কিন্তু এত কিছু মনেই পড়ত না, তাই না।
২য়:  হয়ত...
১ম:  আর আমি নিশ্চিত।  ডাস্টবিন থেকে কাগজটা বের করে কাঁচগুলো জুড়ে দিয়ে বোতলটা বানিয়ে ফেলে সমস্ত বাদাম ওর ভেতর আবার ঢুকিয়ে দিয়ে, কাগজটা আগের মতো খাতার ভেতর রেখে, খাতাটা বিছানার তলায় রেখে দিতে পারলে তুই সমস্ত কিছু আবার ভুলে যাবি।  আর খাতাটা ওখানেই থেকে যাবে।
২য়:  হয়ত...
১ম:  কিন্তু তা আর সম্ভব নয়।  তোর নিশ্চয় এখন মনে পড়ছে সমস্তটা।  কবে থেকে কে অপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠল, এবং কেন।  ক্যারি অন, বল, বলে যা।
২য়:  না, আমি কিছু মনে করতে পারছি না।  কিচ্ছু না।  বিশ্বাস কর, কিচ্ছু না। 
১ম:  মিথ্যা কথা বলিস না।  মনে পড়ছে না, না-কি মনে পড়ুক, সেটা চাইছিস না।  মায়ার সঙ্গে তোর এক বিশেষ সম্পর্ক গড়ে উঠছিল ক্রমশ। 
২য়:  প্লিজ, স্টপ্ দ্যাট।
১ম:  মায়া ইউজ করত ছায়াকে, আর তুই, আমাকে। 
২য়:  এটা সত্যি নয়।
১ম:  যেন আমরা দুটো ল্যাডার।  যে-সিঁড়ি বেয়ে তোরা উঠতে চেয়েছিলি উপরে, অতীন্দ্রিয় কোনো জগতে।  বোগাস।  'আমরা এই পৃথিবীর কেউ নই' – মায়ার হাতের কাছে মুখ রেখে কে বলত এসব কথা?  মেরি শেলি পড়িস এখনও?  ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন?  টাটকা ঘটনাগুলো দিয়ে পূর্ণ করেছিস নিজের স্মৃতিগহ্বর।  আর তার রঞ্জিত, বিকৃত, কল্পিত সমস্ত স্ব-সৃষ্ট অ-ঘটিত ঘটনা দিয়ে পূর্ণ করেছিস আমার স্মৃতিসত্তা।  আমাকেও বাঁচতে হবে, আর কাটাতে হবে দীর্ঘ সময়।  এ খেলা তাই খেলে যেতেই হয়।  আচ্ছা তোর বিবর্ণ ডায়রির কথা মনে আছে?
২য়:  ডায়রি!
১ম:  হ্যাঁ।  এক সময় তুই ওতে তোর বর্তমান লিখতিস।  তার পর ধাবমান অতীত যখন তোর বর্তমানকে পিছনে ফেলে এগিয়ে এলো, ছাপিয়ে গ্যালো তাকে, তোর অতীত কথা লেখা হল ওখানে।  ওখানে সবাই আছে, যাদের তুই চাস অথবা চাস না।  কিংবা যাদের আমি চাই, ঠিক তাদেরই মতো করে।
দ্বিতীয়, কথা না বলে এগিয়ে যায় ঘরের বাঁ দিকে।  সেখানে একটা মই রাখা।  তার ওপর লফ্‌ট।  অনেক বইপত্তর ডাঁই করা।  সবই পুরোনো।  বইপত্রের ওপর পড়ে আছে মাকড়সার জালগুলো, এমনকী বৃদ্ধ আরশোলারাও।  সে উপরে খোঁজ চালায়।  দু-একটা বই পড়তে থাকে ওপর থেকে।  কিছুক্ষণ পরে নেমে আসে সে।  হাতে বাঁধানো বিবর্ণ ডায়রি।  ডায়রির মলাটের রঙকে এখন আর বিবর্ণও বলা যায় না।  বললে তা বাতুলতা হয়।
২য়:  এই তো, পেয়েছি।
১ম:  ইয়েস, আমরা বোধ হয় বেঁচে গেলাম।
২য়:  এই ভয়ংকর দমবন্ধকর খেলার এখানেই শেষ। 
১ম:  ইতিহাস কথা বলে উঠবে এখনি।
২য়:  জানা যাবে কোন্‌টা সত্য, কোন্‌টা মিথ্যা। 
১ম:  কোন্‌টা ভুল, কোন্‌টা ঠিক।  ওটা খোল আর পড়তে শুরু কর।
দ্বিতীয়, ডায়রিটা খোলে।  অসংখ্য ছোটো বড়ো মাঝারি কুচিকুচি পোকায়কাটা ছেঁড়া হলদে হয়ে যাওয়া বিবর্ণ কাগজ ঝরে পড়ে।  হঠাৎই লোডশেডিং হয়ে যায়।  অন্ধকারে সারা ঘর জুড়ে ভেসে বেড়ায় কাগজের কুচি টুকরো।  এক দুই তিন চার... অসংখ্য... অগুনতি।  তারই সাথে স্পষ্ট হয়ে ওঠে সেই জল পড়ার টুপ্‌টুপ শব্দ।  স্টোভ জ্বলে ওঠে।  স্টোভের আগুন আলো ছড়ায়।  সে-আলোয় এক মুখ, সে-মুখ কথা বলে ওঠে –

“হৃদি ভেসে যায় অলকানন্দা জলে
অতল, তোমার সাক্ষাৎ পেয়ে চিনতে পারিনি ব'লে
হৃদি ভেসে গেল অলকানন্দা জলে
করো আনন্দ আয়োজন ক'রে পড়ো
লিপি চিত্রিত লিপি আঁকাবাঁকা পাহাড়ের সানুতলে
যে একা ঘুরছে, তাকে খুঁজে বার করো
করেছো, অতল; করেছিল; প'ড়ে হাত থেকে লিপিখানি
ভেসে যাচ্ছিলো – ভেসে তো যেতোই, মনে না করিয়ে দিলে;
– 'পড়ে রইলো যে!'  প'ড়েই থাকতো – সে-লেখা তুলবে ব'লে
...”

আবার সেই জল পড়ার শব্দ ভেসে আসে।  স্টোভের আলো নিভে যায়।  লফ্‌‌টে যাওয়ার সিঁড়ির প্রথম ধাপে নীলচে বৃত্তাকার আলো পড়ে।  সে-আলো কাউকে পরিস্ফুট করার অপেক্ষায় সারা ঘরময় ফিস্‌‌ফিস শব্দ ভেসে বেড়ায়।  কেউ কি বলে চলে?  বৃত্তাকার আলো খুঁজে চলে।  তক্তপোশ, তার ওপর ডায়রি, স্টোভ, নিচের তাকের বাসনকোসন।  শুধু অস্পষ্ট ফিস্‌‌ফিস শব্দ সারা ঘর জুড়ে।  অসংখ্য গভীর গোপন মেলামেশা তাদের, অস্ফুট সংলাপ।  জলের বিন্দু বিন্দু শব্দ অপেক্ষা আর অস্বস্তিকে দীর্ঘ করে তোলে।