Total Pageviews

Wednesday, January 19, 2011

বিশ্বায়নের আখ্যান, প্রতিরোধের অন্তর্বিরোধ এবং বিকল্প ভাবনা ~ জয়দীপ মজুমদার

যেকোনো ক্ষমতার জন্য আজ পুঁজির বিপণন মনস্তত্তই প্রধান আশ্রয়, মুনাফার সংখ্যা-ভাষাই তার কথোপকথনের ভেতরের কাঠামো । উতপাদন-সূচকের বিরাট সাইনবোর্ডের আড়ালে চাপা পড়ে যাচ্ছে মানুষের বেঁচে থাকার অনটনরুদ্ধ বা ছিন্নমূল বা প্রজন্মবাহিত জীবনরীতি, সম্পর্কের বিবিধ আখ্যান, অস্তিত্বের অনর্থ-সংকট । স্বেচ্ছাচার, অবদমনের প্রতিরোধী সমস্ত মতামত হয়ে উঠছে সন্ত্রাস, আড়ালে পড়ে থাকছে লালসা আর বিপন্নতার সভ্য যোগাযোগ । বিপণনচতুর বিশ্বপুঁজি আর ক্ষমতার পরিপূরক আগ্রাসনের সামনে সমস্ত জৈবনিক, সামাজিক আখ্যনের যে সংকট, তারই ইঙ্গিত দিতে চেষ্টা করলাম এই লেখায় ।

১) যারা খবরের ক্রেতা এবং যারা খবর হয়

টুইন টাওয়ার ধ‍‍‌‍বংস থেকে দান্তেওয়াড়া, মিডিয়ার ব্যস্ত কাউন্টারে একটার পর একটা বিনোদন খাদ্য, একই সঙ্গে জনমতকে সম্মতি বা সমালোচনার নিরাপদ পরিধির মধ্যে জায়গা করে দেওয়ার চ্যালেঞ্জ, একের পর এক, বিরামহীন – রাষ্ট্র, ধনকুবের বাণিজ্য-সামরিকজোট এবং সমস্ত প্রাতিষ্ঠানিক সন্ত্রাসের মুখোমুখি পালিয়ে চলা উদভ্রান্ত আতঙ্কিত মানুষের মিছিল, কাঁটাতার ঘেঁষে একের পর এক উদবাস্ত শিবির, রাষট্রনায়কদের বিবৃতির পর বিবৃতি, সন্ত্রাসকে নিকেশ করবার শপথ, দূর্ঘটনাস্থল থেকে একেকটা অসহায় মুখ, বীভতসতার বর্ণনা, উভয়পক্ষের ক্ষয়ক্ষতি-হতাহতের পরিসংখ্যান আর ক্রমশ মিডিয়ার বিনোদনযন্ত্র প্রতিআক্রমণ-প্রতিশোধের স্বয়ংক্রিয় যুক্তি তৈরি করে চলবে, আলোচনা, প্রশ্নোত্তর, মতামত বিনিময়ের মাধ্যমে, প্রত্যক্ষ্যদর্শীর ফুটেজ থেকে ফুটেজ়ে ক্রমশ যুক্তিটা আরও স্বতসিদ্ধ দেখানোর চেষ্টা হতে থাকবে । এইভাবেই প্যালেস্তাইন থেকে ইরাক, আফগানিস্তান থেকে উত্তর কোরিয়া, নন্দীগ্রাম থেকে সোপোর মিডিয়া ক্রমাগত জনমতে ক্ষমতার অবদমনমূলক ভাষ্যকে জায়গা করে দিচ্ছে । আর এই মহান প্রজেক্টে গ্রহীতা তো তারাই যাদের সঙ্গে সংবাদের সম্পর্কটা মূলত বিনোদনমূলক, নিশ্চিন্ত নিরুপদ্রব দূরত্বের । আর যারা গোয়ালতোড়, কালাহাণ্ডি কিংবা দান্তেওয়াড়া, বিজাপুর অথবা হাসিমারা, গরুমারায় থাকে? অথবা প্যালেস্তাইনের মানুষ যারা বেঁচে থাকে ইজরায়েলি মারণাস্ত্রের চোখে চোখ রেখে, শশব্যস্ত মৃত্যুকে ফাঁকি দিতে দিতে? ইজরায়েল আমেরিকার ব্যয়বহূল সামরিক আতাঁত, ধনী দেশের সামরিক জোট, মহড়া, রাস্ট্রসঙঘের নিরাপত্তা পরিষদে কেবলমাত্র বৃহত সামরিক, আর্থিক শক্তিধর উন্নত বিশ্বের একচ্ছত্র সিদ্ধানতের অধিকার, মিডিয়া এই সন্ত্রাসের কাঠামো, তার নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে না, কারণ মিডিয়াকে এই কাঠামোই বাঁচিয়ে রাখে। ক্ষমতা এবং ক্ষমতা প্রসারণের সমস্ত প্রয়াসকে মিডিয়াইতো করে তোলে স্বতসিদ্ধ, প্রাকৃতিক নিয়মের মতো স্বাভাবিক। ফলে বরাবর ক্ষমতার বৃত্তের বাইরে যেখানেই ক্ষমতার জন্য তৈরি হচ্ছে চ্যালেঞ্জ, ফোকাসটা মিডিয়ার ঠিক সেখানেই। টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পরে ফরাসী লেখক বদরিলার যখন বলছে, “আমরা এটা চেয়েছি, কিন্ত করেছে ওরা”(We who wished it, but they who did it)প্রচারমাধ্যম বদরিলারকে সন্ত্রাসের দার্শনিক বলতে শুরু করল। বদরিলার তো একচ্ছত্র ক্ষমতার প্রতি জনমতের সহজাত ঘৃণাই উগড়ে দিয়েছে, কিন্ত না, সন্ত্রাসের একমুখী ক্ষমতানির্দিষ্ট সংজ্ঞাকে মিডিয়া কিভাবে পারে প্রশ্ন করতে?

ভারতের ছ-সাতটি প্রদেশ জুড়ে গত কয়েক বছর ধরে যে আদিবাসী জনজাতি, পিছড়ে বর্গ, ভূমিহীন কৃষকের সশস্ত্র অভ্যূথথান দানা বেঁধেছে সেটার অবলম্বন যে মতবাদই হোক না কেন, যেটা অস্বীকার করা যাচ্ছে না সেটা হল, ক্ষমতার বৃত্তের একেবারে প্রান্তসীমায় বসবাসকারী মানুষ ক্রমশ জবরদখলী ক্ষমতার বিপরীতে নিজেদের জীবনজীবিকা রক্ষার তাগিদে সংগঠিত হচ্ছেন, তৈরি হচ্ছে রাস্ট্রীয় ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করে নতুন নতুন আঞ্চলিক ক্ষমতার কেন্দ্র। প্রচারমাধ্যমের ক্রমাগত মিথ্যাচারের বিপরিতে গিয়ে অরুন্ধুতীর লেখা (Walking With the Comrade , বা অন্য শিরোনামে Gurdian পত্রিকায় Gandhi, But With Guns) ঠিক এই জরুরী বিষয়টাকেই তুলে আনল। ‘হ্যাঁ, আমরা প্রতিরোধী মতামতকেও অন্তরগত করে নিই। কিন্ত শুধু তা মুলধারায় অষ্টপ্রহর বলে যাওয়া বিকৃত, অর্ধেক বা সুবিধাজনকভাবে দোমড়ান মোচড়ান তথ্য এবং দৃস্টিকোণ যা সকাল সন্ধ্যে লক্ষ্য লক্ষ্য শহর, আধাশহরের জনতাকে আমরা গেলাই তোমার মত তার বিপরিতে গিয়ে নেহাতই একটা ব্যতিক্রমী, চমকপ্রদ প্রডাকশন্ হল, মাওবাদী সন্ত্রাসের একঘেয়ে খবরের বাইরে একটা আলাদা রোমাঞ্চের ব্যবস্থা। আর আমাদের খবরের বিপণনে আ্ররো একটু বৈচিত্র্য এল । যখনই মিডিয়া কোনো প্রতিরোধী মত প্রকাশ করে, মিডিয়ার সমষ্টিগত মনস্তত্ত ঠিক এটাই । ছত্তিসগড়ের মাওবাদী মুক্তাঞ্চলে পুকুর খুঁড়ে মাছ চাষ, জলাশয়-পুকুর-নালায় বৃষ্টির জল জমিয়ে আঞ্চলিক সেচ ব্যবস্থার উদ্যোগ যা আরো ব্যাপক আকার নিলে শেষ পর্যন্ত ঊষর, খরাপ্রবণ বস্তার-দন্ডকারণ্যের আদিবাসীদের দিতে পারে বছরের অর্ধেক সময়ের কৃষিকাজের যোগান, অপুষ্টিজর্জর বস্তারের শিশুর জন্য নিয়মিত সব্জী - গেরিলা আর্মির সশস্ত্র দাপটের খবরের পাশাপাশি অনিয়মিত হলেও আসতে শুরু করেছে মাওবাদী মুক্তাঞ্চলে এই অন্যতর কর্মকাণ্ডের খবর কিন্ত মূলধারার মিডিয়ার কাছে এই ধরনের জনমুখী উন্নয়নের খবর এখনো ব্রাত্যই,ড়জোর কৌতুহলের বাজারব চাহিদা মেটাতে মিডিয়া এই মানুষ-মাটির প্রতি বিশ্বস্ত কর্মকাণ্ডকে আদিবাসীদের অসহায়তার সামনে মাওবাদীদের ভাবমূর্তি তৈরির প্রয়াস হিসেবে দেখাতে চাইছে । অথবা নকশালদের বিপথচালিত রবিনহুড দেখাবার সেই পুরনো গল্পটা একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আবার চালু করার চেষ্টা হচ্ছে, ভাবখানা এমন যে ওরা তো আর অন্ধকার জগতের অর্থলোলুপ ভিলেন নয়, ওরা আমাদেরই ঘরের ছেলেমেয়ে , ওরা যা বলতে চায় বা করতে চায় তা ওরা রাজনৈতিক মূলধারায় এসে বলুক না, আদিবাসীদের বঞ্চনা বা সরকারী-বেসরকারী জবরদখল, এসবকে রাজনৈতিক বিতর্কে তুলে আনার জন্য তো মিডিয়া আছে । পণ্য বিপণনের অবস্থানটাও ঠিক এরকম – একটা বিশেষ উপযোগিতার পণ্যকে প্রথমে স্পেশাল ডিসপ্লে দাও, বিপণন বিগ্যাপনের চাতুর্যে দিনকতক ঐ একটি পণ্যের বিক্রয়ক্ষমতায় বাকি দোকানের ক্রয় বিক্রয় নতুন উচ্চতায় পৌঁছবে, তারপর ধীরে ধীরে প্রাথমিক চমকটা কেটে গেলে ঐ পণ্যটি অন্য পণ্যের সঙ্গে পাশাপাশি জায়গা করে নেবে । ক্ষমতার ভাষ্যের সঙ্গে গোপনে তাল ঠোকা নাগরিক বুদ্ধিবৃত্তিকে কোনো সন্দেহ নেই অরুন্ধুতির সন্দর্ভ সামনে নিয়ে আসছে কিন্তূ ঘুরে ফিরে আসছে মিডিয়ার ব্যক্তিবিশেষের খ্যাতিকে ব্যবহারের প্রশ্ন, বিপণনের চতুর অভিসন্ধি ।

ভিন্ন মত, বিপরীত মতের বিপণন – প্রায়ই যখন মিডিয়ার আসল চেহারা, তার পণ্য শরীর, তার ব্যবসা আর লালসার কর্পোরেট দাঁতনখ শান হারাতে থাকে তাকে নির্ভর করতে হয় এই ক্যাটেগরিটির ওপর । আউটলুকের প্রথম ইস্যুতে ছাপা হয়েছিল কাশ্মীরের ভবিষ্যত নিয়ে কাশ্মীরী জনতা কি ভাবে তার ওপিনিয়ন পোল । কাশ্মীরী জনতার স্বাধীনতার লড়াইকে পাকিস্তানের মদতপুস্ট জঙ্গি কার্য্যকলাপ বলে দেখানো ভারতীয় প্রচারমাধ্যমে সেই প্রথম । এই ওপিনিয়ন পোলের স্পষ্ট রায় – সাতাশি শতাংশ মানুষ কাশ্মীরের স্বাধীনতার পক্ষে, সঙ্গে জনতার ভারতীয় মিলিটারী শাসনের অবসানের দাবি । প্রকাশের পরবর্তী কয়েকদিনে শিবসেনা, আর এস এস মুম্বইয়ে কয়েক লাখ পত্রিকার কপি জ্বালিয়ে দিল, ভাঙচুরের চেষ্টা হল পত্রিকার দফতরে । কাশ্মীর নিয়ে ভারতীয় জনতার বোধে, বিশ্বাসে এই ওপিনিয়ন পোল কতদূর পৌঁছতে পারল ? কাশ্মীরের লড়াইকে পাকিস্তানের আগ্রাসন দেখিয়ে, কখনো ধর্মীয় বিদ্বেষ, কখোনো জাতীয়তা সামনে রেখে আমাদের সরকারী, বেসরকারী প্রচারমাধ্যম, মুম্বইয়ের বারোভাতারী সিনেমা কারখানা কাশ্মীর আর আমাদের মাঝখানে অবিশ্বাসের ব্যবধান বাড়িয়ে চলল । প্রচারের এই প্রগাড় আড়ম্বরে ব্যতিক্রমী দু একটি প্রশ্নচিহ্নে কি এসে যায় ?

যে সব শব্দবন্ধে তার অর্থের বিস্তারে , স্বতসিদ্ধ ধরে নেওয়া ব্যাখ্যায় প্রচার মাধ্যম গ্রামের মানুষ, পিছড়ে বর্গ, আদিবাসী জীবনকে দেখে তার মানটা কে তৈরি করে ? মিডিয়া যখন তথাকথিত কোনো ‘সন্ত্রাসবাদী’র অন্ধকার জগত ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার খবর দেয়, তখন আমরা ব্যাখ্যা চাইতেই পারি ঠিক কেমন এই স্বাভাবিক জীবন ? মহারাস্ট্রের বিদর্ভ, ওড়িশার কালাহান্ডি বা বাংলার বাঁকুড়ার মতো ? ক্ষুতকাতর, আত্মহত্যাপ্রবণ কৃষক, ঘরে ঘরে হাড় জিরজিরে পেট ফুলে ওঠা অপুষ্ট শিশু, পানীয় জলের জন্য কয়েক মাইলের হাঁটা পথ, ওষুধের দোকান বা ডাক্তারের ঠিকানা আরো দূরে, যেখানে মায়েরা অর্ধনগ্ন থাকে, ক্ষুধা, অপুষ্টির থাবায় যেখানে প্রতিনিয়ত ওঁত পেতে থাকে মৃত্যু, মৃত্যুর সামনে বিপর্যয়ের সামনে যেখানে মানুষ শুধু মূক, বধির, অন্ধ হওয়ার চেষ্টা করতে পারে – সত্যিই কি স্বভাবিক এই জীবন না ! আর মিডিয়া যাকে অন্ধকার জগত বলে কেমন সেই আতঙ্কের গহ্বর ? পঁচাত্তরটা সি আর পি এফের লাশের সামনে দাঁড়িয়ে চিদাম্বরম, রামন সিংয়ের মুখে দুশ্চিন্তার জমাট মেঘের মতো ? সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম থেকে ওড়িশা ছত্তিসগড় একের পর এক কর্পোরেট লুটেরা চুক্তি(MOU), পরিকল্পনা জনতার প্রতিরোধের সামনে ভেস্তে গেল- এটাই কি সেই অন্ধকার ?

কর্পোরেট স্বার্থকে জনমতে জায়গা করে দেওয়া আর প্রতিরোধমূলক ভিন্ন জনমতের বিপণন, এই দুইএর বাইরে মিডিয়ার একটা প্রতিরক্ষামূলক ভূমিকা থেকে যাচ্ছে যার নাম সংস্কার, জনমুখী উন্নয়ন, সরকারী সিদ্ধান্তগ্রহ্ণণে জনতার অংশগ্রহণের পক্ষে জোরালো সওয়াল, সরকার বেসরকারের যেকোনো চুক্তি সমঝোতাকে প্রকাশ্যে, মতামত বিনিময়ে বিতর্কে নিয়ে আসার নাগরিক উদ্যোগ । সন্দেহ নেই এই ভূমিকাটিই মিডিয়ার একেকটি ব্র্যান্ডনেমকে জনপ্রিয় করে, কিছুকাল প্রচারের যন্ত্রকলাকে গণমাধ্যম বলে মনে হয় কিন্ত মিডিয়ার আসল আনুগত্যকে চিনতে আরো দেরি হয়, প্রতিরক্ষার সমান্তরাল ব্যবস্থাকে গণমাধ্যমের সদিচ্ছা, দায়িত্ব ইত্যাদি ভোঁতা শব্দে আমরা ভাবতে শুরু করি । ততদিনে মিডিয়া আর এক ইস্যুতে চলে গেছে । খবর নামক একটা জরুরী বুদ্ধিবৃত্তির এবং বিনোদন পণ্যের আসল লক্ষ্য ক্রমাগত এক দিন থেকে আরেক দিনে, এক হপ্তা থেকে আরেক হপ্তায়, বড়জোর এক কি দুই কি তিন মাসের ফেরে রঙ বদলে, ফোকাস বদলে ক্রমাগত কাটতি, সার্কুলেশনটা বাড়িয়ে যাওয়া, বিগ্যাপনদাতার জন্য আরো লোভনীয় হয়ে ওঠা । যে পণ্যের বিষয়বস্তু, তার ভেতরের ক্রিয়াবিক্রিয়া থেকে শুরু করে গ্রাহকের হাত পর্যন্ত সবকিছুর কেন্দ্রেই জনতা (পাঠক এবং দর্শক জনতা, মূলত নাগরিক এবং মফস্বলের আধা-নাগরিক) বাজারের সঙ্গে তার পরিবেশনের সম্পর্ক বাকি পণ্যের তুলনায় অনেক অপ্রতক্ষ্য তো হবেই – অনুপুঙ্খ বিবরণের অছিলায়, নিরপেক্ষতার আবহে তার প্রকৃত দায় আসলে বিপণনের, বাজার দখলের । এক হেডলাইনে ভারতীয় অর্থব্যবস্থার ঊর্দ্ধগামী সূচকের ঊজ্জ্বল ব্যাখ্যা, আর এক খবরে অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর সংখ্যায় ভারতের প্রথম হওয়ার তথ্য, সিঙ্গুরের লড়াই ন্যায্য কিন্ত লালগড়ের আদিবাসীদের বিক্ষোভ সন্ত্রাসবাদী । ‘যে জনতা পাঠক(ক্রেতা), উপরন্ত যারা যত কাছের অথবা প্রভাবশালী পাঠক, আরো নির্দিষ্ট করে বললে যারা যত এই পণ্যব্যবস্থা এবং ক্ষমতার অন্যান্য কেন্দ্রের কাছে আছে, যাদের মতামতকে আমাদের সুখ্যাতি, ব্র্যান্ড ইমেজ পরোয়া করে, খবর এবং তার পরিবেশনের মূল লক্ষ্য এই জনসমষ্টির বিনোদন চাহিদা । যখন আমরা আদিবাসী সমাজের অভাব, বঞ্চনা, বিক্ষোভ নিয়ে খবর করি তার পেছনেও রয়েছে আমাদের নাগরিক ক্রেতার মতামতের প্রতি পরোক্ষ দায় । বিষয়টা খুব স্পর্শকাতর দায়বদ্ধতার, প্রান্তিক, পিছড়ে বর্গ, প্রত্যন্ত দূর্গম অঞ্চলের মানুষ যখন রাষ্ট্র এবং তার কর্পোরেট চালিকাশক্তিকে আঘাত করছে, তখন আমাদের মধ্যস্থতাটা, পশ্চাদপদ জনজাতির ন্যূনতম জীবন জীবিকার অধিকার নিয়ে গলা ফাটানোটা আসলে রাস্ট্রের চালু আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় একটা প্রতিরক্ষামূলক উদারতার পক্ষে ওকালতি করে । প্রশাসনিক ক্ষমতার একবগগা পেশীশক্তি ব্যবহারের পাশাপাশি গণতান্ত্রিক বিক্ষোভ প্রদর্শনের, দরাদরি করার প্রশস্ত রাস্তা, অপারেশন গ্রীন হান্টের পাশাপাশি উন্নয়ন পরিকল্পনার সুফল প্রত্যন্ত মানুষের কাছে পৌছে দেওয়ার স্লোগান । না, আমরা কোনোমতেই অবস্থাটা আয়ত্তের বাইরে যেতে দিতে পারি না । কর্পোরেট মুনাফা নির্দিষ্ট উন্নয়ন, সংস্কারের পদক্ষেপকে জনপ্রিয় করে তুলতে আমরা প্রশাসনিক দূর্নীতিকে টার্গেট করব, একের পর এক দূর্বৃত্তায়ন, দূর্নীতি, সরকারী আমলার কর্তব্যে অবহেলার খবরে ক্রমশ মনে হবে যে উন্নয়নের উজ্জ্বল কর্মকান্ডে জনতার অংশগ্রহণের পথে প্রধান অন্তরায় প্রশাসনিক দূর্নীতি, অতএব চাই প্রশাসনিক সংস্কার, গরিবী হটানোর আরো সরকারী স্কীম, উন্নয়নের স্পেশাল টাস্ক ফোর্স, বলপ্রয়োগের পরিবর্তে জনগণকে অনুকূলে নিয়ে আসার জন্য ঢালাও ইনসেন্টিভ, প্যাকেজ, মধ্যস্থতার ব্যবস্থা’। মিডিয়ার এই ‘ড্যামেজ কন্ট্রোল’ এর দর্শন কোনো পুঁজিবাদী দূরদৃষ্টি নয়, বাজার দখলে মরিয়া মুনাফার স্বয়ংক্রিয়তা । কেউ বলছেন, মিডিয়ার কোনো সার্বভৌম চরিত্র নেই, মিডিয়া প্রতিনিয়ত বহুধারায়, বহুমতে বিচ্ছিন্ন, উদ্দেশ্যহীন । অনেকাংশে ঠিক কিন্ত পুঁজি এবং ক্ষমতার সমষ্টিগত উদ্দেশ্যের বাইরে মিডিয়ার অবস্থানকে কোনোভাবেই কি ব্যাখ্যা করা সম্ভব ? মিডিয়ার বহুমূখীনতায় যারা দিশেহারা সেই অধূনান্তিক প্রতিভূরা কি খবর কে পণ্য বলতে রাজী নন, অথবা সার্কুলেশন, কাটতি, বিগ্যাপন, চ্যানেল জনপ্রিয়তার সূচক, পুরস্কার, প্রতিযোগিতার গ্ল্যামার দুনিয়াকে পণ্যের বিপণন ? এখনও দেশের যে বিরাট জনসমাজ প্রাক পণ্যব্যবস্থায় পড়ে আছে, এখনও যাদের কাছে টুথব্রাশ, খবরের কাগজ থেকে শুরু করে তেলমশালা পর্যন্ত প্রত্যেকটি নাগরিক নিত্য ব্যবহারের পণ্য শুধুই বিলাসদ্রব্য, ব্যয়বহুল নিত্য ব্যবহারের নাগরিক সামগ্রী তারা মিডিয়া এবং নাগরিক পণ্য ব্যবস্থায় কোন চাহিদা তৈরি করতে পারে ?


২) পুঁজি এবং শ্রমের পালটে যাওয়া ফোকাসঃ উপনিবেশের নয়া রীতি
বিশ্বায়নের যুগে এসে পুঁজির মৌলিক চরিত্র, ক্রমাগত শ্রমশক্তিকে মুনাফায় রূপান্তরিত করার মূল বৈশিষ্ট্যগুলো একই আছে কিন্ত আমূল বদলে গেছে পুঁজির পরিচিতি, তার রূপের প্রশ্নটি, তার আগ্রাসনের বাজারী কুশলতা । পুঁজি এখন বহুজাতিক, যার নিয়ন্ত্রণক্ষমতা এখনও রয়ে গেছে পশ্চিমের আর্থিক শক্তিধর দেশেদের হাতে । সাম্প্রতিক দশ পনেরো বছরে ভারত, ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়া, সাউথ কোরিয়া, সাউথ আফ্রিকা প্রভৃতি দেশে যে উতপাদন শিল্পের বাড়বাড়ন্ত তাকে অনেকেই বিশ্বপুঁজির ক্রমপ্রসারণ, প্রথম বিশ্ব থেকে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বিশ্বে পুঁজির ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ বলে দেখাতে চাইছেন । ভাবখানা এমন যে বাজার দখলে এসে বহুজাতিক পুঁজি সস্তা শ্রম এবং উতপাদন ব্যয় কমানোর সমস্ত সুবিধার জন্য বাধ্য হচ্ছে তার উতপাদন ব্যবস্থাটাই তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নিয়ে আসতে, আর এর সুফল হিসেবে আমাদের কর্মসংস্থান বাড়ছে, দেশীয় উতপাদকের জন্য সরবরাহের নতুন নতুন সুযোগ তৈরি হচ্ছে, সর্বোপরি দেশীয় শিল্পদ্দ্যোগীরাও তাদের বাজার প্রসারণে বহুজাতিকের সঙ্গে জোঁট বাঁধতে পারছেন, উন্নত কারীগরী ব্যবহারের সুযোগ খুলে যাচ্ছে, তৈরি হচ্ছে ভারতীয় বা ইন্দোনেশিয়ান বহুজাতিক । কেমন এই ভারতীয় বহুজাতিক ? দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মূল কারখানাটি টয়োটা ভারতে করলে তাতে আমাদের কতটুকু লাভ ? পশ্চিমের তাবড় তাবড় পোশাক কোম্পানীর পৃথিবীব্যাপী উতপাদনের চল্লিশ বা পঞ্চাশ শতাংশ আমাদের চেন্নাই বা আমেদাবাদে হলে কতলোকের কর্মসংস্থান হবে আর কতলোক প্রত্যক্ষ্য বা পরোক্ষ ভাবে কাজ হারাবেন, আর কেমনই বা হবে এই সস্তাশ্রমের কর্মসংস্থান ? এই সমস্ত এবং আরো অনেক প্রশ্ন আজ নতুন করে তোলা জরুরী, বিশ্বায়নের মল সংস্কৃতি, হাইটেক জীবনধারায় প্রলুব্ধ স্বচ্ছল নাগরিক মধ্যবিত্তের দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, বিশ্বপুঁজির এই নতুন ধারার উপনিবেশে যারা কাজ, রুটি-রুজি, প্রজন্মলালিত ভিটে-মাটি-পরিবেশ হারাল তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে অথবা যারা কয়েক প্রজন্ম ধরে কণ্ট্রাক্টর-বিডিও-পঞ্চায়েত প্রধান-মুখিয়ার চতুর্মুখী জাঁতাকলে পিষে যাদের নতুন করে হারাবার বলতে শুধু মাথা গোঁজার চালা, ভাগচাষ বর্গাচাষের স্বত্ত বা বছরে শুধু তিন কি চার মাস পেট চালাবার মতো দুচার বিঘা জমি তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে ।

বাজার যেখানে সেখানেই উতপাদন উপরন্ত যতটা বেশী সম্ভব আধুনিক এবং সাম্প্রতিক যন্ত্রকুশলতা, কারিগরী এবং যতটা কম সম্ভব শ্রমশক্তি । শ্রমসংখ্যায় যতটা কম অনুপাতে সম্ভব দক্ষ, আধূনিক যন্ত্রকুশল শ্রমিক এবং যতটা সম্ভব বেশী অনুপাতে কোম্পানীর মূল উতপাদনের(ব্র্যান্ডনেমের) বাইরে আনুষাঙ্গিক বা সরবরাহ বা ঠিকেদারী কাজে সস্তা, অদক্ষ, গায়ে গতরে খাটা আধা সংগঠিত বা অসংগঠিত শ্রমিক । শহরের মধ্যবিত্ত ঘর থেকে অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে আসা যে ছেলেটি টয়োটার প্রডাকশান লাইনে কাজ করে সেই আত্মগর্বী পেশাদার নিজেকে শ্রমিক নয়, টেকনোক্র্যাট বলতেই পছন্দ করেন । আসলে ইনি প্রথম বিশ্বের শ্রমিক, পার্থক্য শুধু এই, গড়পড়তা আমেরিকান শ্রমিকের জীবনে যে আর্থিক হতাশা আছে আমাদের তৃতীয় বিশ্বে বহুজাতিকের প্রডাকশান লাইনের নব্য টেকনোক্র্যাটদের সেটুকুও নেই, উন্নত দেশের সম্পূর্ণ বিপরীতে এদের গড় আয় দেশের চাকরিজীবী জনতার গড় আয়ের তুলনায় অনেক বেশী । কোনো সন্দেহ নেই সিঙ্গুরে টাটার কারখানার জমি অধিগ্রহণের জন্য এরা সল্টলেকের সফটওয়্যার পার্কে দাঁড়িয়ে মিডিয়াকে বলবেন কেন কর্মসংস্থানের জন্য শিল্পায়ন এবং তার জন্য কৃষকের জমি অধিগ্রহণ জরুরী । পালটা যুক্তি, পালটা প্রশ্নগুলো কিছুদিনের জন্য আলোচনা, কথোপকথনে উঠে হারিয়ে যাবে, যেমন পাট, চা, কাগজ এইসব শিল্পগুলো সরকারের কাছে গুরুত্ব হারিয়ে ফেলল কেন, যেখানে প্ল্যাস্টিক বর্জনের যুগে পাট আর কাগজের চাহিদা বিশ্বব্যাপী ঊর্দ্ধমুখী আর ভারতীয় চায়ের গুণগত উতকর্ষের কারণেই এই শিল্পে কখনো চাহিদার সংকট আসেনি । এই শিল্পগুলো চরিত্র জনমুখী, কারণ এইসব শিল্পে প্রচুর সাধারণ মজদুর, চাষীর কর্মসংস্থান হয় (শ্রমনিবিড়) এবং এইসব শিল্পের উতপাদনও আমজনতার নিত্যব্যবহারের আওতায় পড়ে । কিন্ত সরকারের ফোকাসটাই তো অন্য শিল্পে, যে শিল্প হাইটেক, যে শিল্পে কারীগরী বিদ্যায় শিক্ষিত স্বল্পসংখ্যক লোকের কর্মসংস্থান হবে আর তার বিরাট প্রতিষ্ঠানের চাহিদা মেটাতে বহু চাষী তার রুটি-রুজির কৃষিজমি, প্রজন্মের ভিটেমাটি হারিয়ে সামাজিক উদবাস্ত হবেন, উপরন্ত বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই এই হাইটেক শিল্পের উতপাদিত পণ্য উচ্চবিত্ত, স্বচ্ছল নব্য মধ্যবিত্তের কথা মাথায় রেখে তৈরি করা ভোগ্যপণ্য যার সঙ্গে সত্তর শতাংশ দরিদ্র বা নিম্নআয়ের ভারতীয় জীবনযাপনের কোনো যোগ নেই । আসলে বিশ্বপুঁজির মন্দা রুখতে যে বিপুল অলস অর্থ রিজার্ভ ক্যাশ হয়ে ক্রমশ মুদ্রার সংকট ডেকে আনছে তাইই দিতে পারে বিশ্বপুঁজির মূল্যসংকটে নতুন রক্তসঞ্চালন, তাতে সত্তর শতাংশের কৃষিজীবী ভারতে দারিদ্র্যের মাত্রা আরো একটু বাড়বে কিন্ত অন্যদিকে ক্রমশ দেশের ক্রমবর্দ্ধমান আর্থিক সূচকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়বে নব্য কর্পোরেট মধ্যবিত্তের জীবনযাপনের মান, তার ভোগ্যপণ্য ব্যবহারের মাত্রা, এরাইতো আমাদের আর্থিক উন্নতির নিদর্শন । যে সরকার, সরকারী ব্যবস্থা (দলমত নির্বিশেষে) খোলাখুলি বিশ্বপুঁজির স্বার্থের ওকালতি করে আমভারতীয়ের জীবন-জীবিকার বিনিময়ে, বলা বাহুল্য সেই সরকার, সেই ব্যবস্থার কাছে এই সমস্ত প্রশ্নই অর্থহীন, সরকারী স্তরে আলোচনা, সেমিনার, অংশগ্রহণমূলক সিদ্ধান্তের আওয়াজ এইসব নেহাতই মানবাধিকারের বিগ্যাপন ।

যেকোনো ক্ষমতা তার দীর্ঘকালীন অস্তিত্বের জন্য চিরকালই একটা সুবিধাভোগী মধ্যস্বত্ত্বভোগী শ্রেণীর জন্ম দেয়, সঙ্গে জন্ম নেয় ক্ষমতার সমস্ত অনুষঙ্গ, উপকরণের সঙ্গে সহজ সম্পর্কে আসার জন্য নতুন সংস্কৃতি, বিপণন । নতুন এক্সিকিউটিভ মধ্যবিত্ত, কারীগরী শিক্ষিত, টেকনোক্র্যাট ভারতীয় নাগরিক শ্রেণীই এখন বহুজাতীক পুঁজির সামনের মুখ আর তাকে ঘিরে হাইটেক বিপণন সংস্কৃতি । বড় শহর, মেট্রোপলিটান ছাড়িয়ে দ্রুত ছোট ছোট শহরে গজিয়ে উঠছে ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, শপিং মল, জলাশয় বুঁজিয়ে, কখনো চা বাগানের জমির ওপর, কখনো গোটা একটা জনবসতিকে প্রলোভন বা প্রশাসনিক চাপে উচ্ছেদ করে একের পর এক মাথা তুলছে বহুতল ফ্ল্যাটবাড়ী । যারা বহুজাতিকের বহুমূল্য মধ্যস্বত্ত্ব সরাসরি পেল না তাদের অনেকেই এই বহুতল, মল, বিপণন সংস্কৃতির মধ্যে জায়গা করে নিল । যেকোনো শহরে দালাল, সরবরাহকারী, ঠিকেদার, প্রোমোটার আঞ্চলিক ক্ষমতার কেন্দ্র হিসেবে উঠে এসেছে । অর্থাভাবের থেকেও বেশী নাগরিক জীবনে জায়গা করে নিচ্ছে অনিশ্চয়তা, স্বচ্ছলতাকে ধরে রাখবার জন্য আরো দায়িত্বের চাপ, ব্যস্ততা । ‘এই ব্যবস্থায় এক জায়গায় তুমি সারাটি জীবন কাটিয়ে দেওয়ার কথা ভাবতে পার না, যেকোনো সময় তোমার থেকে আরো দক্ষ, কুশলী কেউ তোমার জায়গা কেড়ে নেবে ফলে তোমাকে আরো ভাল প্যাকেজ, আরো ভাল পারিশ্রমিকের জন্য পাশের লোককে আউটপারফর্ম করে যেতেই হবে’। প্রতিযোগিতার এই কর্পোরেট দর্শন শুধু কাজের সাফল্য, পারফর্মেন্সের কথা বলে না, কোম্পানীর বাজার দখলের লক্ষ্য(Vision), আর সেই লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছনোর জন্য প্রয়োজনীয় শৃঙ্খলা, ব্যবসায়িক মূল্যবোধ, লেনদেনের স্বচ্ছতা, কর্মীদের পারস্পরিক সম্মান(Values), এই প্রতিটির ওপর গুরুত্ব দেয়, কারণ মুনাফাসাম্রাজ্যের চালনা, বিস্তার, বৈধতার জন্য, ব্র্যান্ডনেমকে সামাজিক সম্মানে প্রতিষ্ঠা দিতে কোম্পানীকে কর্মীর পরিবার ভাবতে শেখানো হয় । এই কর্পোরেট কর্মসংস্কৃতি যে সমাজবিস্মৃত , একক, স্বার্থপর নাগরিকের জন্ম দেয়, বলা বাহুল্য, আদিবাসী, পিছড়ে বর্গ, কৃষিজীবী মানুষের জীবন-জীবীকা সম্পর্কে তার উদাসীনই থাকার কথা । এদের কাছে প্রত্যেকটি মানুষ স্বতন্ত্র দ্বীপের মতো যে তার পজিটিভ মনোভাবের জোরে যেকোনো আর্থ-সামাজিক উচ্চতায় পৌঁছতে পারে । এই কর্পোরেট নাগরিক বাকি দায়িত্ব ছেড়ে দেয় ক্লিশে হয়ে যাওয়া দুটি শব্দে, তাদের যোগাযোগের ঈঙ্গিতে – ‘কোরাপসান’ আর ‘পলিটিশিয়ান’ । খুব স্বাভাবিক, এদেরকে কর্পোরেট স্বচ্ছতা শেখানো হয় যে !

আর যারা হাইটেক শিল্পের অজস্র ছোট বড় যোগানদারী কারখানায় পড়ে রইল, ওভারটাইমের নামে যারা আসলে পরের দিন কাজে আসাটুকু নিশ্চিত করে অথবা যারা নিতান্তই অসংগঠিত, সরকার-বেসরকারে ঠিকেদারের প্রভাব প্রতিপত্তি যাদের কাজ পাওয়া না পাওয়ার একমাত্র নির্ণায়ক, যাদের জীবন-রুটি-রুজি-শ্রম ঠিকেদার নামক এক ক্ষুদ্র ক্ষমতার মর্জির ওপর নির্ভর করে, এই নতুন বহুজাতীক, বহুস্তরীয় শ্রমব্যবস্থ্যায় এদের অবস্থাটাই সবচেয়ে ভাসমান, সংকটাপ্নন । কেননা যেকোনো ব্র্যান্ডেড পণ্যের প্রোডাকসান লাইনে সামান্য অদল বদল হলে, বিপণন কর্তারা এক ক্যাটেগরির পণ্য থেকে অন্য ক্যাটেগরিতে ফোকাস বদলালে যোগানদারী শিল্পের লক্ষ্ লক্ষ শ্রমিকের পরের দিন বা পরের মাসটি অনিশ্চিত হয়ে পড়ে । আর ঘাটতি জর্জর প্রথম বিশ্বের বহুজাতিক অর্থব্যবস্থা সামান্য পা পিছলোলে তৃতীয় বিশ্বের ভাড়া করা প্রোডাকসান লাইনের কোম্পানী এমপ্লয়ীরাই প্রমাদ গোনে আর এই প্রান্তবাসী সরবরাহ শিল্পে তো ব্যয় সংকোচনের জেরে যে কেউ যেকোনোদিনই হয়ে যেতে পারে অতিরিক্ত । এরও পরের স্তরে যে ঠিকেদারী শ্রমিক সে তো সবসময়েই অনিশ্চিত, অনিয়মিত । দল বেধেঁ সকালের ট্রেনে এরা গ্রাম বা শহরতলী থেকে শহরে আসে, অথবা নির্মীয়মাণ বহুতলের অস্থায়ী আস্তানায় ম্যারাপের নীচে রাত্রিবাস, এদের অনেকেই মাস, এমনকি বছর পেরিয়ে ভারতের বিভিন্ন শহরে কাজ করে বেড়ায় । মুর্শিদাবাদের যে বাস্তশ্রমিক বা নির্মাণশ্রমিক মুম্বইয়ের হাইরাইজ বা দিল্লীর ফ্লাইওভার বানায়, তার দেশে হয়ত দু চার বিঘে জমি আছে কিম্বা সে ভাগচাষী কিন্ত তার আসল অভিগ্যতা, আসল গ্যান পূর্বপুরুষের হাত ধরে পাওয়া চাষবাসের, আর এই নতুন পেশার বিদ্যে, বাস্তশ্রমিক হয়ে ওঠার কুশলতার অবশিষ্ট দায়টুকু গ্রামীণ ভারতের রুগ্ন, অনাহার আখ্যায়িত কৃষির । শিল্পায়নের জন্য আজ যখনই কৃষিজমি অধিগ্রহণ জরুরী হয়ে পড়ছে, অবধারিত জীবন-জীবিকার উচ্ছেদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের ক্ষোভ সরকারী-বেসরকারী পরিকল্পনার সামনে তৈরি করছে চ্যালেঞ্জ, তখনই সরকারী উদ্যোগে, বাণিজ্যিক মিডিয়ার সহায়তায় একটা নতুন সংকটের গল্প চাউর করার চেষ্টা হচ্ছে, মিডিয়া থেকে নাগরিক মতামতে ক্রমাগত বলা হচ্ছে যে গ্রামের শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা আজ আর চাষবাসের কাজে আগ্রহী নয়, শহুরে নাগরিক প্রশ্ন তুলছেন পড়াশোনা শিখে গ্রামের শিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা কি চাষ-আবাদ করবে ? ঘুরিয়ে প্রশ্নটা কেউ সরকারকে করছেন না, গ্রামের নব্যশিক্ষিত মানুষের কাছে চাষবাস আজ আর গ্রহণযোগ্যে জীবিকা নয় কেন, তথাকথিত ডিগ্রীশিক্ষা, কারিগরী বিদ্যার সঙ্গে কৃষিগ্যান, চাষাবাদের কুশলতার বিরোধটা কোথায়, কেন একটি সম্মানীয় জীবিকা হিসেবে কৃষিকাজ চাষীকে তার ন্যূনতম ভরণ-পোষণ, আর্থিক নিরাপত্তা, সচ্ছলতার গ্যারান্টী দিতে পারে না ? ক্ষমতার কেন্দ্রের কাছে, তার প্রচার যন্ত্রের চারপাশে যে পণ্যবাস্তবতা সেইই জন্ম দিচ্ছে এই হীনমন্যতার, সামাজিক মতামতে হেয় করতে শেখাচ্ছে কৃষিকাজকে, মাটি-মানুষের আদিম সম্পর্ককে । আজ শহরের প্রান্তসীমায় বসবাসকারী মানুষদের অধিকাংশের জীবন জুড়েই উদবাস্তর আখ্যান, উচ্ছেদের স্মৃতি, কেউ শেকড়-বাকড়ের টানে সপ্তাহান্তে বা মাস পেরোলে বা বছর ঘুরে সেই ভেতরে শুনশান স্তব্ধ হয়ে পড়ে থাকা দেশ দেখতে যায় কেউ আর যায় না, ক্রমশ উপচে পড়া জীবন জীবীকার রোজকার হিসেবের ভেতর হারিয়ে যায় ।

টাটা, রিলায়েন্স বা এয়ারটেলকে বহুজাতীক বলতে পেরে অনেক নাগরিকই শ্লাঘা বোধ করেন, সঙ্গে মিডিয়ার কল্যাণে মুখে মুখে মুখে ফেরে কোনো বিদেশী কোম্পানীকে টাটার অধিগ্রহণের খবর, বিশ্বের ধনীদের তালিকায় আম্বানীর বিশেষ উচ্চতালাভ বা ভারতের বাইরে বিভিন্ন দেশে এয়ারটেলের পরিষেবার সফল বিগ্যাপন । ‘উজ্জ্বল ভারতে’র নাগরিকদের পক্ষে এটাই স্বাভাবিক কিন্ত যেটা লক্ষ্য করবার সেটা হল প্রথম বিশ্বের পুঁজি এবং চাহিদা তৃতীয় বিশ্বে যে সফল দোসর, যে দেশী ব্র্যান্ড ইমেজ তৈরি করতে চেয়েছে তাতে সে অনেকটাই সফল ।

পুঁজির যে জনমুখী বিকাশ, যে স্বতস্ফূর্ত স্ফূরণ ইউরোপ আমেরিকার অধিকাংশ দেশে হয়েছে তার গোড়ায় ছিল কৃষিব্যবস্থাটারই উতপাদনঘন কৃষিশিল্পে বদল – খামারব্যবস্থা, যেখানে কৃষকেরা শেয়ার হোল্ডার বা যৌথ মালিক, পুরনো কৃষিসরঞ্জাম, আবাদী পশুর ওপর নির্ভরতার বদলে আধূনিক যন্ত্রসরঞ্জাম, সেচব্যবস্থা, বৈদ্যুতিকরণ । বিশ্বায়নের পশ্চিমী হোতারা ভাল করেই জানেন তাদের নিজেদের দেশে সামন্ততান্ত্রিক কৃষির অবলোপনের মধ্য দিয়েই আধুনিক পুঁজিব্যবস্থার বিকাশের শুরু । সামন্তপ্রথা উচ্ছেদের যে সূচনা জমির বন্টনের মধ্য দিয়ে – যদিও তা সমবন্টন নয় – তাইই নিশ্চিত করেছিল জনতার ক্রয়ক্ষমতা, আর্থিক স্বয়ংম্ভরতাকে এবং ফলস্বরূপ ভোগ্যপণ্য, স্বচ্ছল জীবনযাপন সামগ্রীর বিরাট শিল্পায়নকে । প্রথম বিশ্বে পুঁজি স্বয়ংক্রিয় ক্ষমতা হয়ে ওঠার সময়ে পুঁজির বিকাশের, তার নিয়ন্ত্রণের যে মূল ফ্যাক্টরগুলো, রাজনৈতিক অতিকাঠামোয় বদলের কারণে বা উন্নত বিশ্বে পুঁজির সংকটের কারণে তৃতীয় বিশ্বের জঙ্গল নির্ভর পিছড়ে বর্গ, ক্ষুদ্রচাষ, ভাগচাষ নির্ভর জনজাতির দেশে সেই একই জরুরী ফ্যাক্টরগুলো কিভাবে বদলাতে পারে ? বদলায় না, কিন্ত আমাদের জন্য গোপনে লালন করা হয়েছে একই প্রশাসন, একই সরকার, একই মুদ্রাব্যবস্থা, একই আইনব্যবস্থা শাসিত একই ভৌগোলিক মানচিত্রের ভেতরে দুই দেশের ভাবনা। সংকটাপন্ন উন্নত বিশ্বের পুঁজি রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ক্ষমতার অলিন্দে যে মধ্যস্বত্ত্বভোগী শ্রেণীকে পালন করে এসেছে তারাই তো নেহরু, মনমোহন, আম্বানী, টাটা, মিত্তাল। এদেরকে ঘিরেই তো ‘উজ্জ্বল ভারতে’র প্রলুব্ধ নাগরিক।

এই উজ্জ্বল ভারতের লালসা সাম্রাজ্যের কর্তারা অন্য ভারতের কৃষক, আদিবাসী, জনজাতির সঙ্গে ঔপনিবেশিক আচরণ করবেন, এটাই তো স্বাভাবিক। যেমন স্বাভাবিক ‘উন্নয়ন’ নামক ‘উজ্জ্বল ভারতে’র সরকারী, কর্পোরেট আগ্রাসনকে মানুষ নিজের জীবন দিয়ে প্রতিরোধ করবে ।

৩)বর্তমান চীনঃ বিপ্লবের নতুন উপযোগিতা
প্যারিস কমিউন থেকে রাশিয়া, পূর্ব ইউরোপ, ভিয়েতনাম, কিউবা – সর্বহারা শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কতন্ত্র, সমাজতন্ত্রের যে স্বপ্ন, যুক্তি এবং অভিগ্যতা যে চরম ক্ষমতাবান একপার্টি, একমত, এক ইচ্ছামূলক প্রশাসনিক কেন্দ্রীকতার কথা বলে, যেখানে ক্ষমতার একস্বরকে প্রতিনিয়ত জনতার বহুস্বর বা সমস্বর বলে চালানো হয় তার সঙ্গে আজকের চীনের অনেক মিল এবং অমিল । কমিউনিষ্ট একপার্টি শাসনের সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলো বাদ দিলে চীনের বিপ্লব এবং বিপ্লোবত্তর সমাজ আমাদের জন্য একটা তাতপর্য রেখে যাচ্ছে, তা হল, প্রথম বিশ্বের আগ্রাসী পুঁজির ক্ষমতাকে রুখতে তৃতীয় বিশ্বে জনমুখী জাতীয় পুঁজির চূড়ান্ত বিকাশ যা পশ্চিমের ক্ষমতার কাঠামোর সঙ্গে পৃথিবীর অন্যপ্রান্তের প্রথম একটা প্রতিযোগিতামূলক ভারসাম্য তৈরি করতে পারল ।

বিপ্লোবত্তর চীনের সবচেয়ে বড় অবদান যার ওপরে আজকের বিত্তবান চীনের গোটা বর্তমান এবং ভবিষ্যতটা দাঁড়িয়ে আছে তা হল সামন্তপ্রথা, সামন্ততান্ত্রিক ভূমিব্যবস্থার সমূল উচ্ছেদ । ভূমিহীন চাষী, বর্গাদার, ভাগচাষী, সামন্ততান্ত্রিক শ্রমের সঙ্গে যুক্ত এই সামাজিক শ্রেণীগুলোই গোটা চীনে অত্যন্ত বিরল । কিন্ত হ্যাঁ, আর্থিক বৈষম্য, জীবনযাপন মানের বৈষম্য, সামাজিক ক্ষমতার বৈষম্য এই প্রত্যেকটিই আছে এবং প্রবল ভাবেই আছে । কিন্ত যা নেই তা হল কর্পোরেট হাউসের কাছে, মুনাফার দেশী বিদেশী লুটেরাদের কাছে সমস্ত অর্থনৈতিক, সামাজিক, প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের ঘৃণ্য আত্মসমর্পণ । শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, খাদ্য নিরাপত্তায় আজকের চীন এমনকি ইউরোপের অনেক দেশের খুব কাছাকাছি । বিপ্লবের পরে পরেই গ্রামীণ চীনে ভূমি মালিকানার সমূল বদল যার ফলে প্রত্যেক চাষীর কাছে পৌঁছল অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার রসদ, বাধ্যতামূলক এবং ন্যূনতম ব্যয়ভারহীন প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থা এবং উচ্চশিক্ষায় বিরাট সরকারী ভর্তূকী, উতসাহের নানারকম ব্যবস্থা, আর তিন স্তরের সরকারী চিকিতসাব্যবস্থা যেখানে একমাত্র নির্বাচিত কিছু বড় রোগ বা জীবন সংকটেই রোগীকে ন্যূনতম তিরিশ শতাংশ ব্যয়ভার বহন করতে হয় – এই জনমুখী কাঠামোই নিশ্চিত করে যে চীনের অর্থনৈতিক উন্নতির পেছনে আছে বিরাট সংখ্যক সামাজিক পিছিয়ে পড়া শ্রেণী, কৃষক সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণ । পশ্চিমের উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোতে অবস্থাটা এর থেকেও ভাল কিন্ত ট্রেন্ডটা মূলত একইরকম । আর্থিক বৈষম্য বা সামাজিক বৈষম্য থাক কিন্ত রাষ্ট্র অন্তত জনজীবনের মৌল কয়েকটি প্রয়োজনের ভার নিজে নেবে । আর আমাদের দেশ ? হ্যাঁ, যোজনা কমিশন আমাদের হতদরিদ্র্ জনতার সংখ্যাটা লঘু করতে একটা সহজ পদ্ধতি নিয়েছে – সারা বিশ্ব যেখানে রাষ্ট্রস্নংঘ নির্ধারিত ১.২৫ ডলার (ভারতীয় মূদ্রায় ১০০/১১০ টাকার মতো) দৈনিক আয়কে দারিদ্র্যসীমার মাপকাঠি মানে, আমাদের সরকারী পরিমাপ সেখানে গ্রামের ক্ষেত্রে মাসিক ৩৫০ টাকা আয় আর শহরে ৫৫০ টাকা । ফলে রাষ্ট্রসংঘের হিসেবে যেখানে দারিদ্র্যসীমার নীচে বসবাসকারী ভারতীয়ের সংখ্যা জনসংখ্যার ৪১ শতাংশ আমাদের দিল্লীর বাবুদের হিসেব সেখানে ২৫ শতাংশ । সত্যি, দারিদ্র্য দূরীকরণের কি আন্তরিক সরকারী পদ্ধতি ! তবু দারিদ্র্যসীমার এই নতুন ভারতীয় আবিষ্কার একটা ভাবনাকে উস্কে দেয়, খুব মর্মান্তিকভাবেই, - কিভাবে বাঁচে সেই মানুষ যে মাসে তিনশো পঞ্চাশ টাকাও রোজগার করে না ? রাষ্ট্রসংঘের ভাবা উচিত দারিদ্র্যসীমার নীচে হতদারিদ্র্যের আরো চরম কোনো সীমা, মাপকাঠি বেঁধে ফেলা যায় কিনা, অন্তত ভারতবর্ষের জন্য ! উজ্জ্বল ভারতের এত এত বিগ্যাপন করেও, আর্থিক সমৃদ্ধির এত ফলাও প্রচার করেও তবু দু-চারটি তীব্র, মর্মন্তদ, আর্ত পরিসংখ্যান প্রচারের তুমুল ব্যান্ডপার্টি অতিক্রম করে বার বার সামনে এসে পড়ছে, যেমন, শুধু ভারতেই পৃথিবীর অর্ধেক কম ওজনের শিশুর বাস, অপুষ্ট শিশুর সংখ্যায় আমরা পৃথিবীতে প্রথম, এমনকি আফ্রিকার সাহারা অঞ্চলের দেশেদের থেকেও আগে । আসলে চল্লিশ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নীচে বাস করা মানুষ আর বাকী হিসেব মিলিয়ে দিন গুজরান করা তিরিশ শতাংশের যে ভারত, যে ভারতের সন্ত্রাস ছাড়া, উপুর্যপরি মৃত্যু ছাড়া কোনো খবর হয় না, সেই ভারতকে তোয়াক্কা না করেই গড়ে উঠছে একের পর এক সফট্‌ওয়ার পার্ক, আস্ত একটা শহরের আয়তনের এসইজ়েড, চোখ ধাঁধানো শপিং মল, ল্যান্ডস্কেপ আবাসন, তারাখচিত হোটেল, প্রমোদ নগরী, হাইটেক স্কুল কলেজ, নাগরিক জীবনে ক্রমবর্দ্ধমান মোটরগাড়ীর চাহিদার সঙ্গে তাল রাখতে আট লেনের হাইওয়ে, ফ্লাইওভার, রাস্তায় চলছে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত বাস – বিশ্বায়নের বিগ্যাপনে এই স্বচ্ছল উচ্চাকাঙ্খী ভারতই তো জায়গা করে নিচ্ছে ! হ্যাঁ, বিশ্বায়নের পশ্চিমী বসেরা ঠিক এরকম বিগ্যাপনই চায় । বিশ্বায়নের পুঁজির যে বিপণন, সে চায় আরো গ্ল্যামার, চাকচিক্য, দূর্দান্ত প্রসাধন, ঝলমলে পরিবেশনা, কারণ সম্মোহনটাই এই বিপণনের আসল মনস্তত্ব । একপেটা খেয়ে থাকা পরিবারেও নতুন মোবাইলের চাহিদা তৈরি হবে, অধরা, অগ্যাত রয়ে যাবে পুঁজির বিকাশের ভেতরকার যুক্তি, উন্নতি, সমৃদ্ধির জনসড়ক ।

চিরাচরিত সমাজবিপ্লবের ভাবনায় আজ কি একটা বদল আসতে পারে না, অন্তত তার আশু লক্ষ্যের দিক থেকে ? পুঁজিবাদের সমূল উতপাটনের বদলে, সাম্যবাদ-সমাজতন্ত্রের ভাবনার পরিবর্তে বরঞ্চ পুঁজির ক্ষমতারই আরো সামাজিক বিকেন্দ্রীকরণ, ক্রমপ্রসারণের ভাবনা ভাবা যায় না ? চিরাচরিত সর্বহারা একনায়কতন্ত্রের মার্কসীয় শাস্ত্রবাক্যের বদলে আমাদের বিপ্লব প্রচেষ্টার লক্ষ্য কি হতে পারে না সামন্তপ্রথা, মুখিয়াপ্রথা, খাপ পঞ্চায়েত, বর্ণব্যবস্থা, ঠিকেদারী শাসনের জঙ্গম থেকে বেরিয়ে পুঁজির বিকাশের প্রকৃত গণব্যবস্থার কায়েম ?

যখন বিশ্বায়নের বিগ্যাপন বিপণনে পুঁজিবাদী চীন আর সামন্ততান্ত্রিক ভারতের ভাড়াটে পুঁজি পাশাপাশি জায়গা করে নেয় তখন বিপ্লবের লক্ষ্যও প্রতিবর্ত নিয়মে প্রকৃত পুঁজিবাদী সমাজ হতে পারে। বিশ্বায়নের মিথ্যাচারের সামনে পুঁজির ভেতরকার যুক্তিকে এভাবেই না আমরা প্রকাশ্যে নিয়ে আসতে পারি !

৪)সমাজ, সামাজিক শব্দের ধূসর অঞ্চলঃ অধূনান্তিক সংকট
প্রথম বিশ্বে বিপুল অলস উদ্‌বৃত্ত মুল্যের সংকট, প্রকান্ড উতপাদন ব্যবস্থার চাহিদার সঙ্গে তাল রাখতে না পারা বাজার সংকট নিশ্চিত করেছিল নতুন বিলম্বিত পুঁজিবাদের, বাজার অর্থনীতির, নয়া উদারনৈতিক অর্থব্যবস্থার । এই নতুন পুঁজিব্যবস্থার মূল মন্ত্র হয়ে উঠল পণ্যকে দেশীয়-মহাদেশীয়- আঞ্চলিক সীমারেখা থেকে বার করে বিশ্ববাজারের চাহিদার উপযোগী করে তোলা, কৃষিনির্ভর তৃতীয় বিশ্বে আধুনিক ভোগ্যপণ্যের চাহিদা তৈরি করা আর তার জন্য নতুন ব্যবহারিক সংস্কৃতি, সামাজিক সম্পর্ক হারানো জীবনবোধের বিপণন । একই সঙ্গে চাহিদা ধরে রাখতে ক্রমশ জরুরী হয়ে পড়ল উতপাদন ব্যয় কমানো, ফলে টয়োটা থেকে সোনি, জেনারেল মোটর্স থেকে জেনারেল ইলেক্ট্রিক, ফিলিপস থেকে ফাইজার সব বড় উতপাদককেই সস্তাশ্রমের জন্য বা বিভিন্ন দেশের আঞ্চলিক বাজারের কাছাকাছি থাকার জন্য বাধ্য হতে হল তাদের বিরাট রপ্তানীনির্ভর উতপাদনব্যবস্থাকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে দিতে । উতপাদনের ভৌগোলিক মানচিত্রের এই বদলে বিশ্ববাজারে পণ্যের বিপণনেও একটা নতুন মাত্রা এল, কেননা যা ছিল বিদেশী, আমদানীকৃত, ভোল পালটে আঞ্চলিক উতপাদনের গুনে তাকেই দেখাতে লাগল দেশী (দেশে তৈরি, দেশের মানুষের হাতে তৈরি, উতকৃষ্ট অথচ সুলভ) । বাজারের প্রসারণ চাহিদার আঞ্চলিক বৈচিত্র্যকে লক্ষ্য করে পণ্যও নিজেকে ক্রমশ ভেঙ্গে চলল, একই আমেরিকান পণ্যের ভারতীয় সংস্করণের মান অনেক খারাপ কিন্ত সস্তা, আবার ইউরোপে তারই ব্যবহারিক গুণাগুণ অনেক বেশী এবং ব্যয়বহুল । দৈত্যাকার শিল্পসাম্রাজ্যের বিরাট যোগানের সঙ্গে চাহিদার তাল রাখতে পণ্য আর তার উতপাদনব্যবস্থা উভয়েই নিজেকে ক্রমশ ভেঙ্গে চলেছে, মানুষের জীবনযাপনের এমন অনেক নিভৃত অঞ্চল, একান্তে অর্জিত ব্যবহারবিধির ভেতর পণ্য পৌঁছতে চাইছে । জীবনপ্রণালীর আলো আঁধারি ঘেঁষে পড়ে থাকা কোনো একটি প্রজন্মলালিত ব্যবহার একবার সেই জনতার সাধারণ আচরণে, উপরিস্তরে উঠে এলেই হল, অমনি শুরু হয়ে যাবে তার ব্যবসায়িক সম্ভাবনার হিসেবনিকেশ, চাহিদার জরিপ । কলকাতার বড়বাজারে ঘুরতে ঘুরতে একবার এক স্টোরহাউসের সামনে এমনই কিছু জিনিস চোখে পড়েছিল, খুবই সাধারণ, আমাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক-ধার্মিক আচরণে ব্যবহার্য অনেক জিনিস, জলে ভাসানো মাটির প্রদীপ, দেওয়ালির মোমবাতি থেকে শুরু করে আলপনা, এমনকি সবুজ তুলসীচারা পর্যন্ত, কিন্ত কারুর শরীরেই মাটির স্পর্শ, মানুষের লালনের চিহ্ন নেই, সব নকল, সিন্থেটিক, রেডিমেড । যত তুচ্ছই হোক না, জীবনযাপনের বৃত্তে যেকোনো সাধারণ, ন্যূনতম ব্যবহারিক প্রয়োজন দেখলেই পণ্য সেখানে ঢুকে পড়বে তার ব্যয়-বিপণন-বাজারের কথোপকথন নিয়ে । ক্রমশ বিশ্লিষ্ট হতে হতে ব্যবহারিক প্রয়োজনের আবিষ্কারে নিজেকে আরো আরো ভেঙ্গে ফেলতে ফেলতে পণ্যের আগ্রাসন এমন চূড়ান্ত রূপ নিচ্ছে যাকে আমরা পারমাণবিক বিক্রিয়া রাসায়নিকের চক্রাবৃত্ত প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে তুলনা করতে পারি । এই আগ্রাসী পণ্যব্যবস্থাকে ক্রমাগত জায়গা করে দিতে, ক্রেতা মনোভাবকে প্রতিনিয়ত প্রভাবিত করতে সমান্তরালে থাকছে বিপণনের মনস্তাত্বিক কারখানা, অভ্রভেদী সংবেদনশীলতা । ক্রেতা মনস্তত্বে দ্রুত জায়গা করে নেওয়ার, তাকে বাজারের অনুকূলে বদলে দেওয়ার এই যে বিরাট আধুনিক কুশলতা বিপণন সেটাই এই নতুন পণ্যব্যবস্থার প্রাণভোমরা । বিপণনে যে টেক্কা দিতে পারল বাজার দখলে বিক্রয়ের শেয়ারে সেইই আগে থাকবে, । এই নব্য পুঁজিব্যবস্থা একই সঙ্গে বিশ্বায়িত এবং আঞ্চলিক (যেমন একটি বিশেষ ব্যাঙ্কের আত্মবিগ্যাপন, “ World’s Local Bank ”), একই সঙ্গে বহুজাতীক এবং বহুধাবিভক্ত, একই সঙ্গে মুনাফার সাংখ্যভাষার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং স্থান, দেশ, বাজার অনুযায়ী আঞ্চলিক লক্ষণে চিহ্নিত । ফলে উত্তরোত্তর ব্যবসায়িক চাহিদার সঙ্গে দূরসংযোগের প্রযুক্তি এবং তার বিবর্তন অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠল । গোটা তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পটাই বিশ্বায়িত রূপ পেল আধুনিক শিল্পসাম্রাজ্যের পরিচালনায় সবচেয়ে জরুরী হয়ে উঠল, সেতো এই বিগত ত্রিশ বছরেই, বহুজাতীক বিশ্বায়নের একেবারে সমান্তরালে । তথ্য প্রযুক্তির গুণে বিপণনের জন্যও খুলে গেল এক মুহূর্তে বিশ্বের যেকোনো ক্রেতার অন্দরমহলে পৌঁছবার অবারিত সড়ক । উতপাদন থেকে বিপণন, দূরসংযোগের বিবর্তন থেকে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি, নব্য পুঁজিব্যবস্থার এই চক্রাবৃত্ত প্রক্রিয়ার শেষবিন্দু হল ক্রেতা । আরো আকর্ষক বিপণন, ক্রেতাচাহিদাকে আরো নিখুঁতভাবে তুলে আনতে, চাহিদা এবং যোগানের সম্পর্ককে আরো দ্রুত এবং মসৃণ করে তুলতে জরুরী হয়ে পড়ল এই হাইটেক প্রযুক্তি, তথ্যশিল্পের সঙ্গে ক্রেতার পরিচয় ঘটানো, তাকে এই নতুন প্রযুক্তি বাস্তবতায় আভ্যস্ত করানো, উপরন্ত জরুরী প্রযুক্তিশিক্ষিত জনতার এক অগ্রসর অংশকে যা একই সঙ্গে হবে এই নব্য পণ্যব্যবস্থার প্রাথমিক ক্রেতা এবং মোটা মাইনের চাকুরে । এই পণ্যসভ্যতা তার সূক্ষ্মতায়, ভেদশক্তিতে, সম্মোহনে, সাবলীলতায় এতই প্রবল যে আধুনিক নাগরিকের জীবনযাপন-মনন, আকাঙ্খা, উচ্চাশা, অনুভূতির অন্তরস্রোত, সম্পর্কের বিন্যাসে ক্রমাগত পণ্যের কথোপকথন, তার বিক্রয়-বিপণনের কুহক জায়গা করে চলেছে এবং বিনিময়মূল্য, অর্থের সংখ্যাভাষা বদলে দিচ্ছে সমস্ত সামাজিক মূল্যবোধ, জীবন বদলে যাচ্ছে জীবিকার রুদ্ধশ্বাস গণিতে । এই পণ্য আর বিপণন নির্ভর নতুন সভ্যতায় যে আপাদমস্তক প্রদর্শনমুখর, আত্মকেন্দ্রিক, বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি মানুষের জন্ম হচ্ছে, জীবন-জীবিতের অন্য সমস্ত বোধ-সত্বাকে ছাপিয়ে যে মানুষের ক্রেতা সত্বাই সবচেয়ে প্রধান সামাজিক পরিচয় হয়ে উঠছে, বলার অপেক্ষা রাখে না সেই মানুষ নিজেকে, তার চারপাশের জীবন-জগত, আগামী সম্ভাবনাকে প্রতিনিয়ত বিচার করে চলবে এই আগ্রাসী পণ্যব্যবস্থার বৃদ্ধি-বিকাশে-মুনাফায়-বিপণনে কার কতটুকু অংশগ্রহণ তার নিরিখেই । শহরের নাগরিক বৃত্তে যেমন বেশ কিছুকাল যাবত প্রতিনিয়ত শোনা যাচ্ছে সরকারী সংস্থাকে বেসরকারীকরণ, বাজারীকরণের পক্ষে সওয়াল, শপিং মল থেকে দ্রুতগতির সড়ক-যোগাযোগ, সুলভ ভোগ্যপণ্য থেকে মোটা মাইনের কর্পোরেট চাকরী এই সবে প্রতিটি শহর আর তার জীবনযাত্রার আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছনোর উচ্চাকাঙ্খা । বহুজাতীক কোম্পানীতে ছেলের আরও বড় দায়িত্ব, সঙ্গে বিরাট পে-প্যাকেজ- বাসে পাশের সীটে মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি তার পরিচিতকে বলতে বলতে আহ্লাদিত, যুবতীর হাতে হাজার হাজার টাকার পোশাকের থলে আর তার থেকেও বেশী আত্মশ্লাঘা উষ্কে দিচ্ছে থলের উপরের সব বিখ্যাত ব্র্যান্ডনেম, এই দৃশ্যগুলো, তৃতীয় বিশ্বের যেকোনো দেশে এই নতুন আত্মগর্বী নাগরিক, তার সদ্য জন্ম নেওয়া ব্র্যান্ড-চেতনা, পণ্য-লালসা, পাশের লোককে পিছনে ফেলে, দরকার পড়লে তার বুকের ওপর পা রেখে এগিয়ে যাওয়ার ঊর্ধটান আজ কত সুলভ, কত নিয়মিত ! আর পৃথিবীর অপর প্রান্তে, গোটা পণ্যসভ্যতার উতস ও বিকাশ যেখানে, সেই আমেরিকা-ইউরোপে যে এই পণ্যব্যবস্থা ক্রমাগত নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে তার মূলেও তো এই ক্রেতা-নাগরিক যে পণ্য আর তার কুহকী বিপণনে ইতিমধ্যে ক্লান্ত, কোনো নতুন ব্যবহারিক সুবিধা, সামাজিক উচ্চতার চিহ্নই আর তার মধ্যে ভোগ্যপণ্যের প্রতি কোনো উতসাহ তৈরি করতে পারছে না, সে এই পণ্যব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করছে ক্লান্ত এবং নিতান্ত অভ্যাসবশত অথবা নেহাতই পরিবর্ত কিছু নেই বলেই । আমেরিকায় অবস্থাটা এখনও ততটা উদ্বেগজনক না হলেও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ক্রমাগত কমে আসছে ভোগ্যপণ্য ব্যবহারের মাত্রা , কর্মক্ষেত্রে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কর্মবিরতি, ছুটি, ভ্রমণ, অবকাশ যাপনের দিন , স্বেচ্ছা আর শীঘ্র অবসরের চাপে কমে আসছে কর্মীসংখ্যা, ব্যয়বহুল হয়ে উঠছে উতপাদন, আর একসময় রোজগেরে নাগরিক তৈরি করতে যে বিচ্ছিন্ন, সুখী, ক্ষুদ্র পরিবারের ভাবনায় সরকার উতসাহ যোগাত আজ তাই হয়ে উঠল গোটা ইউরোপের পণ্যব্যবস্থায় কর্মী সংকটের প্রধান কারণ, কেননা প্রজনন আর মৃত্যুর হার দুইই এত কম যে অচিরেই বয়স্ক নাগরিক, অবসরপ্রাপ্তের সংখ্যা বাকি জনসংখ্যাকে ছাপিয়ে যাবে । পণ্যঅর্থনীতির এই সংকটে যেকোনো নাগরিক পরিষেবা, ন্যূনতম নাগরিক সুযোগ সুবিধার গ্যারান্টী, বিভিন্ন সরকারী ভর্তুকী, কর্মক্ষেত্রে সরকারী নিয়ন্ত্রণ, এককথায় যেসব জনমুখী ব্যবস্থা যেকোনো উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশের বৈশিষ্ট্য, সেগুলোও হয়ে উঠছে ব্যয়বহুল দায়ভার, সরকার নিস্কৃতি চাইছে দায়িত্ব আর ব্যয়ের এই উভয় সংকট থেকে, আর আরো প্রসারণ, আরো বেশী অংশীদারিত্বের জন্য, তার বিরাট বিপণন মঞ্চে সমস্ত নাগরিক সুবিধাকে নির্দিষ্ট মূল্যে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে দিতে এই বাজার আরো বেশী কর্তৃত্ব চাইছে, যা সে অনুন্নত তৃতীয় বিশ্বে বরাবর পেয়ে এসেছে । ফলে তৃতীয় বিশ্বের সচ্ছল নাগরিক যাতে প্রলুব্ধ এবং আহ্লাদিত, সেই বেসরকারীকরণ, বাণিজ্যিকিকরণের বিরুদ্ধে ইউরোপ-আমেরিকায় মানুষ ক্রমশ সোচ্চার হচ্ছেন । ধনকুবের বাণিজ্যিক শ্রেণীর পাশাপাশি ক্রমশ পায়ের তলা থেকে সামাজিক সুবিধার নিশ্চয়তা হারানো প্রথম বিশ্বের সচ্ছল নাগরিক, আগ্রাসী পণ্যসভ্যতার নতুন চাহিদার সামনে ক্রমশ অতিরিক্ত, উচ্ছিষ্ট হতে চলা তৃতীয় বিশ্বের হতদরিদ্র গ্রামীণ জনতা আর এই নতুন বহুজাতীক পণ্যব্যবস্থার একেবারে সামনের সারিতে তৃতীয় বিশ্বের সচ্ছল, উচ্চাকাঙ্খী নাগরিক – এই নতুন ব্যবস্থায় আর্থসামাজিক শ্রেণীগুলো, তাদের ভেতরকার দ্বন্দ্বগুলো আমূল বদলে গেল । শোষণ সম্পর্কের উল্লম্ব উপর-নীচ কাঠামো আর রইল না, বরঞ্চ তা অনেক বেশী আনুভূমিক এবং বিস্তৃত আকার নিল । এই জটিল, বহুস্তরীয়, ক্রমাগত নতুন স্রোতে দিক বদলানো আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় কখনো প্রযুক্তি হয়ে ওঠে নিয়ন্তা তো কখনো আন্তর্জাতিক বাজারে মুদ্রার দামের ওঠানামা, ইউরোপের কোনো দেশে মুদ্রা সংকটের জেরে আমাদের ক্রেতা চাহিদায় ভাটা আসতে পারে, কখনো বিশ্বের একপ্রান্তে রাজনৈতিক ক্ষমতার দ্বন্দ্ব আন্তর্জাতিক জ্বালানীর সংকটে বদলে যাবে, আবার কখনো ধনী রাষ্ট্রজোটের অর্থনৈতিক অবরোধের জেরে বিশ্বের কোনো প্রান্তে রপ্তানীতে আসবে মন্দা, কখনো এক দেশে সস্তা প্রযুক্তি শ্রমিকের বাড়বাড়ন্ত অন্য দেশে তৈরি করবে বেকারী । আর এই নতুন আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় ক্রমশ গুরুত্ব পাচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য, দূষণের মতো আপাত প্রান্তিক বিষয়গুলো। ক্রমশ চরম হয়ে ওঠা জলসংকট, খরা, বন্যা বা জ্বালানী সম্পদের অপ্রতুল হয়ে ওঠা এই বিষয়গুলো আর নিয়মিত প্রাকৃতিক দূর্যোগের মতো উপেক্ষিত থাকছে না , অন্তিম বিপদসংকেতের মতো উন্নয়ন, নগরায়ন, মুক্ত বাজারের আলোচনায় ঘুরে ফিরে আসছে । সঙ্গে এই নতুন পণ্যব্যবস্থা, বিশ্ববাজারের সমান্তরালে উঠে আসছে, সমস্ত আন্তর্জাতিক নিয়ম-কানুনকে ফাঁকি দিয়ে ক্রমাগত শক্তিশালী হয়ে উঠছে অন্ধকার জগতের চোরা বাণিজ্য, মাফিয়া অর্থনীতি । এশিয়া, লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকার অনেক দেশের মূল বাণিজ্যবস্তু হয় মাদক নয়তো বেআইনী অস্ত্র, অথবা পেটেন্ট আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখানো নকল বিলাসপণ্য । অস্বীকার করা যাচ্ছে না, কঙ্গো থেকে কলম্বিয়া বা আফগানিস্তান থেকে বার্মায় এই চোরাগোপ্তা অর্থনীতি অনেকটা গেরিলা যুদ্ধের কায়দাতেই আগ্রাসী বহুজাতীক পণ্যকে ঠেকিয়ে রেখেছে । আর এই সমান্তরাল তথাকথিত কালো অর্থনীতির ওপর দাঁড়িয়েই মাথা তুলছে একের পর এক কট্টর গোষ্ঠী আন্দোলন, জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম, বহুজাতীক বিশ্ববাণিজ্যের কেন্দ্রে আঘাত হানার অভিনব পদ্ধতি । যে দ্বন্দ্বকে একসময় দেখা যেত সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে মানুষের জাতীয়তা, আত্মনির্ভরতার দ্বন্দ্ব বলে আজ দেশে দেশে বিশ্বপুঁজির অংশীদারিত্বের যুগে সেই দ্বন্দ্বের চেহারাটা বদলে গেল । পণ্যের চেহারায় যেমন উত্তরোত্তর ধরা পড়ছে অঞ্চল বিশেষের চাহিদা , তেমনি মানুষের ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের সঙ্গে, তার আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অধিকারবোধের সঙ্গে এই পণ্য-বাজার ব্যবস্থার দ্বন্দ্বটাও হয়ে উঠছে বহুধাবিদীর্ণ, আঞ্চলিক । এই নতুন বাস্তবতায় আর্থ-সামাজিক শ্রেণীগুলির চরিত্র এতটাই পালটে গেছে যে আগেকার তথাকথিত মার্ক্সীয় শ্রেণীসংগ্রাম আজ আর শ্রমিকশ্রেণীকে সেভাবে উদবুদ্ধ করতে পারছে না । ফলে সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের লড়াই, সমাজতান্ত্রিক সমাজের স্বপ্ন নেহাতই আদর্শ রয়ে যাচ্ছে, সমকালীন বাস্তবতায় যা নিজেকে নতুন পরিপ্রেক্ষিতে দেখতে পারছে না । নতুন ধারার পণ্যসমাজে মানুষ যতটা না শ্রেণী ও সমাজের স্বার্থের অংশীদার তার থেকে অনেক বেশী তার আত্মসচেতন ক্রেতাস্বার্থ, বিপণন আর উচ্চাকাঙ্খা সম্বল পেশাস্বার্থ । আবার যারা এই পণ্যবাজারের ক্রেতা হয়ে ওঠা তো দূর এমনকি যাদের ন্যূনতম ভরণ-পোষণের নিত্য লড়াইটা এখনও রয়ে গেছে প্রাক-পুঁজিবাদী সামন্ততান্ত্রিক স্তরে, যারা বিশ্ববাজারের আগ্রাসনের সামনে ক্রমাগত উচ্ছিষ্ট, উদবাস্ত হয়ে চলেছে সেই অনাহার-অর্ধাহার আখ্যায়িত তৃতীয় বিশ্বের গ্রামীণ জনতা, তার অন্ত্যজ, ভূমিজ, গোষ্ঠীবব্ধ জীবনের মূল্যবোধ আজকের সমাজভাবনায় নিয়ে আসছে নতুন পরিপ্রেক্ষিত । আধুনিক মানুষের সম্পূর্ণ বিপরীতে পরিবেশ-প্রাণীজগতের সঙ্গে তার আচরণে পারস্পরিক মমতা, নির্ভরতার সম্পর্কই প্রধান । রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের লড়াই বা বিপ্লবী মতবাদে যে সমানাধিকারের দর্শন, সে কাদের সমানাধিকার, তারও আগে কিসের অধিকার, কে অধিকৃত ? প্রকৃতি-প্রাণীজগতকে আধুনিক সভ্য মানুষ যে ব্যবহারকারীর আস্ফালন, লালসা নিয়ে দেখে , তার সমস্ত আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক দর্শনের ভেতরে যে এই ব্যবহারিক কর্তৃত্বই কাজ করে, এই নতুন পরিপ্রেক্ষিত তাকেই তুলে আনছে । সমান্তরালে পশ্চীমী বিশ্ব যা এই পণ্যসভ্যতার গোটা বিবর্তনটার প্রথম এবং প্রধান অংশীদার, সেখানে আজ মানুষ পণ্যের কুহকী কথোপকথনে ক্লান্ত , তার বিচ্ছিন্ন একক ক্রেতা স্বত্ত্বা, পেশাদারী অস্তিত্ব নিজেকে অতিক্রম করে খুঁজে পেতে চাইছে সহজ পরম্পরার জীবনরীতি , ইতিমধ্যে বিরাট রাজনৈতিক-সামাজিক প্রগতির ধারণায় তার ধ্যানভঙ্গ হয়েছে , তার মনন নিবিষ্ট হয়ে ব্যাখ্যা খুঁজছে একেকটি ব্যক্তি, আঞ্চলিক জনজাতির সামাজিক লক্ষণে , তার নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যে , হয়ে ওঠার ইতিহাসে ।


এই নতুন বহুজাতীক এবং বহুধাবিভক্ত পণ্য, বাজার, বিপণনের যুগে মানুষ, তার সমাজ, সংস্কৃতি, সমাজকে দেখবার এই যে পরিপ্রেক্ষিতের বদল, তথাকথিত রাজনৈতিক মুক্তিসূর্যের স্বপ্নভঙ্গের পরে এই যে শেকড়ে ফেরার প্রয়াস হয়ত তারই সূচনা উত্তরআধুনিকের জীবন ও সমাজের দর্শনে।
কিন্ত এই বহুমত, পথে ক্রমাগত বিশ্লিষ্ট, বহুস্তরীয়, যেকোনো চিহ্নিত চিন্তাব্যবস্থা, অভিধা অতিক্রম করতে চাওয়া এই ধ্যানভঙ্গ মননও কি পণ্যের কথোপকথন থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারছে ? সন্দেহ নেই, উত্তরআধুনিক চিন্তায় মননে নতুন পণ্যব্যবস্থার লক্ষণগুলো স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ছে কিন্ত এই নতুন ধারার সমসাময়িক মননকে যারা শুধু নব্য পুঁজিব্যবস্থার বৈধতার সামাজিক সাংস্কৃতিক কথোপকথন হিসেবে দেখতে চাইছেন তারা দেখতে পেলেন না এই নতুন ধারার সামাজিক মননে ব্যবহারিক মূল্যবোধের সংকট, অভুতপূর্ব সমপর্ক মূল্যের ঈশারা, যেকোনো আর্থ-সামাজিক চিন্তায় প্রকৃতি-পরিপ্বেশ-মানব সমপর্কের অন্তর্ভুক্তি, যেকোনো জনজাতিকে শুধুমাত্র আর্থিক-রাজনৈতিক অতিকাঠামোর নিরিখে দেখবার পরিবর্তে সেই জনজাতির বিশেষ সামাজিক আচরণ, মুল্যবোধ, তার পুরাণ,ধর্মাচরণ, এককথায় তার বিশেষ সামাজিক মনস্তত্ত্বের ব্যখ্যায় ঝোঁকবদল । ছত্তিসগড়ের অনেক আদিবাসী গ্রামেই যেমন গাই-মহিষের দুধ দোয়ানোর রীতি নেই, কারণ ওদের প্রজন্মলালিত বিশ্বাস ‘ও দুধ মানুষ খেলে বাছুর খাবে কি’? প্রকৃতি, পরিবেশ, প্রাণীকুলের অবদমন, তার যথেচ্ছ ব্যবহারের ওপর দাঁড়িয়ে আছে যে পুঁজিবাদী এবং মার্কসীয় উন্নয়ন চিন্তা (অবশ্যই ভিন্ন ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে) তার চ্যালেঞ্জটা প্রথমত আসছে সভ্যতার এই প্রান্তিক মানুষদের কাছ থেকেই । সামাজিক সন্দর্ভে প্রান্তবাসী, তথাকথিত অসভ্য মানুষের জীবনবোধ, পরিবেশ গ্যানের এই অন্তর্ভুক্তিটা ক্রমশ উন্নয়ন, শিল্পায়ন এইসব বিতর্কে আর্থিক বৈষম্যের বাইরে নতুন পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে আসছে । কিন্ত যেখানে উত্তরআধুনিকেরা মার্কসীয় মহাআলেখ্যর যুক্তি খন্ডন করতে গিয়ে আঞ্চলিক ক্ষমতার সন্দর্ভে উত্তর খুঁজছেন, বিশ্বপুঁজির মহাআলেখ্যের বিপরীতে ঘটমান বিভিন্ন আঞ্চলিক প্রতিরোধের সাধারণ যোগসূত্র দেখতে চাইছেন না সেখানেই প্রকাশ হয়ে পড়ছে সমসাময়িক পণ্যব্যবস্থার প্রতি তাদের দূর্বলতা, বিশ্বায়নের মহাআলেখ্যর প্রতি পক্ষপাত ।

পশ্চিমী বিশ্ব থেকে তৃতীয় বিশ্বের নাগরিক বৃত্ত পর্যন্ত যে নব্য মিডিয়া-বাস্তবতা, সমস্ত ঘটমানতা, তার বিবৃতির মধ্যে যে অন্তর্দেশীয় যোগাযোগ, যে হাইটেক দুরসংযোগের অন্তর্জাল তা একদিকে যেমন হয়ে উঠছে বিশ্বপুঁজি, তার পণ্যব্যবস্থার প্রচার-সংযোগ, বিপণন-বিগ্যাপন, জনসম্মতি তৈরির প্রধান মাধ্যম, একইসঙ্গে তার একটা অন্যতর সামাজিক অর্থবহতা তৈরি হচ্ছে, যেখানে কোনো না কোনোভাবে মিডিয়ার হাত ধরে ক্ষমতাবিরুদ্ধ নাগরিক মতামত বিনিময়ের একটা স্বতন্ত্র পরিবেশ তৈরি হচ্ছে অথবা তার সচেতন গ্রাহক জনতার দাবি মেটাতে এবং অবশ্যই আধূনিক সংযোগ প্রযুক্তির গুণে মিডিয়া সংবাদে ক্রমশ জায়গা করে নিচ্ছে পুঁজি এবং তার অনুসারী রাজনৈতিক-প্রশাসনিক-ব্যবসায়িক-সামাজিক ক্ষমতার সঙ্গে জনমতের বিরোধ-সংঘর্ষের খবর । অবশ্যই মিডিয়ার একমুখী ফোকাস, সামাজিক বিষয়কে অন্যান্য ব্যবহারিক পণ্যের মত ব্যবহার, এই প্রশ্নগুলো থাকছেই কিন্ত অস্বীকার করা যচ্ছে না যে ভিন্নমত, বিরুদ্ধ কন্ঠস্বরের জন্য আজকের মিডিয়া বাধ্য হচ্ছে অনেক জায়গা ছাড়তে, ক্ষমতার সঙ্গে জনমতের কথোপকথনের উদ্যোগটা তাকে নিতে হচ্ছেই, কারণটা শুধুই ব্যবসায়িক স্বার্থ হয়ত নয়, বরঞ্চ আর্থ-সামাজিক স্থিতিজাড্যের সঙ্গে সে যেকোনো প্রতিরোধের একটা সমঝোতার রাস্তা করে দিতে চাইছে । ফলে মিডিয়ার এই মধ্যস্থতায় যেকোনোদিন যেকোনো বিরুদ্ধ কন্ঠই পৌঁছে যেতে পারে, জনসম্মতি অর্জনের কর্পোরেট-সরকারী মিডিয়া সংযোগকে সম্পূর্ণ বিপরীত অর্থে এবং অবশ্যই ভিন্ন মাত্রায় যেকেউ পারে ব্যবহার করতে । সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামে কর্পোরেট-সরকারী ক্ষমতার সন্ধি আর তার একরোখা ফ্যাসিস্ত সন্ত্রাসকে আমাদের নাগরিক সমাজ যেভাবে দলমতের ঊর্ধে উঠে প্রশ্ন করল, যেভাবে মিডিয়ার একটা বৃহত অংশকে এই নাগরিক বিক্ষোভের সুরে গলা মেলাতে হল তা অবশ্যই গণআন্দোলনের মিডিয়াক্ষেত্র ব্যবহারের এক নতুন দৃষ্টান্ত । কিন্ত আমাদের বিপ্লব প্রচেষ্টার, জনআন্দোলনের শরিকরা ? তারাও কি মিডিয়াকে এইভাবে দেখছেন বা মিডিয়ার এই নতুন সর্বত্রগামী চরিত্রকে তারাও কি এইভাবে ব্যবহারের কথা ভাবছেন নাকি তারা নেহাতই প্রতিনিয়ত খবরে আসতে চাইছেন আর তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ভার ছেড়ে দিতে চাইছেন মিডিয়ার বিপণনের হাতে ? এই ব্যবহার-কুশলতার প্রশ্নটিই আজকের সমস্ত জনপ্রতিরোধ, গণআন্দোলনের সাম্প্রতিক মাত্রা । নতুন মিডিয়া পরিবেশে কারিগরী-প্রযুক্তি-ব্যবহারবোধ-বিপণনের প্রতিনিয়ত পরিবর্তনের সঙ্গে যেকোনো জনমত কতটা সঙ্গতি রাখতে পারছে, এই নতুন মিডিয়া পরিবেশকে নিজের অনুকুলে ব্যবহারের জন্য সে প্রতিনিয়ত প্রস্তত থাকতে পারছে কিনা তার ওপরই নির্ভর করছে বৃহত জনসম্মতি, ক্ষমতার ভাষ্যকে চ্যালেঞ্জ করার নাগরিক প্রশ্রয় ।

রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সঙ্গে যেকোনো গণআন্দোলন-বিক্ষোভ-বিদ্রোহের সংঘর্ষে আজ সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব পাচ্ছে মানবাধিকারের প্রশ্নটি । পৃথিবীর যেসব দেশে ন্যূনতম প্রয়োজনীয় জীবনযাপনসামগ্রীর নিরাপত্তা, চাকরী বা চাকরীর অবর্তমানে বেকারভাতার ব্যবস্থা সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত সেখানে মানবাধিকারের প্রশ্নটিকে মূলত স্বাধীন মতামত প্রকাশ, মুক্ত সামাজিক-রাজনৈতিক আচরণের অধিকার, যেকোনো অপরাধে আত্মপক্ষ সমর্থন, আত্মরক্ষার অধিকার এইসব নিরিখেই ভাবা হয় । মুশকিল হল, আমাদের মত দরিদ্রপ্রধান, পিছড়ে বর্গের দেশেও মানবাধিকারের সংগ্যাটি এই পশ্চিমী, বিত্তবান দেশের মতই রয়ে গেল, আমাদের মানবাধিকার চর্চা নেহাতই মুক্তভাষ্য, মুক্তআচরণের অধিকারের দাবি বা আইনী অধিকারের দাবিতেই সীমাবব্ধ রইল । আমাদের মানবাধিকার কর্মীরা কেন তুলতে পারলেন না খাদ্যনিরাপত্তা, শিক্ষা, চিকিতসা, বাসস্থান বা কাজের গ্যারান্টীর মতো জরুরী অধিকারগুলোর সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবি, সেকি এই জন্য যে আমাদের মানবাধিকার আন্দোলনের প্রথম সারীতে যে সচেতন নাগরিক মুখ, সে মূলত আর্থ-সামাজিকভাবে নিরাপদ শ্রেণীর প্রতিনিধি ? সত্যিই তো, যেখানে কোনো বিপ্লব প্রচেষ্টার স্লোগান নেই, বিক্ষোভ নেই, বিদ্রোহ নেই, পুলিশী সন্ত্রাস বা সিআরপিএফের পেট্রোলিং নেই কিন্ত চূড়ান্ত খাদ্যসংকট, অপুষ্টি, অকালমৃত্যু এর প্রত্যেকটিই আছে এবং প্রবলভাবেই থেকে আসছে সেই ব্রিটিশ ভারতেরও আগের রাজরাজড়ার আমল থেকে, যেখানে মানুষ এখনও খাদ্যসংগ্রহের আদিম জৈব প্রয়োজনটিকেই পেরিয়ে উঠতে পারেনি সেখানে খাদ্যনিরাপত্তাই তো সবচেয়ে প্রাথমিক মানবাধিকার । যেকোনো জনবিক্ষোভ বনাম রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের দ্বৈরথে আমদের মানবাধিকার আন্দোলন যে সদর্থক ভূমিকা রাখছে তার আজ আরো প্রসারণ জরুরী, আপাত শান্ত, নিরুপদ্রব অভাবের সন্ত্রাস যাকে ক্ষমতার প্রাতিষ্ঠানিক সন্দর্ভ গ্রাহ্য করে না তাকে আমাদের মানবাধিকার ভাবনা কি একইভাবে উপেক্ষা করতে পারে ?

অধুনান্তিক সংস্কৃতি ভাবনা যখন বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক রূপের উচ্চনীচ স্তরভেদকে অস্বীকার করতে চাইছে, বৈগ্যানিক সভ্যতার যুক্তিসাম্রাজ্যের বাইরে পড়ে থাকা পৃথিবীর বিভিন্ন আদিবাসী জীবনসংস্কৃতি, তার প্রকৃতি-পরিবার-যৌথ সমাজের বিনিময়মূলক সংহতি (আধুনিক শিল্পসভ্যতার আগ্রাসনের সামনে বহু বিকলাঙ্গতা সত্ত্বেও যা এখনও অনেক বোধ-বিশ্বাস-আচরণের ভিতর টিঁকে আছে) যখন পণ্য এবং বিপণনজর্জর ছিন্নমূল নাগরিক জীবনবোধের বিপরীতে কোনো বিকল্প জীবনরীতির সন্ধানপথ হয়ে উঠছে তখন এই অধুনান্তিক অবস্থান অবশ্যই হয়ে উঠছে যেকোনো আর্থ-সামাজিক বিকাশের ভাবনায় সবচেয়ে জরুরী সংযোজন । কিন্ত পণ্যের সংলাপও যেকোনো প্রান্তিক বোধ-বিশ্বাস-কারিগরী-কুশলতা-জীবনপ্রণালীকে তার বিপণন প্রক্রিয়ার অন্তর্গত করে নিতে ততটাই ততপর । আর পণ্যের সংলাপের ধরণই হল সে সবকিছুকেই তার নিহিত গুরুত্ব, অন্তর্মূল্য থেকে বাজার মূল্যে নামিয়ে নিয়ে আসবে, আজকের বিপণন পরিবেশে সবকিছুকেই সমান্তরালে পরিবেশন করা যেতে পারে, সবকিছুই হতে পারে গ্রাহক আকর্ষণের সামগ্রী, চমকপ্রদ প্রদর্শনের বিষয় । বাজারের নিয়ন্ত্রক ক্ষমতার আওতায় আইপড্‌ থেকে সমাজভাবনার পত্রিকা, খেলোয়াড়ের স্বাক্ষর করা টিশার্ট থেকে সাঁওতাল তীরধনুক, বাঁকুড়ার মৃতশিল্প, হিমাচলী কাংড়া পট থেকে শুরু করে অর্থনীতিবিদের সেমিনার, ছত্তিসগড়ের জঙ্গলে ভূমিজ মানুষের জীবনশৈলী, যেকোনো কিছুই আসতে পারে, বিপণন আর বাজার মূল্যের ভিন্নতা নিয়েই, কিন্ত কেউ এড়িয়ে যেতে পারে না বাজারের এই সমান্তরাল পরিবেশনকে । অধুনান্তিক ভাবনায় যখন নাগরিক আবাসনরীতি, থিমপার্ক, সেক্স ট্যুরিজম্‌, ফ্যাশানশিল্প, ইন্টারনেট ক্লাব এইসমস্ত বিনোদন-জীবনযাপন শৈলীর পাশাপাশি, একই গুরুত্বে প্রান্তিক, ভূমিজ মানুষের প্রাকৃত জীবনধারা স্থান পাচ্ছে, তখন আমরা টের পেতে শুরু করি এই গুরুত্বের স্তরভেদ, অন্তর্মূল্যকে খারিজ করার পেছনে বাজারের স্বয়ংক্রিয়তা, সমান্তরাল বিপণনের পণ্যসংলাপ ।

উত্তরআধুনিক সমাজচিন্তায় যখন প্রত্যেকটি আঞ্চলিক সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলন-সংঘর্ষ-প্রতিরোধকে রাজনৈতিক ক্ষমতালিপ্সার অতিকাঠামো বা মতবাদের সমগ্রতায় দেখার পরিবর্তে সেই অঞ্চলের নির্দিষ্ট সামাজিক ইতিহাস, ক্ষমতার সমীকরণ, বিকাশের ভাবনা, সেই অঞ্চলের নিজস্ব সংস্কৃতি, প্রজন্মলালিত বোধ-বিশ্বাসের জগত, এইসব আঞ্চলিক পরিপ্রেক্ষিত থেকে দেখার কথা বলা হচ্ছে তখন এই বিভিন্নতা, বিশিষ্টতাকে মর্যাদা দেওয়ার দর্শন অবশ্যই পুঁজিবাদী উন্নয়ন বা আমাদের দেশে উন্নয়নের নামে ভাড়াটে পুঁজির আগাসনের বিপক্ষে একটা স্পষ্ট সামাজিক অবস্থান নিচ্ছে । ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে, উন্নয়নের সূচকে পিছনে থাকা গ্রামীণ ভারতের বহু জায়গায় কারুশিল্প, প্রাকৃতিক উপকরণে বানানো নানাধরণের হাতের কাজ, চিরায়ত অঙ্কন বা গৃহস্থালীর নানা প্রয়োজনের জিনিস বানানোর কুটীর শিল্প ইত্যাদি অনেক প্রজন্ম ধরে চলে আসছে । সরকারী সদিচ্ছা যদি এইসব সামগ্রীকে আধুনিক বিপণন বা উতপাদন পরিকাঠামোর সুবিধা দিতে পারত (এক্ষেত্রে শিল্পসমবায়ের ভাবনাটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক), তাহলে কি উন্নয়নের ধারণা আরো অংশগ্রহণমুলক হত না ? অথবা ফল-প্রক্রিয়াকরণ শিল্প ফল উতপাদকদের নিজেদের গ্রাম বা তহশীলেই তো হতে পারে, বাগিচামালিকদের যৌথ স্বত্তে, সরকারী উদ্যোগে কারিগরী-যন্ত্রপাতি আর বিপণন সহায়তায় ? উত্তরআধুনিক ভাবনায় এই অঞ্চলবিশেষের নিজস্ব দৃষ্টিকোণ কর্পোরেট-সরকারী উন্নয়নবাণিজ্যের সামনে নিয়ে আসছে নতুন চ্যালেঞ্জ । কিন্ত যাবতীয় আর্থ-সামাজিক সংকটের উত্তর শুধুমাত্র আঞ্চলিক বিভিন্নতার সংলাপে খুঁজতে গিয়ে উত্তরআধুনিক চিন্তা অনেক সময়েই আগ্রাসী বিশ্বায়নের সাধারণ যোগসূত্রকেই আড়াল করে ফেলছে । উত্তরআধুনিক পশ্চিমী চিন্তকদের একটা বড় অংশই এই আঞ্চলিক বিশিষ্টতার মুখোমুখি আগ্রাসী বাজার অর্থনীতি, বিশ্বপুঁজি, বিশ্বায়নের মহাআখ্যান নিয়ে বিস্ময়করভাবে নীরব । বিস্ময়কর, কেননা সমাজচর্চার এত ব্যাপক, বহুধাবিদীর্ণ পথ পেরিয়ে এসে তার মনীষা সমস্ত মহাআখ্যানের কর্তৃত্বকে নাকচ করছে অথচ বিশ্বায়িত পণ্যব্যবস্থার সর্বোময় কর্তৃত্বের প্রতি তার কোনো প্রশ্ন নেই । এটা কি রাশিয়া, পূর্ব ইউরোপের অভিগ্যতার পরে মার্কসীয় হতাশা ? নাকি তৃতীয় বিশ্বের লুটেরা বিনিয়োগ আমার স্বচ্ছলতা নিশ্চিত করে এই স্বার্থবোধের
আনুগত্য ?

নর্মদা বাঁচাও আন্দোলনের মঞ্চ থেকে যখন নদীর জল, বনাঞ্চল ইত্যাদি প্রাকৃতিক সম্পদকে নাগরিক পণ্যসভ্যতার চাহিদা মেটাতে যথেচ্ছ ব্যবহারের পরিবর্তে প্রকৃতি-মানুষ-প্রাণীকুলের ভারসাম্যমূলক জীবনধারার উপর জোর দেওয়া হয়, মেধাজী (মেধা পাটেকর)যখন নগরসভ্যতার লালসাসাম্রাজ্য, তার আগ্রাসী ব্যবহারবোধের বিপরীতে নর্মদা নদীতীরের ভূমিজ, আদিবাসী মানুষের প্রকৃতির সঙ্গে আদিম প্রজন্মলালিত সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেন, তখন আমরা পুঁজিবাদী পণ্যমূল্য বা মার্কসীয় দর্শনের বিশুদ্ধ ব্যবহারমূল্যকে অতিক্রম করে অন্য বিকল্পের সন্ধান পাই । দেরিদা তাঁর ‘স্পেক্টর অফ্‌ মার্কস’ গ্রন্থে পুঁজিবাদী পণ্যমুল্যের শিকড় খুঁজলেন বস্তর ব্যবহারমূল্যের ভেতর, প্রশ্ন করলেন মার্কসীয় ব্যবহারিক মূল্যবোধের নৈতিকতাকে, পণ্যের শোষণসম্পর্কের উতস হিসেবে উঠে এল বস্তজগতের সঙ্গে মানুষের নিছক ব্যবহারিক প্রয়োজনের সম্পর্ক । দেরিদা কোথাও স্পষ্ট উল্লেখ করলেন না কিন্ত আধুনিক সামাজিক দর্শনের পরিপ্রেক্ষিতে নতুন মূল্যবোধের ইঙ্গিত পাওয়া গেল, পুঁজিবাদী পণ্যমূল্য বা মার্কসীয় ব্যবহারমূল্যের পরিবর্তে মানুষ-প্রকৃতি-বস্তজগতের পরিপূরক সম্পর্কমূল্য । এই সম্পর্কমূল্যের আভাস আমরা অনেককাল আগে সেই ঊনবিংশ শতকে ফরাসী দার্শনিক মিশেলের লেখায় পাই যখন মিশেলে কৃষকের সঙ্গে কৃষিজমির সম্পর্ককে স্বা্মী-স্ত্রীর সম্পর্কের সঙ্গে তুলনা করেন (এই তুলনায় অবশ্যই পিতৃতান্ত্রিক দ্যোতনা আছে কিন্ত মিশেলের তুলনা, এই সম্পর্কের অনপুঙ্খ, মেদুর বিবরণের আসল প্রাণভোমরা কৃষিজমির সঙ্গে কৃষকের পরিপূরক টান, ব্যবহারবোধের অতিরিক্ত রোম্যান্টিকতা)। আর আমাদের প্রাচ্যে, যেকোনো আদিবাসী, ভূমিজ মানুষের জীবনে জল-জমি-জঙ্গল-পশুপালনের একাত্ম সম্পর্কের ইতিহাস অনেক প্রাচীন, সামন্ততান্ত্রিক শোষণসম্পর্কের পাশাপাশি যা বরাবর ভূমিজ জীবনের সমান্তরাল আখ্যান, অথচ আমাদের মার্কসবাদী বিপ্লবী সমাজচিন্তায় কখনো এই আদিম সম্পর্কের ইতিহাস আমল পেলনা । আসলে মার্কসবাদী বিগ্যানচিন্তা, যুক্তিবোধের ভেতরেও সেই পণ্যশিল্পসভ্যতার আগ্রাসী ব্যবহারিক মূল্যবোধ, প্রকৃতি-প্রাণীকুলের উপরে মানুষের সর্বোময় কর্তৃত্বের দর্শন । উদবৃত্ত মূল্য বা বাজারব্যবস্থার অবলুপ্তি, আর্থ-সামাজিক সমানাধিকার এই জরুরী সন্দর্ভগুলোর বাইরে সোভিয়েত রাশিয়া থেকে চীন মার্কসীয় সমাজবীক্ষা উতপাদনের পেশীশক্তি, তার সুষম ব্যবহারের প্রায়োগিক ধারণার মধ্যেই সীমায়িত রইল । এই পরিপ্রেক্ষিতে অরুন্ধতী রায়ের সন্দিহান অবস্থান অত্যন্ত সদর্থক যখন তিনি প্রশ্ন তোলেন প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহারে বিপ্লবী অবস্থান নিয়ে “ওদের খনিজসম্পদ ব্যবহারের নীতি কি (বর্তমান)সরকারী নীতি থেকে খুব আলাদা হবে ? ওরা কি (পাহাড়ের)বক্সাইটকে পাহাড়েই ছেড়ে দেবে ?” যেকোনো সমাজবিপ্লবের দর্শন যতক্ষণ ব্যবহারিক মূল্যবোধকে অতিক্রম করে প্রকৃতি-জীবনের পরিপূরক সহাবস্থানের মূল্যবোধ অন্তর্গত করে নিতে না পারছে ততক্ষণ এই সন্দেহটা থাকছেই ।

সমস্ত সন্দেহ, প্রশ্নচিহ্ন, অভাববোধের পরেও যা আমাদের নাগরিক মননকে প্রতিনিয়ত জেরবার করছে তা আমাদের দায়বদ্ধতার প্রশ্ন, যেকোনো বিরুদ্ধ মতামতকে সন্ত্রাসবাদী চিহ্নিত করা দমনমূলক রাজনৈতিক-প্রশাসনিক ব্যবস্থার বিপরীতে আমাদের অবস্থানের প্রশ্ন, ভূমিজ, আদিবাসী জনজাতির উপর বিশ্বায়ন এবং তার দেশীয় প্রতিনিধিদের ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের সামনে আমাদের সুবিধাভোগী নাগরিক অস্তিত্ত্ব কোন পক্ষ নেবে সেই প্রশ্ন । কোনো সন্দেহ নেই ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে আজকের আদিবাসী গণবিক্ষোভ একটি বিশেষ বিপ্লবী রাজনৈতিক মতাদর্শের দ্বারা প্রভাবিত আর যারা সেই আর্য রাজতন্ত্র থেকে ব্রিটিশ শাসন হয়ে আজ পর্যন্ত কখনো অস্পৃশ্য, কখনো ভূস্বামীর ক্রীতদাস বা স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে বনদফতর-কন্ট্রাক্টর-বড় জমি মালিক-প্রশাসনিক কর্তাদের লুটের সামগ্রী আর সাম্প্রতিক কালে বড় শিল্পোদ্যোগ বা খনির জন্য যাদের মাথার ওপর ঝুলছে ভিটেমাটি ছেড়ে উদবাস্ত হওয়ার সরকারী পরোয়ানা, এই চিরঅবহেলিত মানুষেরা আজ যদি ব্যবস্থাটাকে নিজেদের অনুকূলে বদলাবার স্বপ্ন দেখে, সেটাই তো স্বাভাবিক । যারা কমিউনিষ্ট একপার্টি-একমতের শাসনের বিপদ দেখিয়ে বা হিংসার বিরুদ্ধতায় এই জনআন্দোলনের ভেতরের যুক্তিকে অস্বীকার করছেন তারা ক্ষমতার স্থিতিজাড্যের সঙ্গে একটা সুবিধাজনক রফায় আসতে চাইছেন । আর ঠিক উলটো দিকে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের বিপ্লবী স্বপ্নকে যতটা না তার থেকেও বেশী জরুরী মনে হচ্ছে এই একতরফা, উচ্চবর্গীয় ক্ষমতার স্থিতিজাড্যে আঘাত হানাটা, অনেক জরুরী হয়ে পড়ছে বিশ্বায়ন আর তার দেশী বিদেশী লুটেরা হানাদারদের সবক শেখানোটা।

কোরক ও কিন্নরী ~ হাসান মোরশেদ

১।
কবরস্থান একটু বেশী ছায়াময় হয়?
জরুরী নয়, তবু এরকম একটা জিজ্ঞাসায় আক্রান্ত হলো রাশেদ আনোয়ার, অক্টোবরের এক প্রায় শেষ হয়ে আসা বিকেলবেলা। মুলফটক দিয়ে বেশ ভিতরে এসে সে ঘুরে তাকাল। দেয়াল তখন অনেক দূরে, দেয়ালের বাইরের সড়ক তবু দৃশ্যমান। দৃশ্যমান সড়কের উপর নরোম রোদ, অথচ কবরস্থানে ছায়া ছায়া প্রায় অন্ধকার। সামিনার বলে দেয়া অনুযায়ী কবরটা এখানেই থাকার কথা। এইতো বড় একটা গাছ, গাছের পেছনে পাকা কবর, তার পাশেই। কিন্তু পাশের কবরটা তো বড় মানুষের, বছর চারেকের পুরনো ও মনে হচ্ছেনা। ঠিক এখানেই তো?
অবশ্য সামিনা নিজেও কবরটা দেখেনি।কবরস্থানে নিষিদ্ধ মেয়েরা,মা’যদিও । সড়কের ওপাশে দাঁড়িয়ে আঙ্গুল উঁচু করে সামিনাকে একবারই দেখিয়েছিলো সামিনা’র স্বামী। স্বামী? রাশেদ আনোয়ারের অস্বস্তি জাগলো।
ছায়া মাড়িয়ে সে এসে দাঁড়ালো কবরটার পাশে।হয়তো এখানেই কবর হয়েছিলো, তার উপর আবার নতুন কবর হয়েছে। কতোদিন পর কবরের উপর নতুন কবর দেয়া হয়? কবর হয়ে যাওয়া মানুষগুলোর ঠিকানা কি কেউ লিখে রাখে এখানে? চারপাশে তাকালো সে অপ্রয়োজনে। উত্তর দেবার মতো কেউ নেই কোথাও। মুল ফটকের পাশে একটা অফিসের মতো দালান আছে কিন্তু তালাবদ্ধ। হয়তো আরো আগে আসতে পারলে কাউকে পাওয়া যেতো কবরটার খোঁজ করার জন্য। কিন্তু ঢাকা থেকে এই জেলাসদরের এসে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকেল হয়ে গেলো। বাংলোটা শহরের বাইরে। সেখানে গাড়ি রেখে, কাপড়বদলে আসতে আসতে প্রায় সন্ধ্যা।
সামিনাকে কি বলবে সে? কবরটা চিনতে পারেনি?
অথচ সামিনা আসতেই চায়নি।প্রথম বিবাহবার্ষিকী উদযাপনে কেউ এমন জায়গায় বেড়াতে আসেনা যেখানে মৃত সন্তান শুয়ে আছে, বিশেষতঃ সেই বিবাহ যখন আর মৃত সন্তানের জনকের সাথে টিকে নেই।
তবু সে জোর করে রাজী করিয়েছে সামিনাকে। স্বপ্ন দেখিয়েছে এই শহরে আমরা একটা বাড়ি কিনবো।বুড়ো হয়ে গেলে আর ঢাকার ধুলোময়লায় নয় বরং এইশহরের চায়ের ঘ্রান আর মায়াবী সবুজে আমরা দুজন কাটিয়ে দেবো শেষদিনগুলো।
সামিনা দূরের দেয়ালের বাইরে মুল সড়কের পাশে দাঁড় করানো গাড়ীর ভিতর। এখানে তার গর্ভের সন্তান শুয়ে আছে, তবু সামিনার অধিকার নেই প্রবেশের।সামিনার হয়ে এই মাটি ছুঁতে এসেছে যেজন তার সাথে মাটিস্থ শিশুটির কোন সম্পর্ক নেই।
কোন প্রার্থনা নয়,কবরের মাটি কেবল নীচু হয়ে স্পর্শ করলো রাশেদ আনোয়ার।এক অযৌক্তিক, অবর্ননীয় পিতৃস্নেহর মতো অব্যাখ্য অনুভূতি তাকে আঁকড়ে ধরলো। তার তৃষ্ণা পেল প্রবল।ঐ তো দেয়ালের ওপাশেই সামিনা। তবু মনে হলো যেনো অনতিক্রম্য দূরত্বে। তৃষ্ণা নিবারনে জন্য এই দূরত্বটুকু অতিক্রম করা জরুরী।সামিনা কি তৃষ্ণার জল? অথচ একবছর কয়েক মাসে আগে ও তার এবং সামিনার পৃথিবী ছিলো পরস্পর থেকে অনেক দূরে, অনেক অচেনা, অনেক বিপরীত।
সামিনাকে নিয়ে অদ্ভূত,ব্যাখ্যাতীত কিছু ঘটে যা কিছু সে কাউকে বলতে পারেনা, সামিনাকে ও না।
সেদিন এক রেঁস্তোরায় বসে কফি খাচ্ছিলো তারা।আলবেয়ার কাম্যু কি করে তার লেখা সহ বদলে গেলেন এক্সিস্টিনিয়ালিজম থেকে এবসার্ডিজমে, বলছিলো সে। সামিনা কিছু বুঝছিলো, অনেকটুকুই বুঝছিলোনা।রাশেদ আগুন গরম কফিতে চুমুক দেয়,সামিনা ফুঁ দিতে দিতে কফি ঠান্ডা করে। ফুঁ দিতে দিতে সামিনা ঠোঁট টিপে হাসছিলো। তার হাসিতে শব্দ হয়না। তবু রাশেদ শব্দ শুনছিলো হাসির অথচ সামিনা নেই। সামিনা আছে, তার অস্তিত্ব টের পাচ্ছে সে, তার হাসির শব্দ শুনছে সে অথচ মুখোমুখি বসা ছিলো সামিনা। তবু সামিনাকে দেখছেনা সে। দৃষ্টিতে, দর্শনে সামিনা নেই!চারদিকে সব ছিলো, সবাই ছিলো। রেঁস্তোরার রঙ্গীন পর্দা, পাশের টেবিলে মুখোমুখি নির্বাক দম্পতি,মোবাইলের রিংটোন, সামিনার নিঃশব্দ হাসির শব্দ শুধু সামিনা ছাড়া।
হয়তো মুহুর্ত কয়েক।সামিনা হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করেছিলো তার হাত।জিজ্ঞেস করেছিলো-হঠাৎ বিষন্ন কেনো?
দেয়া উত্তর মনে নেই এখন আর রাশেদ আনোয়ারের। মনে না হওয়ার অস্বস্তি নিয়ে সে উঠে দাঁড়ায়।সামিনার দিকে ফিরে যেতে যেতে হঠাৎ করেই যেনো মনে পড়ে যায় তার - এই শিশুটার মৃত্যু দরকারী ছিলো। সামিনার বেঁচে উঠার জন্য। সামিনাকে জড়িয়ে ধরে তার আরেকবার নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য।

২।
পায়ের কাছে জোছনা এসে লুটোপুটি খেললে তার ঘুম ভেঙ্গে যায়।
জানালা খোলা ছিলো। অক্টোবরের রাতে এই পাহাড়ী শহরে আলতো করে শীত পড়তে শুরু করে। দরজার ওপাশে টানা বারান্দা। সামিনা উঠে তার নিরাভরন শরীরে আলগা করে শাড়ী জড়ায়।রাশেদ ঘুমিয়ে আছে, ঘুমিয়ে পড়া মুখে তার এক চিলতে হাসি, তৃপ্তি ও সারল্যের। রাশেদের নগ্ন শরীরে চাদর টেনে দিয়ে সামিনা এসে দাঁড়ায় বারান্দায়।
বাংলোটা শহর থেকে বেশ বাইরে একটা পাহাড়ের চুড়ায়।রাত হয়তো প্রায় শেষ।হালকা কুয়াশা পড়েছে, আশেপাশের পাহাড়গুলো জমাটবাধা গাঢ় সবুজের মতো।অনেক দূরের উঁচু পাহাড়ে ছেড়া ছেড়া আলো। রাশেদ বলছিলো ওটা মেঘালয়ের পাহাড়,আলোগুলো খাসিয়া পুঞ্জি। রাশেদ বলছিলো- মেঘালয়ে যেতেই হবে একবার। ওখানে মাথার উপর দিয়ে থোকা থোকা মেঘ ভেসে যায়,হাত দিয়ে সেই মেঘ ছুঁয়ে যায়।
এই লোকটার সাথে দেখা না হলে, এই লোকটার সাথে জীবন নতুন করে শুরু না করলে কতোকিছু অজানা থেকে যেতো সামিনার। কিন্নর বলে অনেক উঁচুতে নাকি একটা জায়গা আছে, সে জায়গার মেয়েরা স্বর্গের অপ্সরাদের চেয়েও সুন্দরী,কোন কোন আদিবাসী গ্রামে ফসল বুনতে যাওয়ার আগে পুরুষেরা নিজ নিজ নারীদের পুজো করে কেননা নারীরাই তো শস্যমতী, উৎপন্নের আঁধার।এতো কিছু জানা হতোনা সামিনার, এমনকি নিজের শরীর। শরীরের চরম তৃপ্তি, অর্গাজম,মাল্টি অর্গাজম, বিছানায় আধিপত্য নেয়া!
অথচ বিবাহিত জীবনের চারটা বছর কি দুর্বিষহ সমর্পণ ছিলো সামিনার। লোকটা এই শহরে চাকরী করতো, বিয়ে করে তাকে নিয়ে এসেছিলো।লোকটা ভালো ছিলোনা, লোকটা মন্দ ছিলোনা। তার কোন অভিব্যক্তি ছিলোনা, তার কোন প্রতিক্রিয়া ছিলোনা। অফিস শেষে সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফিরে টিভি দেখতো, সাথে থাকা মা-বোনের সাথে কথা বলতো, খাওয়া দাওয়া শেষ হলে পর দরজা লাগিয়ে মৃয়মান সামিনাকে টেনে নিতো।ক্লান্তিকর রমণ শেষে সিগারেট টেনে ঘুমিয়ে পড়তো।
দুবছরের বাচ্চাটা শেষপর্যন্ত মারা যাওয়ার পর সরকারী কবরস্থানে দাফন শেষে ঘরে ফিরে ও সে সিগারেট টেনেছিলো। তিনদিন পর সামিনাকে টেনেছিলো, সামিনা ঊরুর ভাজ খুলে দিয়েছিলো নিরবে।কয়েক মিনিট পরে আবার সিগারেট টানতে টানতে বলেছিলো- মরা বাচ্চাকে ভুলতে তোমার আরেকটা বাচ্চা দরকার।
সামিনা ভুলতে চায়নি তো! দুবছরের বাচ্চা, জন্ম থেকেই যার হৃদপিন্ডে ছিদ্র,শ্বাস নেয়ার সময় গড়গড় আওয়াজ উঠতো, নীল হয়ে যেতো ফর্সা তুলতুলে দেবশিশু সামিনা তাকে ভুলতে চায়নি কখনো। তবু লোকটার কি বিভৎস রমণ! সামিনা তখন কাঁপতো, পানিতে হাত ডুবিয়ে কাঁদতো, ক্ষিধে লাগতে লাগতে শরীর অবসন্ন হয়ে পড়তো কিন্তু কিছু খেতে পারতোনা।তবু লোকটার যেনো মরনপণ জেদ আরেকটা সন্তান জন্ম দিয়ে মৃত সন্তানকে ভুলে যাবে,ভুলিয়ে দেবে! পরপর দুবার গর্ভপাতের পর সামিনার আর ঊরুর ভাজ খুলে দেবার শক্তিটুকু ও অবশেষ নেই।
সামিনা হয়তো মরেই যেতো। তার ফিরে যাবার কোন জায়গা ছিলোনা। বাবা ছিলেননা, শয্যাশায়ী মা বড়বোনের সংসারে , ছোটভাই দুবাই। তবু সামিনা বেঁচে উঠলো শামীম ভাই ইংল্যান্ড থেকে ফিরে আসার পর।খালাতো এই ভাইটির স্নেহ ছিলো তার জন্য সবসময়। সামিনাকে জোর করে নিয়ে আসলেন তিনি।
একবছর পর রাশেদের সাথে সামিনার বিয়ের আয়োজন ও তার করা। বলেছিলেন সামিনাকে- জীবন ফুরিয়ে যায়না কখনোই।আরেকবার সাহস করে শুরু কর। রাশেদ অন্য রকম ছেলে।ইংল্যান্ডে ফিরে যাবেনা বলে ওর স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে ফিরে গেছে, ওরা ফিরবেনা আর। ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ায়,তুই ও তোর পড়াশুনোটা শেষ কর।
শামীম ভাই তাকে এই উপলব্দি দিয়েছিলেন জীবন হলো ষাঁড়ের লড়াই। সাহসী ম্যাটাডোরের মতো লড়তে না জানলে প্রথম রাউন্ডেই ফুরিয়ে যেতে হবে, রক্তাক্ত, ছিন্নভিন্ন হয়ে ছিটকে বেরিয়ে আসতে হবে। আর লড়তে জানলে হারতে হারতে ও শেষ মুহুর্তে জিতে যেতে পারে রক্তাক্ত মানুষ।
সামিনা জানে সে জিতে গেছে শেষপর্যন্ত। রাশেদ তাকে প্রথম জানিয়েছি কেবল ঊরুর ভাঁজ খোলে দেয়াই জীবন নয়। জীবন অন্যত্র, জীবন আরো কিছু।চলে যাওয়া সন্তানের জন্য রাশেদের গভীর বেদনাবোধ আছে, কিন্তু নতুন সন্তান জন্ম দিয়ে সেই বেদনা মুছে দেবার কোন তাড়া নেই তার। সামিনার হাতের আঙ্গুল নিয়ে খেলতে খেলতে বলছিলো সে- আমাদের মাঝখানে তৃতীয় কারো কী দরকার? এমনকি সন্তান! দুজন দুজনকে জড়িয়ে থেকে জীবন ফুরিয়ে দেবো। শুন্য করে চলে যাবো ভাণ্ডার!
এই শহরে এসে স্থায়ীভাবে থাকার স্বপ্ন দেখে রাশেদ। সামিনা জানে,এটা তার মৃত সন্তানের প্রতি রাশেদের সৌজন্যপ্রকাশ। রাশেদ তার মাতৃত্বকে শ্রদ্ধা করে, রাশেদ চায় সামিনা ভালো থাকুক তার সন্তানের কাছাকাছি। মৃত সন্তান।
অথচ সামিনার বড় অস্বস্তি হয়।গোপন পাপের মতো এক তীব্র অস্বস্তি তাকে আক্রান্ত করে। রাশেদ তার জীবনের আসার পর এই অস্বস্তি সে আবিস্কার করে। বড় সিদ্ধান্তহীন,পরিনতিহীন এই আবিস্কার, যেনো না হলেই সে বেঁচে যেতো। অথচ জানে সে- আদতে এই আবিস্কারই বাঁচিয়ে তুলেছে তাকে।
মৃত সন্তানের কথা মনে হলে এখন আর সামিনার কোন কষ্ট হয়না। আজ বিকেলে যখন সে একা বসেছিলো গাড়িতে আর রাশেদ গিয়েছে কবরস্থানের ভেতরে তখনো মৃত সন্তানের মুখ ভাসছে তার চোখের সামনে। ঐ ছোট ছোট হাত পা, তুলতুলে শরীরের ঘ্রান,শ্বাসকষ্ট সব স্পষ্ট মনে পড়ে তার কিন্তু এই মনে পড়ায় এখন আর কোন কষ্ট পায়না সে, যে কষ্ট নিয়মতান্ত্রিক, বাঞ্চিত। বরং একটা তীব্র সুখের মতো অনুভূতি জাগে খুব গোপনে।
সুখ? সুখের মতো?
মৃত সন্তানের স্মৃতিচারনে সুখের মতো অনুভূতি? সামিনার ভয় ভয় জাগে। নিজেকে পিশাচিনীর মতো মনে হয় তবু এই সুখের মতো অস্বস্তি সে অস্বীকার করতে পারেনা।এই সন্তান বেঁচে থাকলে সে নিজে আজকের এই বেঁচে থাকা জীবনটা যাপন করতে পারতোনা।
কবরস্থান থেকে বাংলোয় ফিরে আসার পথে রাস্তার পাশে একটা পাহাড়ে তারা থেমেছিলো। সূর্য তখন ডূবছে। রাশেদ বলছিলো চলো পাহাড়ের চুড়োয় বসে সূর্যাস্ত দেখি।পাহাড়ের ঢালে একটা গলফ কোর্স। অবশ্য ছেলেরা গলফ নয় ক্রিকেট খেলছিলো। পাশ দিয়ে হেঁটে যাবার সময় ওরা তাকিয়ে ছিলো। কেউ একজন বোধহয় কিছু বলছিলোও। সামিনার ভালো লাগছিলোনা। রাশেদ হাসছিলো- শরীর নিয়ে তোমার অস্বস্তি এখনো গেলোনা।ছেলেরা তোমার প্রশংসা করছে।
বাংলোয় ফিরে আসার পর রাশেদ বশংবদ দাসের মতো প্রশংসা করছিলো তার শরীরের। সামিনা ওর কৌশল জানে। সামিনাকে জাগিয়ে তোলার জন্য এইসব বদমায়েশী সে খুব ভালো জানে। সামিনাকে নিরাভরন করতে করতে বলছিলো এই পাহাড় চুড়োর রাতে তুমি কাউগার্ল হও। মাই ডিয়ারেস্ট হর্নি গার্ল!
ঘন্টা কয়েক আগের খুনসুটি মনে পড়তে পড়তে সামিনা টের পায় তার শরীর জাগছে আবার। যে শরীর মরে গিয়েছিলো, ঊরুর ভাঁজ খুলে দেয়া ছাড়া যে শরীরের আর কোন ভূমিকা ছিলোনা সে শরীরের এই তীব্র প্রানময়তা সামিনাকে এখন তুমুল দোলায়।
বারান্দায় থেকে জানলা দিয়ে সে ঘরের ভিতর দেখে। রাশেদ ঘুমিয়ে আছে। এই ঘুমন্ত রাশেদকে তেমন পুরুষ মনে হয়না তার এই মুহুর্তে। বরং সারল্য আর তৃপ্তি নিয়ে সে শিশুর মতো,যেনো তার গর্ভজাত শিশু।
সামিনা মুখ ফিরিয়ে নেয়। শরীরের জেগে উঠা আরো তীব্র হচ্ছে। চাঁদ চলে গেছে মেঘের আড়ালে। অন্ধকারে আরো অধিকতর জমাট বেঁধে আছে চারপাশের জঙ্গল, প্রকৃতি। সামিনা আলগা হয়ে থাকা শাড়ী সরিয়ে ফেলে তার শরীর থেকে।
প্রকৃতি এক প্রবল পুরুষ হয়ে জেগে উঠছে। শেষরাতের ঠান্ডাবাতাস, অন্ধকার আকাশে জেগে থাকা তারা, দূরের পাহাড়ের আলো, বনের জমাট সবুজ সব এক কাঠামোতে মিশে গিয়ে তৈরী হচ্ছে প্রবল পুরুষের আকার। সামিনা কেঁপে কেঁপে উঠে। টের পায় তার ঊরুর ফাঁকে প্রস্তুতি।যে পুরুষ আসলে নেই, প্রকৃত সেই প্রবল পুরুষের উত্থিত প্রবেশের জন্য টানটান প্রতীক্ষারত শরীর। সামিনার।


অন্তর্গত
কে কোথায় নিভে গেছে তার গুপ্ত কাহিনী জানি।
নিজের অন্তর দেখি, কবিতার কোন পঙতি আর
মনে নেই গোধূলিতে; ভালোবাসা অবশিষ্ট নেই।
অথবা গৃহের থেকে ভুলে বহির্গত কোনো শিশু
হারিয়ে গেছে পথে, জানেনা সে নিজের ঠিকানা
[সন্তপ্ত কুসুম ফোটেঃ বিনয় মজুমদার]


(উৎসর্গ: প্রিয় শিমুল, আনোয়ার সাদাত শিমুল'কে- যে একদিন বড় হয়ে, আরো বড় গল্পকার হবে)


১.
ঘুমের ভেতর অসুখের ঘ্রান পায় হাসান অথবা অসুখের ঘ্রানে ঘুম ভাঙ্গে। ঘুম ভাঙ্গে কিন্ত চোখ খুলতে পারেনা, চোখ খুলে তাকাতে পারেনা। যেনো চোখের ভেতরে মুঠো মুঠো বালি ঠেসে দেয়া। কড়কড়ে অস্বস্তি।
দু হাত উপরে চেপে ধরে ধীরে ধীরে খুলতে গিয়ে যেনো সে ঝলসে যায়, চোখের উপর হাজার ওয়াটের বাতি জ্বলছে। আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে দৃষ্টি গেঁথে যায় অনেক উঁচুতে জানালার গরাদে। গরাদ ঠেলে রোদ আসছে অথচ বাতাস নেই। ফুসফুসে হাসফাস।
এই কারাগার থেকে সহসা মুক্তি নেই, জেনে তবু কি এক অবোধ্য তাড়নায় সে লাফিয়ে উঠে গরাদ ভাঙবে বলে।
ঘোর। ঘোর কাটলে পরে হাসান টের পায় এটি তার ব্যক্তিগত শোবার ঘর মাত্র। গত রাতে বাতি নেভানো হয়নি। জানালার পর্দা ও টানা হয়নি। বেলা অনেক। বাইরের কড়া রোদ ঘরের ভেতর।

২.
বাচ্চাদের স্কুলের সকালের শিফট শেষ হবার আগে আগে রাস্তার উল্টোপাশে এসে দাঁড়ায় হাসান।
পাড়ার ময়লা নিয়ে যাচ্ছে একটা ভ্যান। ভ্যানের পেছন থেকে ময়লা গড়িয়ে পড়ছে রাস্তায়। মাইকে প্রবল চিৎকার। মানুষের অহেতুক ছুটোছুটি। স্কুলের গেটে এসে ভীড় করছে অভিভাবকরা। হাসানের কোন তাড়া নেই। অফিস ছুটি সপ্তাহখানেকের। কোথাও তেমন যাওয়ার নেই।
বাচ্চারা সব বের হয়ে আসার পর একজন দুজন করে মিস্ট্রেস ও বের হতে থাকে। একেবারে পেছনে চৈতী। হাসান রাস্তা পেরোয়। চৈতী হাত নাড়ে। কলাপাতা রংয়ের জামা, চুল বেনী করা- ওকে বালিকা বিদ্যালয়ের নবম শ্রেনী বলে ভ্রম হয়।
চোখমুখে রোদ ঝলমল আলো ফুটিয়ে ও এসে হাসানের বাহু স্পর্শ করে।-‘ চলো আইসক্রীম খাবো’
কিছুটা দূর হেঁটে ওরা আইস ক্রীম পার্লারে ঢুকে। ফালুদার গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে চৈতী বলে- তোমার তো ছুটি, চলো কাল কোথাও বেড়াতে যাই সারাদিনের জন্য। আমি ছুটি নিতে পারবো।

আইস ক্রীম পার্লারের ঠান্ডায় হাসানের ঘুম পায়। থুতনীতে হাত ঠেকিয়ে বলে-কোথায় বেড়াতে যাবে? এই শহরে নিঃশ্বাস নেয়ার মতো কোন জায়গা খুঁজে পাইনা আমি

চৈতী জানায় শহরের ঠিক অদূরেই নাকি একটা বিনোদন পার্ক হয়েছে। পার্কের ভেতরে পাহাড় আছে। পাহাড়ের নির্জনতায় ছোট ছোট কুটির। চাইলে সারাদিনের জন্য ভাড়া নেয়া যায়। শহরের সব প্রেমিক প্রেমিকেরা নাকি পয়সা খরচ করে প্রেম করতে ভীড় করছে ঐসব ভাড়াটে কুটিরে।
হাসান হাসে- যাওয়া যায়, পুরো দিনের জন্য আমরা ও একটা কুটির ভাড়া নিতে পারি।তবে কাল না। অন্য দিন।
-কাল নয় কেন?
- কাল বিকেলে অথৈর ডাক্তারের এপয়েন্টমেন্ট আছে।
-ওহ!

তারপর ক’মুহুর্তে শীতাতপ যন্ত্রের একটানা আওয়াজ ছাড়া আর কোন শব্দ থাকেনা।হাসান টেবিলে আঁকিবুকি কাটে। চৈতীই ফের কথা বলে
-কি অবস্থা মেয়েটার?
-ভালো না। ডাক্তাররা কিছুই ধরতে পারছেনা। ডায়াগোনোসিস চলছে একটার পর একটা।কিন্তু
-ওর বাবা একটা অমানুষ
-ওঁহু। সবই পরিস্থিতি।
-একমাত্র মেয়ের এই অবস্থায় সে বিদেশে পড়ে থাকতে পারলো?
-সে বিদেশে আছে বলেই অন্ততঃ মেয়েটাকে বাঁচানোর চেষ্টা করা যাচ্ছে
-বাচ্চাটাকে ওর বাবা চিকিৎসার জন্য নিয়ে যেতে পারেনা?
-নাহ। ও নিজেই এখনো বৈধ হতে পারেনি।
-ও তোমার খুব ভালো বন্ধু ছিলো, তাইনা?

হাসান কথা বলেনা। বিরক্ত হয়। চৈতীকে আগে ও বলেছে, তবু কি এক অদ্ভূত কারনে এই প্রশ্ন সে বার বার করে। অথৈ’র বাবা ফয়সাল কখনোই ওর বন্ধু ছিলোনা। সহকর্মী মাত্র। হাসান যখন অফিসে জয়েন করে ফয়সাল তখন মাত্র ক’দিন হয় বিয়ে করেছে প্রেম করে। দু পরিবারেরই অসম্মতিতে।সে দুপুরের লাঞ্চ নিয়ে আসতো বাসা থেকে। হাসানকে জোর করে খাওয়াতো। একদিনের জন্য ও সে হাসানকে বাইরে লাঞ্চ করতে দেয়নি। বাসায় নিয়ে গেছে। ওর বৌ নীলার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে, নীলার তখন বাচ্চা হবে। বাচ্চা হবার সময় প্রচুর রক্তপাত হলো, কাকতালীয় ভাবে রক্তের গ্রুপ মিলে গেলো হাসানের সাথে। হাসান রক্ত দিলো। বছর খানেক পর অফিসের এক প্রোগ্রামে আমেরিকা গিয়ে যখন ফয়সাল আর ফিরলোনা নীলা তখন হাসানকেই জানালো এটা তাদের পুর্ব পরিকল্পিত, আর্থিক দৈন্যদশা মেটানোর নাকি আর কোন পথ ছিলোনা।
আরো ক’দিন পর যখন অথৈ মেয়েটা অসুস্থ হলো- নীলা হাসানকেই জানালো, , আমেরিকা থেকে ফয়সাল ফোন করে অনুরোধ করলো ওর মেয়েটাকে নিজের মেয়ের মতো করে দেখতে, ওদেরকে দেখার আর কেউ নেই।
বন্ধন ভাল্লাগেনা, তবু জড়ায়-হাসান তবু জড়াতে থাকে নানা বন্ধন ও বিমুগ্ধতায়।

চৈতী হাসানের চুলে হাত ছোঁয়ায়। বলে- ‘আমার কিন্তু ভালো লাগে, এই যে একটা বাচ্চার জন্য তোমার এতো কেয়ার।তুমি খুব ভালো বাবা হবে, আমার চিন্তা নেই’
হাসান হাসে-‘ কি জানি, আমার বরং লালন ফকিরকেই ভালো লাগে।বলেছিলেন- জন্ম দিওনা, জন্ম দিলে আত্না খন্ডিত হয়ে যায়।‘
-'হয়েছে। তুমি লালন না। তুমি হলে হাসান। আমার হাসান'

প্রায় নির্জন আইসক্রীম পার্লারে চৈতী আরো ঘন হয়ে আসে, ঘন হয়ে আসে ওর চুলের ঘ্রান।
হাতের আঙ্গুল নিয়ে আনমনে খেলতে খেলতে ও বলে- যাবে এখন আমার সাথে? মেয়েটাকে দেখে আসি। ওর মা একেবারে একা।
চৈতীর হাত ফিরে যায়।
যেতে যেতে বলে - 'আজ আমার কাজ আছে।অন্য কোন দিন যাবো। আজ তুমি একাই যাও'

তারপর আর তেমন কথা এগোয়না। সমস্ত সুঘ্রান নিয়ে মেয়েটা চলে যাওয়ার পর ‘একা’ শব্দটা বড় ভারী ও তপ্ত হয়ে উঠে হাসানের জন্য।হিমহিম আইস ক্রীম পার্লারে ফিরে আসে সকালের হাসফাস, অসুখের ঘ্রান।

ক’বছর আগে কলেজের বন্ধু এন্টনীর সাথে ও বেড়াতে গিয়েছিলো খাসিয়া পল্লীতে। এন্টনীর দাদী থুত্থুড়ে বুড়ি নাকি হাত দেখে ভবিষ্যত বলে। কৌতুহলে সে ও বসেছিল বুড়ির পাশে। হাত ধরে রেখে দীর্ঘক্ষন, ফিসফিসিয়ে বুড়ি বলেছিল-‘ তোর তো শরীর ভরা অসুখ রে ব্যাটা!’

শরীর ভরা অসুখ নিয়ে গ্লাসডোরে ঠেলে বেরিয়ে আসে হাসান।

৩.
বাইরে প্রবল রোদ। থকথকে মানুষের দল। দলবদ্ধ জটলা। অথৈদের বাসায় যাবার জন্য রিক্সা, টেক্সী কিচ্ছু নেই।অলংঘনীয় জ়্যামে আটকে আছে গোটা শহর। জ্যামে আটকে আর্তনাদ করছে একটা ফায়ার সার্ভিসের গাড়ী। একটানা হর্ণ বাজাচ্ছে। একচুল নড়ছেনা কেউ। হাসান রাস্তায় নেমে এসে হাঁটতে থাকে।

ফুটপাত বলে কিছু নাই। মানুষের শরীরের উপর দিয়ে গড়িয়ে হাঁটছে মানুষ। ছুটছে আরেকদল। আরেকদিক থেকে হর্ণ বাজাতে বাজাতে চলে গেলো পুলিশের গাড়ী। কেউ একজন চিৎকার করে বললো-শহরের প্রধান বিপণীতে আগুন লেগেছে। বেশ উঁচুতে আগুনের শিখা। অনে দূর থেকে তার হল্কা এসে ধাক্কা দিলো।

হাসানের শরীর জ্বলছে। কাল ফেরার আগে পিঠে নখের আঁচড় বসিয়ে দিয়েছিলো নীলা।সারা রাত জ্বলেছে, এখন জ্বলছে আবার ।
শহর জ্বলছে। শরীর ভর্তি আগুন নিয়ে হাসান দৌড়ায় এবার।

দৌড়ের ভেতর অসুখের ঘ্রান পায় হাসান অথবা অসুখের ঘ্রান নিয়েই দৌড়ায়। দৌড়ায় অথচ চোখ খুলতে পারেনা, চোখ খুলে তাকাতে পারেনা। যেনো চোখের ভেতরে মুঠো মুঠো বালি ঠেসে দেয়া। কড়কড়ে অস্বস্তি।


।।ব্যক্তিগত পোষাক।।
কফিপটে উত্তাপ।ফুলদানীতে তাজা ফুল।ঘ্রানহীন,রংচঙ্গে।জানলায় ভারী পর্দা।দেয়ালজুড়ে আয়না।
শামীম হায়দার আয়নায় নিজেকে দেখলেন।নিজের প্রতিবিম্ব দেখলেন।শরীরের শীর্নতা ফুরিয়েছে অনেক আগেই।তলপেটে কিছুটা মেদ জমলেও নিজের নগ্ন শরীরকে এখনো ভালো না লাগার মতো সময় আসেনি।শিশ্ন আপাতঃ শিথিল।
কোমরে তোয়ালে জড়ালেন। ভারী পর্দা সরালেন কিঞ্চিৎ।বিকেলের আলো এলো ঘরে।
বালিশে মুখ গোঁজে থাকা সোহানা আক্তার মুখ ফেরালেন।ভ্রুঁতে প্রশ্নবোধ।
শামীম হায়দার পর্দা টেনে দিলেন।
হলিডে হোমসের এই ঘরে এখন আর বিকেল নেই।
স্ত্রী জানেন জরুরী মিটিং আছে।মিটিং শেষে ডিনার পার্টি।ফিরতে রাত হবে।বেশ রাত।বিদেশী ব্যাংকের স্থানীয় শাখার প্রধান ব্যবস্থাপকের এমন রাত হয়। স্ত্রী অভ্যস্ত। সন্তানদ্বয় ও।
বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্ধ্বতন প্রভাষিকা সোহানা আক্তারের ব্যবসায়ী স্বামী আমদানী কাজে সিঙ্গাপুর।একমাত্র সন্তান শ্বাশুড়ীর কাছে নিরাপদ।ছাত্র-ছাত্রীদের একটা অনুষ্ঠান আছে।ফিরতে দেরী হবে।
শামীম হায়দারের ব্যাংক ও সোহানা আক্তারের বিশ্ববিদ্যালয় দুটোই যথাক্রমে একটি সুপারমার্কেটের চতুর্থ ও সপ্তম তলায়। সতের বছর তাদের দেখা হয়নি।দেখা না হওয়ার সতের বছর তারা সুপার মার্কেটের চতুর্থ ও সপ্তম তলায় কার্যরত ছিলেন তেমন ভাবনার কোন কার্যকারন নেই।
। শামীম হায়দারের বাবা ছিলেন মফস্বল শহরের সমাজসেবা কর্মকর্তা। আর সোহানা আক্তারের বাবা ছিলেন শিক্ষা কর্মকর্তা। দু কর্মকর্তাই সেই মফস্বলে বদলী হয়ে এসেছিলেন অন্য কোন মফস্বল থেকে।উপজেলা চত্বরের মধ্যে পাশাপাশি নিবাস ছিলো তাদের। শামীম হায়দার ও সোহানা দুজনই তখন অষ্টম শ্রেনী।
শামীম হায়দার বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়-কালো প্যান্ট,সাদা সার্ট,বাটার জুতো। সোহানা আক্তার উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়- সাদা সেলোয়ার,আকাশী জামা, সাদা উড়না।সোহানা ইতিমধ্যে প্রেমে পতিত।উপজেলা চেয়ারম্যানের চাচাতো ভাই যে কলেজের একাদশ শ্রেনীতে, সে টিফিন পিরিয়ডে বালিকা বিদ্যালয়ের গেটে এসে দাড়ায়। সাইকেলের টুংটাং আওয়াজ হয়।চিঠি বিনিময় হয়।একদিন সন্ধ্যেবেলা বিদ্যুৎবাতি কোন কারনে না জ্বললে উপজেলা শিক্ষাকর্মকর্তার সরকারী নিবাসের দেয়াল টপকে কে যেনো ভেতরে ঢোকে। কর্মকর্তাটি স্ত্রী সমেত গিয়েছিলেন দাওয়াত খেতে এক বিদ্যালয় শিক্ষকের বাড়ীতে। বৃত্তি পরীক্ষা সমাগত বলে একমাত্র কন্যাটি একাকীই ছিলো।
শীর্ণ শামীম হায়দার তার জন্য বেজায় ভারী ছাত্রসখা বইটি নিয়ে সেই সন্ধায় কড়া নেড়েছিল সোহানাদের দরজায়। দরজা খুলেনি কেউ। আসন্ন বৃত্তিপরীক্ষার ইংরেজী রচনা কোনটা বেশী ইম্পোর্টেন্ট - ‘এইম ইন লাইফ’ নাকি ‘জার্নি বাই বোট’ সেই সিদ্ধান্তে আসা জরুরী ছিলো তার জন্য, জরুরী ছিলো সোহানার সাথে কথা বলা। তাই ক্রমাগত কড়া নাড়া ও প্রত্যাখান তাকে অসহিষ্ণু করে তুলছিল। পেছনের দেয়ালের নীচ দিয়ে ভিতরে ঢোকার একটা পথ জানা ছিলো তার। দেয়াল টপকানো ক্লেশটুকু করতে হয়নি তার।
যে উপগত ছিলো সে দেখিনি, যে শয্যাগত ছিলো সে দেখেছিলো। শামীম হায়দার পালিয়ে এসেছিলো।
একুশ বছর পর, সুপারমার্কেটের ছাদে গড়ে উঠা বাহারী রেঁস্তোরার একবারে কোনার টেবিলে বসে সোহানা আক্তার যখন বলছিল- ‘অনেক দিন আমি অর্গাজমের আনন্দ পাইনি’ শামীম হায়দারের মনে পড়ে গিয়েছিল সেই সন্ধ্যা, সেই সন্ধ্যায় কি ঐ আনন্দ পেয়েছিল সে?
জিজ্ঞেস করা হয়নি। কিন্তু সেই রাতে, রেঁস্তোরা থেকে ফিরে আসার পর রাতে তার স্ত্রী দীর্ঘদিন পর অর্গাজমের আনন্দ পান।চোখ বন্ধ নি;শ্বাস নিচ্ছিল শামীম অর্ধ-উত্থিত শিশ্নে ঠোঁট বুলিয়ে স্ত্রী বিড়বিড় করেন- ‘আই লাভ ইউ ম্যান’ ।
খোলাপিঠ নিয়ে সোহানা আক্তার আবার উপুড় হন। শামীম জানালার কাছ থেকে ফিরে আসেন।
-কিছু বলবে?
-নাহ
-খারাপ লাগছে?
-নাহ
-অনুশোচনা
-নাহ!
বিছানার পাশে একটা সিডি প্লেয়ার।আগে খেয়াল হয়নি কারো। খেয়াল করার মতো ধৈর্য্য ছিলোনা কারো।আলগোছে বাটন টেপা হয়। অপরিচিত কন্ঠ গেয়ে উঠে চেনা গান
‘চেয়ে থাকি দাঁড়িয়ে দ্বারে, চেয়ে থাকি
যে ঘরে ঐ প্রদীপ জ্বলে তার ঠিকান কেউ না বলে
বসে থাকি, বসে থাকি পথের নিরালায় গো
চিররাতের পাথার পাড়ে হায়গো… ‘
এয়ারকন্ডিশনারের ঠান্ডায় শীতবোধ হয়।
শামীম হায়দার কফিপট থেকে কফি ঢালেন। এক কাপ। এক কাপ খালি থাকে। ভারী পর্দা সরান আবার। সন্ধ্যা ঘনাচ্ছে। এখন আর বিকেলের রোদ নেই। ঘরের ভেতর আলোর প্রবেশ নেই। সোহানা আক্তার তার খোলা বুক নিয়ে চোখ মেলেননা এবার।
হলিডে হোমসের বাইরের দিকের বাগানে একজোড়া ছেলেমেয়ে।পরস্পরকে জড়িয়ে আছে। মেয়েটার হাতে কিছু একটা। অতোদূর থেকে স্পষ্ট বুঝা যায়না। আইসক্রীম হতে পারে। মেয়েটা ছেলেটার মুখে তুলে দিচ্ছে। দুজন হাসছে।
শামীম হায়দার, সোহানা আক্তারকে শুনিয়ে বলেন- 'দেখো, ওরা প্রেম করছে।'


।। কবি ও প্রেমিকাগন ।।
আমার এমন হয় ।
দীর্ঘ প্রস্তুতির বিনিময়ে কোন কোন কাজ শেষ করতে গিয়ে, শেষ মুহুর্তে আমাকে আঁকড়ে ধরে অবসন্নতা । মনে হয়, থাক । বরং বাদ দেই, বরং ফিরে যাই…
প্রথম যেদিন রিমি’র জামার বোতাম খুলেছিলাম-আমার দীর্ঘ প্রস্তুতি ছিল সেটা,মনে আছে । কারো কারো এইসব সহজে হয়ে যায় । আমার হয়না । বেশ তো ক’দিন হয়ে গেল । এখনো মনে আছে, রিমি’র জামায় পাঁচটা বোতাম ছিলো । ও চোখ বুঁজে ছিলো । আমি প্রথম বোতামে বেপরোয়া ছিলাম,দ্বিতীয় বোতামে কামার্ত, তৃতীয় বোতামে সাহসী হয়ে চতুর্থ বোতামে অবসন্নতা ।মন বলছিল- থাক এতোটুকুই, বাদ দেই এবার, ফিরে যাই । মুহুর্তের অমনোযোগীতায় রিমি চোখ খুলেছিল আর হাতের আঙ্গুল ও অবাধ্য হয়েছিল আমার ।
এই বিকেলে কালো গেটের সামনে দাঁড়িয়ে সেই একই রকম ফিরে যাওয়ার আকুতি টের পাই নিজের ভেতর অথচ এই বিকেলের জন্য, এই গেটের সামনে দাঁড়ানোর জন্য কতোদিনের অপেক্ষা আমার!
এবারো হাতের আঙ্গুল অবাধ্য হয়ে উদ্ধার করে আমাকে । কলিং বেল চাপি ।
মধ্যবয়স্ক কাজের লোক এসে গেট খুলে দেয় ।
আমার কি কিছুটা মন খারাপ হয়?
লোকটা নাম জিজ্ঞেস করে,তারপর জানান দেয়-তিনি ভেতর ঘরে অপেক্ষায় আছেন । আমি লোকটাকে অনুসরন করি কেবল । অনুসরন করতে করতে ঘাড় ঘুরিয়ে বাড়ীটা দেখি । খুব পুরনো নয় অথবা বাড়ীটা পুরনোই,নতুন করে সাজানো হয়েছে । দোতলায় টানা ছাদ, নিচে বেশ বড় একটা বাগান, বাগান পেরিয়ে মুল বারান্দা । আমরা বারান্দায় উঠি । বারান্দা পেরিয়ে ভেতর ঘর ।
ভেতর ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে তিনি। বয়স হয়েছে বুঝা যায় কিন্তু চিবুকে এখনো স্নিগ্ধতা ও আভিজাত্যের মিশেল । বেশ ঘরোয়া কিন্তু দামী শাড়ী জড়ানো গায়ে । কোন কোন মুখ দেখলে সাদা-কালো এলবামের ধ্রুপদী ছবি মনে হয় । এ মুখ সেরকম ।
তাঁর চোখে কৌতুহল,ঠোঁটে চাপা হাসি ।
-টেলিফোনে গলা শুনে আপনাকে আরো বয়স্ক মনে হচ্ছিলো ।
আমি হাসি । সবিনয়ে বলি-
-আমাকে তুমি করে বললে খুশী হবো ।
-ঠিকাছে, ভিতরে এসো ।
আমরা ভেতরে যাই।কাজের লোকটা অন্য কোথাও চলে গেছে।এই ঘরে শুধু তিনি এবং আমি। বেতের সোফায় বসি।পাশের সোফায় বসতে বসতে তিনিই কথা শুরু করেন-
-আমি কিন্তু তোমাকে ঠিক চিনতে পারিনি ।
নাম শুনে চিনে ফেলা অসম্ভব জেনেই আমি আমার নামটা বলি । তারপর বলি
-আমি ঢাকা থেকে এসেছি । সিনেমা বানাই
-ওহ । শুটিং করতে এসেছো? আমাদের ছোটবেলায় এখানে কতো শুটিং হতো । এখন মনে হয় সেরকম হয়না ।
-আমি ঠিক ওরকম সিনেমা বানাইনা । ডকুমেন্টারী করি ।
-আচ্ছা!
টের পাই-আমার সামনে যিনি বসে আছেন-এই শহরের সরকারী বালিকা বিদ্যালয়ের অবসর নেয়া প্রধান শিক্ষিকা,যার স্বামী বছর কয়েক আগে প্রয়াত, ছেলে মেয়েরা লন্ডন ও নিউইয়র্কে সেটেলড, নিজে ও বছরের বেশীর ভাগ সময় এখন বাইরে থাকেন- তার ভেতর আমাকে নিয়ে যুগপৎ কৌতুহল ও অস্বস্তি কাজ করছে ।
আমাদের মধ্যে ছেঁড়া ছেঁড়া কথা হয়
-আমি গত সপ্তাহে লন্ডন থেকে ফিরেছি । এতো ঠান্ডা পড়েছে এবার । ভাল্লাগেনা থাকতে ।
-আমি জানি ।
-জানো?
-জ্বি । আপনার ফেরার অপেক্ষায় ছিলাম । ফিরেছেন জেনেই আমি এসেছি ।
এবার তিনি স্পষ্ট করে আমার দিকে তাকান । কন্ঠ একটু ও না কাঁপিয়ে বলেন
-ঠিক কি কাজে তুমি এসেছো, বলোতো?
আমি বুকের একটু গভীরে বাতাস টেনে নেই । ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে বলি
-একটা ডকু ফিল্ম বানাতে যাচ্ছি । আপনার সাহায্য দরকার । ইনফ্যাক্ট আপনার সাহায্য ছাড়া আমি পারবোনা । সেজন্য আপনার লন্ডন থেকে ফেরার অপেক্ষায় ছিলাম ।
তিনি হেসে উঠেন
-তোমার ফিল্ম বানাতে আমি সাহায্য করবো? কি সাহায্য করবো বলোতো? নানী-দাদীর ক্যারেক্টার করতে হবে? আমি জীবনে ও অভিনয় করিনি ।
তার হাসিতে আমি ও হাসি
-৩০ বছর আগে জন্ম নিলে আপনাকে আমার ফিল্মের নায়িকা বানাতাম ।
এবার আমরা দুজনেই একসাথে হেসে উঠি ।
হাসির রেশ থামার আগেই আমি জরুরী কথাটা বলে ফেলি
-একসময়ের বিখ্যাত একজন কবি’কে নিয়ে আমি ফিল্ম করতে চাচ্ছি । তার জীবনের জরুরী কিছু বিষয় আপনার সাথে জড়িত । এ গুলো আমার জানা দরকার ।
খুব স্থির কন্ঠে তিনি বলেন
-কার কথা বলছো তুমি?
-কবি রায়হান মুস্তাফিজ ।
-তুমি কে?
-আমি তার ছেলে ।
তিনি আর্তনাদের মতো আমার অগ্রজের ডাক নাম উচ্চারন করেন ।
-ও আমার বড় । খুব ছোটবেলায় আপনি ওকে দেখেছেন । আমার জন্ম তার পরে । আমরা তখন এ শহর ছেড়ে চলে গেছি ।


কাজের লোক ট্রলি ভর্তি নাস্তা নিয়ে ঢুকে । আমাদের কথায় স্তব্দতা নেমে আসে । তিনি আমাকে গাজরের হালুয়া এগিয়ে দেন । আমি নাড়াচাড়া করতে থাকি ।
কাজের লোক বেরিয়ে গেলে তিনিই আবার কথা শুরু করেন
-তোমার বাবা আমার কথা বলেছে?
-না । মা ।
- ও । কেমন আছেন তিনি?
-মা মারা গেছেন চার বছর আগে ।
- আমি দুঃখিত ।
-না ঠিকাছে । মারা যাওয়ার আগের দুবছর মা বিছানায় পড়েছিলেন । বড় ভাই কানাডায় চলে গেছে । বাবা ও তার মতো সময় কাটাতো । একমাত্র আমি মায়ের পাশে বসে থাকতাম । সেই সময়ে প্রথম আপনার কথা শুনি । মা অনেক গল্প করতো আপনার ।
-তোমার মা খুব ভালো ছিলেন ।
-আপনার তো বান্ধবী ছিলেন ।
-এক সাথে পড়েছি ।
কথা আবার থমকে যায় । তিনি বাবার কথা জিজ্ঞেস করেননা । তার জানতে ইচ্ছে করেনা নাকি অস্বস্তি?
-মায়ের মৃত্যুর পর বাবা ও চলে গেছে বড়ভাই এর কাছে । কিডনীর সমস্যায় ভুগছে ।
-ও
-বাবার সাথে আমার কখনোই তেমন ঘনিষ্ঠতা হয়নি । মা বিছানায় শুয়ে শুয়ে এতো গল্প করতো মানুষটাকে নিয়ে, পরে মনে হলো তাকে নিয়ে একটা ফিল্ম করা যায় ।
-তোমার মায়ের কাছে আর কি শুনেছো?
-বাবা এবং আপনার দীর্ঘসম্পর্ক ছিলো । আপনি চমৎকার গান গাইতেন আর কবি হিসেবে বাবার খ্যাতি ও ছড়াতে শুরু করেছে, সাথে ভালো চাকরী । প্রথম দিকে কিছুটা আপত্তি থাকলে ও শেষপর্যন্ত দু পরিবারের সম্মতি ছিলো । ছোট্ট মফস্বল শহরে আপনারা ছিলেন আদর্শ জুটি । কিন্তু…
-শেষ পর্যন্ত আমাদের বিয়ে হয়নি ।
-ঠিক এই বিষয়টাই আমি জানতে চাইছিলাম ।
-কেনো তোমার মা তোমাকে বলে যাননি?
আভিজাত্য ও স্নিগ্ধতা জড়ানো কন্ঠে তার এই প্রথম আমি কিছুটা শ্লেষের ইংগিত পাই ।
-না । এটা মায়ের কাছে ও রহস্য ছিলো ।
-তিনি তোমার বাবার বিবাহিত স্ত্রী ছিলেন ।
-মা আপনার বান্ধবী ছিলেন
-আমরা একসাথে পড়েছি ।
-যাইহোক । আপনি তো জানতেন তাকে । অতোটা সপ্রতিভ কখনোই ছিলেন না । নিজের ভেতর গুটিয়ে থাকতেন । বাবার সাথে ও তাকে আমরা খুব বেশী কথাবার্তা বলতে দেখিনি ।
-কিন্তু তোমার বাবা তো তাকেই বিয়ে করেছিলেন
-হ্যাঁ । আমার মায়ের কাছে ও এটা শেষদিন পর্যন্ত রহস্য ছিলো বাবা কেনো শেষপর্যন্ত তাকে বিয়ে করেছিলেন ।
-তাই নাকি? ভালো ।
আমি টের পাই একটা জটিলতা স্পর্শ করছে তাকে । আমি যা জানতে চাইছি তার বদলে কথাবার্তা চলে যাচ্ছে একজন প্রয়াত ও দুজন প্রায় বৃদ্ধ মানুষের বিগত যৌবনের হিসেব-নিকেশে । এখানে দাঁড়িয়ে আমি কার প্রতিনিধিত্ব করছি ? আমার মৃত নিস্প্রভ মায়ের,মৃত্যুর মুহুর্ত পর্যন্ত গুনী স্বামীর প্রতি যার অগাধ মুগ্ধতা ছিলো নাকি আমার সংস্পর্শহীন বাবার যাকে আমাদের কোনদিন তেমন করে বুঝে উঠা হয়নি ?
কিন্তু আমি তো এসব থেকে নিজেকে আলাদা রেখে প্রফেশনালী কিছু তথ্য জানতে চাই শুধু ।
আমি সমস্ত অস্বস্তি ঝেড়ে ফেলে এবার সরাসরি তাকে জিজ্ঞেস করি
-কবি রায়হান মুস্তাফিজের সাথে শেষপর্যন্ত আপনার বিয়েটা হলোনা কেনো? আমার ফিল্মের জন্য এই তথ্যটা জরুরী । প্লিজ আপনি ইজিলি আমাকে বলেন, সমস্ত প্রস্তুতি শেষে ও কেনো রায়হান মুস্তাফিজ বিয়েটা ভেংগে দিলেন ?
ঢং করে আওয়াজ দিয়ে না উঠলে আমি খেয়ালই করতাম না ঘরের দেয়ালে একটা বিশাল ঘড়ি । তার পেন্ডুলাম দুলছে ।
ঠোঁট কামড়ে তিনি উঠে দাঁড়ালেন । তার মুখের রঙ এতোটা সাদা আগে খেয়াল করিনি ।
-আছরের ওয়াক্ত হয়েছে, আমি নামাজ পড়তে যাচ্ছি । তুমি নাস্তাটা শেষ করে যেও ।


তিনি তার সমস্ত আভিজাত্য ও স্নিগ্ধতা নিয়ে চলে গেলে আমি স্থির দাঁড়িয়ে থাকি । পুরনো দিনের বিশাল দেয়াল ঘড়ির কাটাগুলো টিক টিক করে । বছর পঁয়ত্রিশ আগের সদ্য তরুনীকে আমার দেখতে ইচ্ছে জাগে । মফস্বল শহরের তার সৌন্দর্য্য রুপকথার মতো ছড়িয়ে বেড়াতো । মৃত্যুশয্যায় শুয়ে শুয়ে ও আমার মা সেই গল্প বলতেন । তার বলায় কোন হিংসা ছিলোনা । স্বামীর সাবেক প্রেমিকার জন্য তার নিজের ও মুগ্ধতা ছিলো । নাকি এই প্রসিদ্ধ সৌন্দর্য্যকে অস্বীকার করে বাবা তাকেই বিয়ে করেছিলেন বলে আমার অপ্রতিভ, গুরুত্বহীন মায়ের গোপন অহংকার ছিলো?
বাবা লোকটা চিরদিন আমার কাছে বিরক্তিকর এক রহস্য থেকে গেলো । আমি তার মতো এতোটা নির্মোহ, নিমগ্ন অথচ অন্যদের কাছে গুরুত্বপূর্ন হয়ে উঠতে পারলাম না । মায়ের প্রতি তার কোন মনোযোগ ছিলোনা তবু মায়ের কি অসীম মুগ্ধতা ছিলো এই মানুষটার জন্য। দীর্ঘ সম্পর্কের পরিনতিতে বিয়ের সমস্ত আয়োজন শেষে যে প্রেমিক অস্বীকৃতি জানায় তার জন্য ও এই ধ্রুপদী সুন্দরীর এতো অভিমান?
লোকটাকে আমার অসহ্য ঠেকে ।
-তোমার বাবার বিরহের শখ জেগেছিলো । তার কবিত্বের পূর্নতার জন্য নাকি ওটা জরুরী ছিলো
আমি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে দেখি । তিনি ভেতরের সিঁড়ি ভেংগে নেমে এসেছেন আবার । এবার তাকে অনেকটা স্থির দেখাচ্ছে,যদি ও চোখ দুটো লাল হয়ে আছে ।
-জ্বি!
-হ্যাঁ, তুমি তো এটাই জানতে চেয়েছিলে । বড় কবি হওয়ার লোভে তোমার বাবা আমাকে বিয়ে করেননি । তিনি বড় কবি হয়েছেন ।
-ও
আমি কোন ভাষা খুঁজে পাইনা ।
-আমাদের যেদিন আনুষ্ঠানিক ভাবে বিয়ের দিনতারিখ ঠিক হবার কথা সেদিনই তিনি আমাকে জানিয়েছিলেন, কবি হওয়ার জন্য তার বিরহের অভিজ্ঞতা খুব জরুরী । যেনো আমি তাকে সেই অভিজ্ঞতা দান করি । তোমাকে বাবাকে আমি বড় কবি হবার জন্য বিরহ দান করেছিলাম
আমার কাছে সবকিছু পাজলের মতো লাগে । তার দিকে আমি চোখ তুলে তাকাতে পারিনা । যেনো রোমান সম্রাজ্ঞীর দারুন গরিমা নিয়ে তিনি এক কবিযশপ্রার্থী অপরিপক্ক তরুনকে মৃত্যুদন্ড দান করছেন ।
এই গরিমা, তার কন্ঠের তেজ আমার কাছে অসহ্য লাগে ।
-তোমার সিনেমাটা বানানো হলে আমাকে জানিও । বহুদিন সিনেমা দেখিনি । কি নাম দেবে সিনেমার?
বাহ। মুহুর্তের মধ্যে আমি আমার না বানানো সিনেমার নাম খুঁজে পাই । এই নামই হবে গরিমাময়ী সম্রাজ্ঞীর বিরুদ্ধে আমার সামান্য অস্ত্র ।
- সিনেমার নাম হবে ‘কবি ও প্রেমিকা গন’
-প্রেমিকা গন ! ‘গন’ কেনো?

আমার অস্ত্র তবে একেবারে ভোঁতা নয় । তারদিকে আর না তাকিয়ে বাইরে দরজার দিকে পা বাড়িয়ে বলি
-কারন কেবল আপনিই কবি রায়হান মুস্তাফিজ এর একমাত্র প্রেমিকা ছিলেন না ।
আমি তার দিকে তাকাইনা আর ।
কিন্তু তার নিচু কন্ঠের স্পষ্ট উচ্চারন শুনি
-তুমি তোমার বাবার মতোই হয়েছো ।
সম্রাজ্ঞীর আহত কন্ঠ কেমন গোঙ্গানীর মতো শোনায় । বেদনাহত । আমি চোখ নিচু করি ।
কোন কোন দূরত্ব এতো অনতিক্রম্য হয়ে উঠে কেনো?

গদ্য / চিন্তন

অচিন পাখি
সংকলন : মৃত্তিকা দাস

এই প্রবন্ধের শরীরে গাথা আছে বিভিন্ন কথা, লেখা, কথোপকথন। একটা পথ চলার সাক্ষী এ লেখা। সে পথ নিস্তব্ধ, গভীর, নির্জন। একটা ছটফটানি হাতছানি, ব্যস আর বুঝতে পারি না। দেখতে পাই না এ দু'নয়নে। ভিতরের কোন এক নাছোড় বান্দার ফরমায়েশে তৈরি হয়ে চলে এ লেখা। আর আমি হাঁটতে থাকি শুধু নিজের ভিতরে, আরো গহীনে অচীন পাখির সাক্ষাৎের আশায়। এই লেখার প্রথম অংশ আবু ইসহাক হোসেন-এর লেখা,দ্বিতীয়-তৃতীয় অংশ মোমেন মাঝি-র লেখা এবং শেষ অংশে প্রদোষ কান্তি সরকার-এর লেখা ধারণ করতে পেরে কৃতজ্ঞ। প্রতিটি লেখার কর্তিত রূপ এখানপ ব্যবহৃত হয়েছে।

বাউল শব্দের উৎপত্তি ও অর্থ
ব্যবহারগত দিক দিয়ে বাউল শব্দটির ইতিহাস খুব প্রাচীন নয় বলে গবেষকদের অধিকাংশের মত। তাদের মতে বাংলা সাহিত্যে বাউল শব্দের ব্যবহার আমরা লক্ষ করি মালাধর বসুর ‘শ্রীকৃষ্ণ বিজয়’ কাব্যের মাধ্যমে। মালাধর বসু তাঁর কাব্যে উপমা হিসেবে বাউল শব্দটি এভাবে ব্যবহার করেছেন,
‘মুকুল মাথার চুল/নাংটা যেন বাউল/রাক্ষসে রাক্ষসে বুলে রণে।’
বাউল শব্দটির ব্যবহার আরো ব্যাপক অর্থে আমরা লক্ষ করি ‘চৈতন্য চরিতামৃত’ কাব্যে। সেখানে বাউলের ছবি আঁকতে গিয়ে বাউলকে এভাবেই বর্ণনা করা হয়েছে,
‘বাউলকে কহিও লোক হইল আউল /বাউলকে কহিও হাটে না বিকায় চাউল /বাউলকে কহি কাযে নাহিক আউল /বাউলকে কহিও ইহা করিয়াছে বাউল’
মোটামুটিভাবে বলা যায় পঞ্চদশ শতকে বাউল শব্দটা আমাদের গোচরে আসে। বাউলরা তাদের আদিপুরুষ হিসেবে বীরভদ্রকে মানে যার জীবনকাল ছিল (১৪৭৩-১৫৪৪)। এ প্রসঙ্গে ডক্টর এম.এ. রহিম তার বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস গ্রন্থে বলেন, বাউলগণ নিত্যানন্দের পুত্র বীরভদ্রকে তাদের প্রথম গুরুরূপে অভিহিত করে এবং বিশ্বাস করে যে, তিনি মাধব বিবি নামক জনৈক মুসলমান রমণীর কাছ থেকে বাউল ধর্মমত শিক্ষা করেন’ । এসব তথ্যের উপর নির্ভর করে বলা যায় যে বাউল শব্দের আবির্ভাব পঞ্চদশ থেকে ষোড়শ শতকের মধ্যে।
বাউলমতের উদ্ভব নিয়ে যেমন চূড়ান্তভাবে কিছু বলা যায় না তেমনি বাউল শব্দটির উদ্ভব নিয়ে রয়েছে নানা মুণির নানা মত। কোন কোন গবেষকের মতে সংস্কৃত ‘ব্যাকুল’ বা ‘বাতুল’ শব্দ হতে বাউল শব্দের উৎপত্তি যার অর্থ হলো উন্মাদ, পাগল। আবার কারো কারো মত হিন্দি ‘বাউর’ শব্দ থেকে বাউল শব্দটি বাংলায় এসেছে যার অর্থ হলো পাগল। ড. এস এম লুৎফর রহমান বাউল শব্দের উদ্ভবের ইতিহাস ঘাঁটতে গিয়ে চর্যাগীতি রচনার কথা উল্লেখ করে দেখিয়েছেন যে বাউল শব্দটি একটা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে বর্তমান আকারে এসেছে। তিনি মনে করেন বাজির, বাজ্জিল, বাজুল এগুলি বাউল শব্দের আদিরূপ। তার মতে বাউল শব্দটির বিবর্তনের ক্রমপর্যায় এমন -- বাজ্রী-বাজ্জির-বাজির-বাজ্জিল-বাজিল-বাজুল-বাউল। বিবর্তনের বিভিন্ন পর্যায়ে শব্দটির রূপ ভিন্ন হলেও এর অর্থের কোন হেরফের হয়নি। এক্ষেত্রেও বাউল বলতে ভাবে উন্মাদ বা পাগলকেই বোঝানো হত। কিছু কিছু পণ্ডিতের মতে বাউল শব্দটি উৎপত্তিগতভাবে বাংলা। অর্থাৎ বাংলা থেকে বাউল শব্দের উৎপত্তি।
ড. আনোয়ারুল করীম-এর মতানুসারে বাউল শব্দের উৎসভূমি পারস্য। তিনি বলেছেন, মরুভূমিতে এখানে-সেখানে বিচরণকারী সংসারত্যাগী একশ্রেণীর সঙ্গীতাশ্রয়ী, সুফী সাধক বা ‘আল’ অথবা ‘বউল’ নামে পরিচিত ছিল। এরা অধ্যাত্মবাদী এবং এদের সাধনপদ্ধতি ছিল গুপ্ত ও যৌনাচারভিত্তিক। আমাদের আলোচ্য বাউল সম্প্রদায় পারস্যের এই ‘আল’ বা ‘বউল’ সম্পদায়ের উত্তরসূরি’ । তিনি বাউল শব্দের বাংলায় প্রথম ব্যবহার বিষয়েও ভিন্ন মত পোষণ করে বলেছেন, চর্তুদশ শতকে শাহ মুহাম্মদ সগীরের ‘ইউসুফ জোলেখা’ গ্রন্থে সর্ব প্রথম এই ধর্মীয় সাধকদের ‘বাউল’ এবং ‘বাউর’ নামে চিহ্নিত করা হয়েছে’।
বাউল শব্দের উদ্ভব ও বিকাশের ইতিহাস যা-ই হোক সর্বক্ষেত্রেই এটা একই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে এ ব্যাপারে কারো কোন দ্বিমত নেই। অর্থাৎ বাউল বলতে এমন এক ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমষ্টিকে বোঝায় সমাজের চোখে যারা নি:স্ব এবং পাগল। তাদের কোন সামাজিক মর্যাদা নেই, বিষয় সম্পত্তি বা সামাজিক প্রতিপত্তি বলতে কোন কিছুই নেই। তাদের কোন স্খায়ী বসতবাড়ি নেই। তারা একস্খান হতে অন্য স্খানে ঘুরে বেড়ায় এবং পরান্নে জীবন ধারণ করে বেঁচে থাকে। বাউল সে যে সমাজেরই হোক তার বৈশিষ্ট্য, জীবনযাপন প্রণালী, সমাজে তার সামাজিক অবস্খান একই। ড. আনোয়ারুল করীম তার ‘রবীন্দ্রনাথ ও বাংলার বাউল’ গ্রন্থে বলেন, একশ্রেণির সাধক যারা ‘ফকির’ বলে পরিচিত এবং পেশায় ভিক্ষজীবী, সাধনসঙ্গিনী নিয়ে এক অঞ্চল থেকে আর এক অঞ্চলে গান গেয়ে ফেরে, সমাজে যাদের পরিচয় অতি সাধারণ, অর্থাৎ যারা অন্ত্যজ, তাদেরকে বাউল বলা হয়ে থাকে। মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যে বাউল সম্প্রদায়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে সেখানে তারা সামাজিকভাবে নিন্দিত’।
বাউল সম্প্রদায়ের বিকাশ এবং বিস্তারের সর্বশেষ পর্যায়ের পর্যালোচনায় দেখা যায় বাংলাদেশে সংসারত্যাগী বাউলের পাশাপাশি গৃহী বাউলেরও উদ্ভব হয়েছে। তবে তাদেরও সামাজিক অবস্খান ও মর্যাদা সমাজে খুবই হীন। তাই দেখা যায় বাউল সে গৃহী বাউল হোক আর গৃহত্যাগী বাউলই হোক সমাজের তাদের অবস্খান একেবারেই নিম্নস্তরে।

একভাণ্ড ইতিহাস ও দর্শন
চৈতে-নিত্যে-অদ্বৈ এই তিন পাগলের ভাবশিস্য বাউল ধর্মের শিরোমনি সিদ্ধপুরুষ ফকির লালন শাহ (বাঙালির ধর্ম প্রচারক) কলিকালের অবতার চৈতন্য।জাত-পাতের যাঁতাকলে পিষ্ট দরিদ্র মানুষের গৌরাঙ্গ, জাতহীন। নারী পুরুষ এক দেহে ধারণ করে আবির্ভূত।সিদ্ধপুরুষ লালন বাংলা ও এর বাইরে থেকে আসা সমস্ত মতবাদ আত্তীকরণের সর্বোচ্চ বঙ্গীয় প্রকাশ।
সমগ্র সিন্দ্ধু ও গাঙ্গেয় উপত্যকা তথা ভারতবর্ষ হাজার হাজার বছর ধরে ধারণ করছে অসংখ্য মানবের জীবন।নৃতাত্বিকভাবে জন্ম হয়েছে অনেক ভাষা, সংস্কৃতি বা এর বিশেষ রূপ ধর্ম।শত শত ধর্মীয় সম্প্রদায়ের হাজারো রীতি-নীতি, আচার-অনুষ্ঠান, পূজা-অর্চনার যে সনাতনী সংস্কৃতি তাই পরবর্তিতে হিন্দু ধর্ম নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।পারসিয়ান ও আরবীয়রা মশলার ব্যবসাসূত্রে ভারতের সাথে পরিচিত হয়। এবং সিন্দ্ধু অঞ্চলের মানুষদেরকে সিন্দ্ধ্ বা ইন্দু বা হিন্দু বলে তারা অভিহিত করে ফলশ্রুতিতে তাবত দুনিয়ার মানুষের কাছে ভারতীয়রা হিন্দু ও তাদের সংস্কৃতি বা ধর্ম হিন্দু ধর্ম নাম লাভ করে বলে অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মত। বহুবিধ তণ্ত্র-মণ্ত্র- ডাক-যোগ দর্শনের প্রকাশ্য ও গোপন চর্চা অথবা কপিল, বৃহস্পতিদের বস্তুবাদী চার্বাক দর্শনের অভূতপূর্ব ভূমি ভারত। ভিন্ন ভিন্ন ধর্মীয় বা দার্শনিক সম্প্রদায়ের সহ অবস্থানের ফলে জীবনাচরনের মিলন, ভিন্নতা, ধর্মের ক্রমবিকাশ, নতুন নতুন ধর্মের আবির্ভাবে ভারত যেন এক গরম তাওয়া ।এখানে উদ্ভুত বৌদ্ধ ধর্ম পারস্য, মধ্যপ্রাচ্য আর মধ্য এশিয়া বাদ দিলে সমগ্র এশিয়ায় প্রভাব বিস্তার করে।ভারতীয় ধর্ম বিস্তারিত হয়েছে অর্থাৎ রাষ্ট্রক্ষমতা ছাড়া ধর্মের অনুপ্রবেশ ঘটেছে ফলে ব্যক্তি বা ভাষা সম্বন্ধী ধর্মসমূহ প্রবাহিত হয়েছে। অর্থাৎ রাষ্ট্রক্ষমতা ও ধর্ম অনুপ্রবেশ করেছে যুগপৎভাবে।দার্শনিক এই অবস্থানের কারণেই হয়তো ভারতীয়রা উপনিবেশ গড়ে তুলে নি কখনো কিন্তু উপনিবশিত হয়েছে বার বার।উপনিবেশকারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল মোগল আর ইংরেজরা।
সপ্তম শতকের তিরিশের দশকে মক্কা জয়ের পর আরবরা ইসলামের দর্শন হাতে নিয়ে দিগ্বিজয়ে বের হয় এবং ইসলাম ধর্ম প্রবাহিত হয়ে পশ্চিম দিকে মরোক্ক পর্যন্ত। পুরানো সকল সংস্কৃতির খোলনলচে পালটে ফেলে এমন কী মুখের ভাষা পর্যন্ত প্রতিস্থাপিত করে কায়েম করে আরব বিশ্ব।এ প্রবাহের অতিরিক্ত সংযোজন স্পেন। এরপর ফ্রান্সের গলে গিয়ে ক্ষান্ত হয় আরবদের পশ্চিমমুখী যাত্রা। পূর্ব প্রবাহ ব্যাপকভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয় পারস্যে।পারসিক সংস্কৃতির কাছে মুষড়ে পড়ে আরব সংস্কৃতি।ইরানে ইসলাম রূপান্তরিত হয়। ইরানের পার্শ্বে বাগদাদ দীর্ঘ দিন ইসলামের কেন্দ্রবিন্দু ছিল।আব্বাসীয়রা মুতাজিলাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। ইসলামে যৌক্তিকভাবে আল্লার উপস্থিতি প্রমাণে প্রভাব বিস্তারকারী মুতাজিলারা ব্যর্থ হলে প্রভাব বিস্তার করে সুফীজম।যার উর্বর ভূমি হলো পারস্য বা ইরান।
সপ্তম শতক থেকে শুরু করে ত্রয়োদশ শতকে এসে মুসলমানরা মোটামুটি পুরো ভারতবর্ষ দখল করে।কিন্তু ততোদিনে ইরানের দেয়ালে ধাক্কা খাওয়া ইসলাম অনেকটা ভিন্নরূপে যা কীনা প্রধানত ইরানের সুফীদের দ্বারা প্রচারিত হয় ভারতে।মোহাম্মদ ও খোলেফায়ে রাশেদীনের পরে যে নামগুলেো শুনা যায় তা হল‌ –-- বড় পীর আব্দুল কাদের জিলানী, খাজা বাবা মইনূদ্দীন চিশতী, বাবা ফরীদ, নিজাম উদ্দীন আউলিয়া, শাহ জালাল ইত্যাদি যারা সকলেই সুফী।পারস্য আর মধ্য এশিয়া থেকে ঝাকে ঝাকে পীর-আউলিয়ারা ভারতে ধর্ম প্রচার করে যাকে বলা যায় ইসলামের বিস্তার।
মরমি কবি ফকির লালনকে জানার চেষ্টার প্রারম্ভে পদ্মা-মেঘনা-যমুনা বিধৌত ব-দ্বীপের অনিশ্চিত কৃষিভিত্তিক দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবন এবং সনাতনী তথা হিন্দু, বৌদ্ধ এবং ইসলাম এই তিন ধর্মের মিথষ্ক্রিয়ার মানস জগৎ বিবেচনায় রাখা দরকার। হিন্দু ধর্মজাত বৈষ্ণব ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্মের সহজিয়া মতবাদ, ইসলামের সুফী মতবাদ বাংলায় যা মূলত মারেফত বা মাইজভাণ্ডারী নামে পরিচিত -- এই তিন মূল ধারার মিলনের ফলে উদ্ভূত বাংলার ধর্ম হলো বাউল ধর্ম।
বাউল একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়।বাউলদের ধর্মের তত্ত্ব ও দর্শন আছে, সাধন পদ্ধতি আছে, সাধক জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা আছে, জগৎ ও জীবন সম্পর্কে তাদের একটি দৃষ্টিভঙ্গি আছে, এ সমস্তই ব্যক্ত হয়েছে তাদের গানে।এই সম্প্রদা্য়ের সাধকগণের তত্ত্ব দর্শন ও সাধনা সংবলিত গানই বাউল গান।রূপ থেকে স্বরূপে ওঠাই বাংলার বাউলদের সাধনা। কীভাবে পুরূষ-প্রকৃতি ( জীবাত্মা-পরমাত্মা/ নারী-পুরুষ) বিভক্ত হ'ল এবং কীভাবে দুই দেশে না থেকে একত্রে রইল। পদ্ম কোথায় প্রস্ফুটিত হয়, পদ্ম পুস্পের রসে কীভাবে সাধন হয় এবং সহস্রদল হতে রজঃস্রোতের সঙ্গে রসরাজ লীলা করতে করতে অগ্রসর হয়ে তিন দিন তিন রূপ ধারণ করে শেষে সহজ মানুষ রূপে আত্মপ্রকাশ করেন।তারপর প্রকৃতি-পুরুষের শৃঙ্গার দ্বারা উর্ধ্বগত হয়ে স্বস্থানে গিয়ে যুগল হয়ে নিত্যরস লীলা আস্বাদন করেন -- বাউল সাধনার মূলভাবটি মোটামুটি এর মধ্যে ব্যক্ত। এর থেকে বোঝা যায় বা্উল সাধনা নারী-পুরুষের যৌথ সাধন পদ্ধতি।
অদ্বৈতাচার্য ও নিত্যানন্দ প্রকৃতি-পুরুষ মিলন ঘটিত ধর্মসাধনার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। নিত্যানন্দের পুত্র বীরভদ্রের সময় হতে বাউলরা সম্প্রদায় হিসেবে প্রকাশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং গুরু পরম্পরায় ব্যাপ্ত হয় সারা বাংলায়।
বাউল সাধনার তিন স্তর। প্রবর্ত -- ভগবানের নিকট দৈন্য ও গুরুর করুণা প্রার্থনা। সাধক -- দেহতত্ত্ব, মনের মানুষ, সাধনার স্বরূপের জ্ঞান লাভ। সিদ্ধ –-- সাধনার পূর্ণতার স্বরূপ। ফকির লালন ছিলেন সিদ্ধপুরুষ। বিশাখা লালনের সাধিকা।

লালন তথা বাউলদের যৌন সাধন
বাঙালির কাছে যৌনতা বিষয়টি অনেক বড় ট্যাবু।নিয়মিত যৌন কাজে লিপ্ত হবে কিন্তু মুখে বলবেনা। চিন্তা করুন লালনের জীবন কাল আঠার শতকের শেষের দিক থেকে উনিশ শতক, সমগ্র ভারত বৃটিশদের দখলে। তথাকথিত মুসলমানদের (মোঘল) হাত থেকে নাছারারা ক্ষমতা দখল করেছে, মুসলমানরা জাত যাওয়ার ভয়ে শিক্ষা-দীক্ষা বাদ দিয়ে না বুঝে কোরান মুখস্ত করে জাত রক্ষায় ব্যস্ত।হিন্দুরা জাত-পাতের ঘেরাটোপ আর ইংরেজি শব্দ মুখস্ত করে অফিসের কেরানী বা বাবুগিরির মধ্যে ঘোড়পাক খাচ্ছে। এমন সমাজে সম্পুর্ণ ভিন্ন স্কুল হল বাউলদের।
আধ্যাত্বিকতার চর্চায় মানবদেহকে ঈশ্বরের আবাস (বারামখানা) মনে করে বলে বাউলরা দেহ্তত্ত্বে ব্যাপক জ্ঞান অর্জন করে। লালনের গানের বিশাল অংশ জুড়ে দেহতত্ত্বের গান। দেহ থেকে দেহে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ঈশ্বরের ধারাবাহিকতায় সঙ্গম বা নারী-পুরুষের মিলন বাউলদের সাধনার মূল কেন্দ্রবিন্দু।
লালনের সময়কালে বা তার আগে পরে বাউলরা সবসময় নিজেদের সাধন পদ্ধতির ব্যাপারে গোপনীয়তা রক্ষা করত। যেহেতু তাদের আখড়ায় অনেক সাধিকা থাকতো এবং বাইরের মানুষকে তারা নিজেদের জীবনাচরণ বলতোনা ফলে সহজেই নানারকম কুৎসা রটনা করেতে পেরেছে নিন্দুকেরা। আবদ্ধ সমাজে যৌনতা বিষয়ে গুজব ছড়ানো খুবই সহজ। আর বিশাল এই সম্প্রদায়ের কোথাও কোথাও নাকি বিপথগামী কিছু বাউল আখড়ার পাশে পতিতালয় গড়ে নিতো। এটি মূল ধারা নয়।
এবার আসা যাক সোজা কথায় তাদের সাধনা কী? লালনের গানে প্রায়ই শোনা যায় 'সহজ মানুষ' বা 'অটল রূপ' 'মনের মানুষ' 'অচিন পাখি' বা আলেকজনা এর দ্বারা কী বুঝায়? খুব সহজ ভাবে বললে এর দ্বারা গুরু, মুর্শিদ, রাসুল, আদম, ভগবান, আল্লা, ঈশ্বর ইত্যাদিকে বুঝায়। কিন্তু লালন ঈশ্বরের সর্বোচ্চ রূপ মানবদেহের প্রানের ধারার সাথে কীভাবে মিশে থাকে সে রহস্য উৎঘাটনে সচেষ্ট ছিলেন। লালন তথা বাউলদের এ লক্ষ্যে সাধন পদ্ধতির সম্পর্কে যৎসামান্য জানা যায়।
পুরুষের বীজ আর নারীর রজঃ মিলিত হয়ে মানবের জন্ম। আর এই দু'য়ের উৎপত্তি সঙ্গমকালে। যৌন উত্তেজনার চুড়ান্ত পর্যায়ে সহজ মানুষ বা ঈশ্বরের অটলরূপ উপস্থিত হয়। বাউলরা এই স্তরে পৌঁছে স্থির থেকে সাধন করতে চায়। কাম নদীর নিন্মমুখী ধারাকে ঊর্ধমুখী করে যারা দীর্ঘক্ষণ ধরে অরগাজমে থেকে সহজ মানুষ সাধন করতে পারে তারা হলো সিদ্ধ পুরুষ।ফকির লালন একজন সিদ্ধপুরুষ।এবার দেখা যাক লালন তার গানে কী বলছেন:
আমি কী সন্ধানে যাই সেখানে
মনের মানুষ যেখানে।
আঁধার ঘরে জ্বলছে বাতি
দিবা রাতি নাই সেখানে।

যেতে পথে কাম নদীতে
পারি দিতে ত্রিবিণে (ত্রিবেণী)
কত ধনীর ধারা যাচ্ছে মারা
পইড়ে নদীর তোড় তুফানে।

রসিক যারা চতুর তারা
তারাই নদীর ধারা চিনে
উজান তরী যাচ্ছে বেয়ে
তারাই স্বরূপ সাধন জানে।

লালন বলে মইলাম জ্বলে
মইলাম আমি নিশি দিনে
আমি মনিহারা ফণির মতো
হারা হলাম পিতৃধনে।
এমন অসংখ্য গানে গানে লালন বা বাংলার অন্যান্য বাউলরা নিজেদের প্রেম, কাম, সাধনের কথা বলে গেছেন। রূপ (ঈশ্বর বা পরমাত্মা) থেকে স্বরূপে (মানব ও ঈশ্বর লীন) ওঠাই বাংলার বাউলদের সাধনা।
ছোটবেলা থেকে শুনতাম আল্লা থাকে সাত আসমানের উপরে।মনে করতাম আমরা তো এক আসমান দেখি তার উপরে বুঝি বাকীগুলো। বিজ্ঞানের হাতেখড়িতেই গ্রহ নক্ষত্র ইত্যাদি পড়ে সব কিছু কেমন যেন হয়ে গেল। হিসেব মেলে না। ছোট বেলাতেই গ্রামের লোকজনের মুখে শুনেছি 'খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়... আট কুঠুরী নয় দরজা...।' কার গান কী বলছে কিছুই বুঝতাম না। কাউকে জিজ্ঞেস করলে আমাদের দেহে আত্মার যাওয়া আসা পর্যন্ত উত্তর মিলতো।কিন্তু কোথায় আট কুঠুরী নয় দরজা বা সাত আসমান?
বাউলদের সম্পর্কে জানা খুবই কঠিন কাজ। বলা হয়ে থাকে 'শম্ভুকের মতো আত্মসংকোচনশীল, আত্মগোপনশীল জীবন যাত্রার রীতি এই বাউলদের'। বাউলরা তাদের আধ্যাত্বিকতায় ব্যবহার করেছে ভারত পারস্য ও আরবের মিথ।ভারত হল মিথের মক্কা। ফলে ধর্মের তত্ত্ব ও মিথের সহযোগিতায় তাদের সম্পর্কে কিছু ধারণা করা যেতে পারে। লালনের খুবই পরিচিত একটি গানের কথায় আসা যাক:
ধন্য ধন্য বলি তারে
বেঁধেছে এমনও ঘর শুন্যের উপর
আ মরি শুন্যের উপর পোস্তা করে
ধন্য ধন্য বলি তারে।
খুব সুন্দর বোঝা যাচ্ছে ঈশ্বর তার বারামখানা এই মানব দেহ শক্ত করে তৈরী করেছে। কিন্তু কোথায়? শুন্যের উপর। শুন্য কী? বিজ্ঞানে এর কোন সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। যে কোন কিছুকে আমরা আপেক্ষিকভাবে শুন্য ধরতে পারি। শুন্যের জন্মভূমি ভারত। বুদ্ধের মূল দর্শনই হলো শুন্যবাদ। নাগার্জুন শুন্য সম্পর্কে বলেছেন " অস্তি-নাস্তি-তদুভয়ানুভয়চতুষ্কোটি বিনির্মুক্তং শুন্যরূপম"। সহজ ভাবে বললে দাঁড়ায়:
আছে যে তা নয়
নাই যে তাও নয়
আছে নাই উভয়ই তাও নয়
আছে নাই উভয়ই যে নয় তাও নয়।
এই চার মুক্ত কোন কিছু হলো শুন্য। এরই উপর ঈশ্বর পোস্তা করে ঘর বেঁধেছে। তাই ফকির লালন বলছেন ধন্য ধন্য বলি তারে। পরের স্তবক:
ঘরে মাত্র একটি খুঁটি
খুঁটির গোড়ায় নাইকো মাটি
কিসে ঘর রবে খাড়ি
ঝড়ি-তুফান এলে পড়ে।
ঘরের একটি খুটি বলতে কী বোঝায়? প্রাণিবিজ্ঞানে পড়েছি সমস্ত প্রানিজগতকে মোটা দাগে দুভাগে ভাগ করা যায় মেরুদণ্ডী, অমেরুদণ্ডী।এই মেরুদণ্ড প্রাণির বিবর্তনের খুবই বড় একটি ধাপ। মেরুদণ্ডের কশেরুকার ভিতর দিয়ে তিনটি স্নায়ু পেচিয়ে পেচিয়ে (কুণ্ডলী স্ত্রীবাচক কুণ্ডলিনী) মাথায় গিয়ে মিলেছে। যা ভারতীয় তান্ত্রিকদের কাছে অনেক সময় ত্রিবেণী নামেও পরিচিত। সুষুন্মা, ইড়া,পিঙ্গলা। সুষুন্মা অক্ষের মতো যাকে পেচিয়ে বাকি দুটি। ইড়া বাম শুক্রাশয় থেকে ডান নাসারন্ধ্র পর্যন্ত। শ্বেত বর্ণের শান্ত সৌম্য ও চাঁদের সাথে তুলনীয়। পিঙ্গলা (লাল) ডান শুক্রাশয় থেকে বাম নাসারন্ধ্র পর্যন্ত বর্ধিত। ভয়াবহ শক্তিশালী ও সূর্যের সাথে তুলনীয়।
ত্রিবেণীর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত স্তরে স্তরে বিভিন্ন কুঠুরী বা পদ্ম ফুলের বর্ণনা করা হয়েছে। পদ্ম গাঙ্গেয় অঞ্চলের খুব সাধারণ ফুল এবং প্রচুর মিথ এর সাথে যুক্ত। ব্রহ্মা স্বপ্ন দেখেন। তার নাভিমূল থেকে পদ্ম ফুল ফুটে স্বরস্বতী পদ্মফুলের উপর আবির্ভূত হন। প্রাণির দেহে ফুলের সনাক্তকরণ যাদের গ্রামদেশে বাড়ী তারা সহজেই করতে পারবেন। গরু ছাগলের বাছুর হওয়ার পর লোকজন পাহাড়া থাকে যেন ফুল না খেয়ে ফেলে। গরু তৃণভোজী কিন্তু এই আমিষ জাতীয় খাদ্য সরিয়ে না ফেললে সে অবশ্যই খায়। লালন তার গানে সরাসরি ফুল শব্দটিও ব্যবহার করেছেন।
কমল কোঠা কারে বলি
কোন মোকাম তার কোথা গলি
সেইখানে পড়ে ফুলি
মধু খায় সে অলি জনা।
একমাত্র খুঁটি সুষুন্মার শুরু থেকে শেষ অবধি কুণ্ডলিনীর (ত্রিবেণী) বিভিন্ন স্তরে সাধনার মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন চৈতন্য জাগ্রত করে শেষে ঈশ্বরের সাথে লীন হওয়াই দুনিয়ার সমস্ত সাধকের উদ্দেশ্য। সাধকের রূপান্তরের এই স্তর বা চক্র বা ফুল বা কুঠুরী বা আসমান উপমায় কখনও সাত কখনও আট বা নয় ধরনের স্তরের কথা বলা হয়ে থাকে। লালন ৭, ৮, ৯, সবই ব্যবহার করেছেন:
দেশ দেশান্তর দৌঁড়ে কেন মরছ রে হাপিয়ে
আদি মক্কা এই মানব দেহে
দেখনারে মন ধ্যেয়ে।
মানুষ মক্কা কুদরতি কাজ
উঠেছে আজগবি আওয়াজ সাত তলা ভেদিয়ে।
আছে সিং দরজায় তারি একজন নিদ্রা ত্যাগি হয়ে
দেখনারে মন ধ্যেয়ে।
অথবা যে গানটি ধরে আলোচনা করছি তার পরের অন্তরায়:
মূলাধার কুঠুরী নয়টা
তার উপরে চিলে কোঠা
তাহে এক পাগলা ব্যটা
বসে একা একেশ্বরে।
ভারতীয় মিথে সাধনার এই স্তরসমূহকে মুলতঃ সাত চক্রেই আলোচনা করা হয়েছে। কোথাও বা উপবিভাগ করেছে আট বা নয় চক্রে। সুষুন্মার ভিত্তি বা মূলকে বলা হয় মূলাধার চক্র।



মূলাধারের অবস্থান যৌনাঙ্গ ও পায়ু পথের মাঝে। চিত্রে বৃত্তের ভিতর চতুর্ভূজের দ্বারা বুঝানো হয়েছে পার্থিব বিষয় আশয়। হাতির পিঠের উপর নিন্মগামী ত্রিভূজ দ্বারা যোনী তথা বিশ্বমাতা, এর মাঝখানে পুরুষ প্রতীক শিবলিঙ্গ যাকে সাড়ে তিন প্যাচে জড়িয়ে সর্প দেবী কুণ্ডলিনী। এবার আসা যাক হাতির কথায়। হাতি ভারতে একটি মিথিক চরিত্র। মিথ অনুসারে একদা হাতি মেঘের মতো রূপ পরিবর্তন করতে পারত, উড়তে পারত।একদিন সে উড়ে গিয়ে বসল এক ডালে। ঐ গাছের নীচে এক সাধু তার শিষ্যদের পড়াচ্ছিলেন। এমন সময় ডাল ভেঙ্গে কয়েকজন শিষ্য মারা গেল আর হাতি সুন্দর উড়ে গিয়ে বসল অন্য ডালে। সাধু সাথে সাথে রেগে গিয়ে সমস্ত হাতি জাতিকে অভিশাপ দিলেন। হাতি তার রূপ পরিবর্তন ও উড়ার ক্ষমতা হারাল। এর পর থেকে হাতি পৃথিবীতে হেঁটে চলা একখণ্ড অভিশপ্ত মেঘ। হাতির এই সিম্বল থেকে বোঝা যায় শর্তমুক্ত হলে সহজেই পৌঁছানো যায় পরবর্তি কুঠুরীতে। মূলাধার স্তর সাধকদের কাছে খুবই স্থুল পর্যায়। এর দ্বারা পরিচালিত মানুষজন সক্রিয় নয়।
পরের চক্র স্বধিস্থান।


এটি কুণ্ডলিনীর বিশেষ আবাস।শরীরের যৌনাঙ্গ বরাবর এর অবস্থান। এই চক্রে কুণ্ডলিনী জাগ্রত হলে জীবনের প্রধান লক্ষ্য হয় সেক্স। চিত্রে জলের অসুর মকর এর প্রধান উপাদান। ফ্রয়েড জীবনের এই চক্রের আলোচনা করেছেন ভালোভাবে। ভারতীয় সাধকেরা এই কুঠুরী উত্তরণের ব্যাপারে দ্বিধাবিভক্ত। একটি ধারা কামকে হ্যা বলেছে অন্যটি না। বাউলরা প্রথমটি।
৩য় তলা হলো মনিপুর।


নাভির লেভেলে এর অবস্থান। মানুষের ভোগবাদীতা,দখল মনোবৃত্তি ইত্যাদির প্রকাশ এখানে। বর্তমান পশ্চিমা জগতের জীবনে এই চক্রের প্রাধান্য।
উল্লেখিত চক্রসমূহ সাদামাঠা। যারা এর মধ্যে জীবন যাপন করে তাদের জাগতিক চাওয়া পাওয়াই নির্ধারণ করে জীবনের সুখ-দুঃখ।এরা নিষ্ক্রিয় বা প্রতিক্রিয়াশীল। গুরু ঠাকুর বলেছেন 'পনের আনা মানুষ আসে খায় সন্তান উৎপাদন করে মারা যায়।'
পরবর্তি চক্র সমূহ উঁচু স্তরের।অনেকটা শরিয়ত-মারিফতের পার্থক্যের মতো। দান্তের মতে নতুন জীবনের শুরু।
চক্র চার অনাহত।


হৃদপিণ্ডের বরাবর এই পদ্ম। অনাহত মানেই আঘাত হীন। আমাদের সাধারণ অভিজ্ঞতা হল আঘাত ছাড়া শব্দ অসম্ভব। কিন্তু বিজ্ঞানের Big Bang আল্লার কুন বা ভারতের ওঁম এই সব শব্দ আমাদের চেনা বস্তুর আগে। সাধকেরা চিরন্তন সেই আঘাতহীন শব্দ শোনার সাধনা করে। রাবেয়া বসরী বলেছেন নৈশব্দই সেরা ইবাদত। তিনি নদীর পারে বসে এই ইবাদতই করতেন।অনাহত শব্দ শোনার পরে পরবর্তি কুঠুরীতে গমন।
চক্র পাঁচ বিশুদ্ধ ।


এর অবস্থান গলায়। কুণ্ডলিনী যখন এই তলে পৌঁছা্য় তখন সাধকের সাথে ঈশ্বরের কথাপকথোন হয়। চিত্রে নিন্মমুখী ত্রিভুজের ভিতর পূর্ণ বৃত্ত হলো পূর্ণ চন্দ্র। লালন তার বহু গানে বলেছেন এই চাঁদের কথা। এখানকার দেবতা হলো অর্ধনারিশ্বর শিব। সাধকেরা দেখতে পান পারে যাওয়ার তরী।
লালন অসংখ্য গান লিখেছে পারাপার তত্ত্বের। চির মুক্তি লাভের এই যাত্রা খুবই বিপদ সংকুল। ঠিক সেই ফুলসেরাতের পুলের বর্ণনা। ওপারে আছে চির যৌবন অনন্ত ভূমি এক কথায় স্বর্গ।
সিদ্ধ পুরুষ হতে আর দু চক্র বাকী।
অহনা ষষ্ঠ চক্র।


দুই ভ্রুর মাঝে উপরে মেয়েরা যেখানে টিপ পড়ে সেখানে এই চক্রের অবস্থান। সুফীদের ফানা ফিল্লা্হ বা ঈশ্বরের সাক্ষাৎ বা দিদার। রামকৃষ্ণের বর্ণনায় এ স্তরে কিছুটা আমি বা ইগো থেকে যায়। তিনি বলেন এ যেন ঠিক কাঁচে ঘেরা বাতি। সবই দেখা যায় তবু থেকে যায় বাঁধা। মোহাম্মদের মিরাজে আল্লা ও তার মাঝে একটি পর্দা ছিল।
সহস্র সপ্তম চক্র।



এই স্তর হল বাকা বিল্লাহ। ইউসুফ হাল্লাজের 'আয়নাল হক' বা আমিই সত্য। রামকৃষ্ণের বর্ণনায় কোন ধরণের বাঁধার অস্তিত্ত্ব নেই। শুধুই আলোর ঝলকানী। লালনের মতে দিবা রাতি নাই সেখানে। লালনের গানে দেখুন সহস্রের কথা:
যে রূপে সাঁই বিরাজ করে দেহ ভুবনে
গুরুর দয়া যারে হয় সেই জানে।
শহরে সহস্র পারা তিনটি পদ্মার এক মহেরা
আলেক ছোঁয়ার পবন খোড়া ফিরছে সেখানে।
গুরুর দয়া যারে হয় সেই জানে।
সহস্রের উপরে চিলে কোঠায় পাগলা ব্যাটা থাকেন।
এর পর লালন বলেন:
উপর নীচে সারি সারি
সাড়ে নয় দরজা তারি
লালন কয় যেতে পারি
কোন দরজা খুলে ঘরে।
সাড়ে নয় দরজা বলতে দুই চোখ, দুই কান, দুই নাক, মুখ, যৌনাঙ্গ, পায়ু। যৌনাঙ্গে নারীর দুই দরজা পুরুষের একটা গড়ে সাড়ে নয়।
ধন্য ধন্য বলি তারে
বেঁধেছে এমনও ঘর শুন্যের উপর
আ মরি শুন্যের উপর পোস্তা করে
ধন্য ধন্য বলি তারে।

বাউল ও সুফিবাদের আলোয় লালন-দর্শন
লালন একজন ফকির-দরবেশ, একজন সুফি-সন্ত, লালন বৈষ্ণব, তান্ত্রিক কিম্বা তত্বজ্ঞ কবি, লালন হিন্দু না মুসলমান – তিনি যে প্রকৃতপক্ষে কে এবং কী, এ ব্যাপারে দ্বিধা দ্বন্দের শেষ নেই।
লালন তো বাউল অবশ্যই ছিলেন। বাউল-শ্রেষ্ঠ ছিলেন বললেও অত্যুক্তি হবে না। বাউল সঙ্গীত বাংলার লোকসংস্কৃতির এবং লোকগাঁথার এক বিশেষ অঙ্গ। বাংলার জলবায়ুতেই তার পরিপুষ্টি। অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত তথাকথিত অসংস্কৃত একশ্রেণীর গ্রাম্য লোকদের মুখে মুখে রচিত হত বাউল গান। ধর্মীয় বা লোকাচারের মোড়কে গ্রাম্যমানুষকে নীতি কথা শেখানোর জন্য বাউলশ্রেণীর উদ্ভব হয় নি, যেমনটি দেখা যায় অন্যান্য কিছু লোকসঙ্গীতের ক্ষেত্রে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে গম্ভীরা, ভাদু, টুসু, মুর্শিদী ইত্যাদি। বাউল গান যদিও গ্রামীণ কথ্য ভাষায় গীত হত, কিন্তু এর পরতে পরতে যে গভীর তত্ত্বজ্ঞান লুকিয়ে আছে, তা বুঝতে বেশী সময় লাগে না। লালন ফকিরের বাউল গান এর সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ। ‘তত্ত্বকথা শ্রবণ, তত্ত্বসার গ্রহণ এবং তত্ত্ববিষয়ক চিন্তাই ছিল তাঁর মূল লক্ষ্য। দীর্ঘ আধ্যাত্ম সাধনায় তাঁর হৃদয়ে যে জ্ঞান সঞ্চিত হয়েছিল, তা প্রকাশ করার জন্য তিনি সুর ও ছন্দ অবলম্বন করেন। একারণেই তাঁকে তাত্ত্বিক কবি বলা হয়েছে’। এক কথায় বলা চলে লালন ছিলেন ‘মিষ্টিক’, যে অর্থে বৈষ্ণববাদ সুফিবাদ ‘মিষ্টিক’, সেই একই অর্থে লালনের ধ্যান-ধারণা ‘মিষ্টিক’। ‘মিষ্টিসিজম’ অল্পবিস্তর সব বাউলগানেই প্রচ্ছন্ন, কিন্তু লালন-গীতিতে তা এক অন্যরূপ, ভিন্নতর মাত্রায় জাজ্বল্যমান।
বাউল সঙ্গীত ও তার ইতিহাসকে বাদ দিয়ে লালনের তত্ত্বজ্ঞান ও দার্শনিকতার সঠিক মূল্যায়ন হতে পারে না। লালনের জীবন ও কর্মের ধারাটিকে সঠিক ধরতে গেলে বাউল সঙ্গীতের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট একবার দেখে নিতে হবে। কেউ-ই সঠিক জানেন না বাউল সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা কে বা কারা। এটুকু বলা যায় বাউল ফকির বা গুরুরা কোন এক বিশেষ ধর্মের অনুগামী ছিলেন না। মুসলিম এবং হিন্দু দুই সম্প্রদায়ের লোকই বাউল সম্প্রদায়ভু্ক্ত ছিলেন আগে এবং এখনও। কয়েকজন বিখ্যাত ফকির গুরুর নাম এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যেতে পারে যেমন হরিগুরু, বনচারী, অখিল চাঁদ কিম্বা পাগল নাথ, সাহেব ধনি প্রমুখ। একটি ব্যাপার বিশেষ উল্লেখ্য এই ব্যাপারে যে এই সব ফকির বা গুরুরা সবাই নদীয়া জেলার অধিবাসী ছিলেন এবং প্রায় সবাই ষোড়শ শতাব্দীর পরের দিককার। অনেক গবেষক এই কারণেই মনে করেন বাউল সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়েছিল এই নদীয়াতেই। নদীয়া অবিভক্ত বাংলার সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ছিল সেই সুপ্রাচীন কাল থেকে শুরু করে ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষভাগে বখতিয়ার খিলজির হাত ধরে বাংলায় মুসলিম শাসন চালু হয়। সুফি প্রভাব তখন বাংলার সর্বত্র। সুফিচিন্তা ও ভাববাদের মধ্যে গ্রামবাংলার অত্যাচারিত ও দিকভ্রান্ত মানুষ দিশা খুঁজে পেতেন। এমনকি অনেক গবেষক মনে করেন চৈতন্যদেবের ভাবধারাতেও সুফিপ্রভাব ছিল। ‘চৈতন্যমঙ্গল’-এর লেখক জয়ানন্দ বলেছেন সেই সময় অনেক ব্রাক্ষণ জালাল উদ্দীন রুমির ‘মাথানবী’ পড়তেন। কৃষ্ণদাস কবিরাজের ‘চৈতন্য-চরিতামৃত’ গ্রন্থে চৈতন্যর সঙ্গে পীর-দরবেশের সাক্ষাৎকারের কথা আছে। চৈতন্য ভাগবত-এ আছে মহাপ্রভুর যখন ভাবদশার উদয় হত তখন –‘মুঞি সেই মুঞি -- সেই কহি কহি হাসে’। যা কিনা সুফি চিন্তা ‘আনা’ল হক’-এর সমার্থক (ভাবার্থ: I am the real)। প্রখ্যাত সমালোচক প্রমথ চৌধুরীর কথায় চৈতন্য মহাপ্রভুর হাত ধরে ব্যপ্ত ভারতবর্ষের মধ্যযুগের এই নব বৈষ্ণব ধর্ম সনাতন হিন্দু ধর্মের একটি নবশাখা মাত্র। তবে এই নবত্বের কারণ মুসলমান ধর্মের প্রভাব। মুসলমান ধর্ম যে প্রধানত ঐকান্তিক ভক্তির ধর্ম, একথা কে না জানে? ভারতবর্ষের মধ্যযুগের বৈষ্ণবধর্ম যে মুসলমান ধর্মের এতটা গা-ঘেঁষা, তার কারণ পাঁচশ বছর ধরে হিন্দু ও মুসলমান ধর্ম পাশাপাশি বাস করে আসছিল’। নববৈষ্ণব ধর্মের মধ্যে যে পৌত্তলিকতা বর্জিত একশ্বরবাদী চিন্তার ধারণা আছে সুফি চিন্তাধারার সঙ্গে তার অনেকটাই মিল। ষোড়শ শতাব্দীতে গিয়ে যখন বাউল সাধকদের উল্লেখ দেখা যায় নদীয়ার আশেপাশে, তাতে স্বভাবতই মনে করা যেতে পারে এই সম্প্রদায়ের মধ্যে বৈষ্ণব চিন্তা ও সুফি ভাবধারার ছাপ আছে। বাউলতত্ত্বে বারবার বলা হয় নিজেকে জানার কথা, খানিকটা যেন ঊপনিষদের ‘আত্মানং বিদ্ধি’ বা গ্রীক দার্শনিক প্লেটোর চিন্তার প্রতিফলন – ‘know thyself। বৈষ্ণবরা কৃষ-প্রেমের মধ্য দিয়ে যেখানে পৌঁছোতে চায়, সুফিতত্ত্ব যে ‘এক এবং অদ্বিতীয়’-কে জানতে চায়, তত্ত্বজ্ঞ বাউল তার কোন নামকরণ বা চিহ্নিতকরণ করতে পারেন নি। তাই তাকে ‘মনের মানুষ’ বা কখনো শুধু ‘মন’ বা কখনো আবার ‘অচিন পাখি’ ডেকেছেন। এই অধরা অজানাকে জানার রহস্যভেদ করার আকুলতাই বাউল গানের ছত্রে ছত্রে ধ্বনিত হয়।
আলেখ দুনিয়ার বীজে আলেখে সাঁই বিরাজে
আলেখে খবর নিছে, আলেখে কয় কথা।
.......
আলেখ মানুষের রসে সনাতন সদা ভাসে
বাউলে তোর লাগল দিশে যেতে নারবি সেথা’।
এক্ষেত্রে আলেখ সাঁই শব্দটি হয়তো অলক্ষ্য স্বামীর অপভ্রংশ। সুফিসন্তদের মতো বাউলরা সেই অজানাকে জানা ও চেনার দুর্জ্ঞেয় রহস্য ভেদ করতে চান প্রেমের মাধ্যমে যা মনের গভীরে তুষের আগুনের মত সর্বদাই জ্বলছে। এই প্রেমানলে সুফি দরবেশ যেমন পাগল, বাউলও হন বাতুল বা উন্মাদ। বাউলের এই উন্মাদ অবস্থার পরিচয় পাওয়া যায় তার গানে:
‘আসার সাঁই দরদী আর কতদিন রব?
দেশ বিদেশে ঘুরিয়া বেড়াই, আর বা কোথা পাব?
যার জন্যে হয়েছি পাগল, তারে কোথায় পাব?
মনের আগুন দ্বিগুণ জ্বলে তারে কি দিয়ে নিবাব?’
এই প্রেমোন্মাদনার মাধ্যমে বাউল সব সময় সেই অজ্ঞাত রহস্যময়কে জানার চেষ্টা করে চলেন। স্বভাবতই পারেন না। তাই সুফি কিম্বা বেদান্তজ্ঞানীর মত তিনি দৃষ্টি ফেরান নিজের ভেতর। তিনি বলতে পারেন সেই কারণে – ‘যা নেই ভান্ডে, তা নেই ব্রম্মান্ডে’। এখানে ভান্ড অর্থ এই শরীর। এই ভাবনার সঙ্গে সুফি ‘কুরবাত’-এর ধারণা সমাপতিত হয়ে যায়। বাউল ধ্যানধারণার মধ্যে এভাবে একদিকে যেমন প্রচ্ছন্নভাবে বৈষ্ণব প্রেমতত্ত্ব মিশে আছে তেমনি আছে সুফি আত্মোপলদ্ধির ধারণা। বাউল মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন এই অজ্ঞেয়-অধরা আর কোথাও নয়, মন্দিরে নয়, মসজিদে নয়, গীর্জায় নয় আছেন এই শরীরের খোলেই। যদিও তিনি রহস্যময় কিন্তু সঠিক ভাবে ডাকলে তাঁর সাড়া অবশ্যই পাওয়া যায়।
মানুষ হাওয়ায় চলে, হাওয়ায় ফিরে, হাওয়ার সনে রয়।
দেহের মাঝে আছে রে সোনার মানুষ ডাকলে কথা কয়’।
এই রহস্যভেদের জন্য বাউল দ্বারস্থ হন গুরু বা মুর্শিদের কাছে ঠিক যেমন সুফিভক্ত যান পীরের দরজায়। গৎ বাঁধা ধর্মাচরণ বাউলের নয়। তীর্থভ্রমণ, পূজাপাঠ, এবং অনুষ্ঠান-আচার যেমন বাউলের কাছে পরিত্যাজ্য সুফির কাছেও তেমনি।
আমার নাই মন্দির কি মসজিদ
পূজা কি বকরিদ
তিলে তিলে মোর মক্কা কাশী
পলে পলে সুদিক’।
সুফিসাধক এবং হিন্দু তত্ত্বজ্ঞানীর মত বাউলও বিশ্বাস করেন সংসার মায়াময়। এই পার্থিব জীবন মরীচিকা। তাই তো বাউল নিজের চারপাশে গড়ে তোলে পার্থিব জীবন বিমুখ মনোভাব। সুফি অনুগামী বা হিন্দু তাত্ত্বিকের থেকে বাউল এখানে স্বতন্ত্র। সুফি চিন্তার সঙ্গে অনেক সমাপতন সত্বেও বাউলকে দেখা যায় এক নিজস্ব রীতিনিয়ম তৈরী করে নিতে। তিনি কোন জাতপাতের উপর নির্ভরশীল নন। তাঁর নিজস্ব পথ স্বকীয় চিন্তার আলোকে উদ্ভাসিত হয়। তুলনামূলকভাবে সুফিবাদ দৃশ্যতই এবং পরিপূর্ণভাবে ইসলামনির্ভর। সুফি ভাববাদ যেহেতু ‘আল্লা’ নির্ভর, তাই তাঁদের ‘পরম লক্ষ্য’-র ব্যাপারে ধ্যানধারণা অনেক স্বচ্ছ। এ ব্যাপারে বাউলদর্শন অনেকটাই অনিশ্চিয়তার অন্ধকারে নিমজ্জিত। এত সব সমাপতন থেকে, সে কাকতালীয় হোক আর ইচ্ছাকৃত, ধারণা করা যেতে পারে বাউলতত্ব বৈষ্ণববাদী প্রেম ও সুফি একেশ্বরবাদী আত্ম-অনুসন্ধান ও আত্মোপলব্ধির ভিতের উপর গড়া।
বাউল ভাববাদের এই পরিপ্রেক্ষিতটির কথা মাথায় রাখলে বাউল-শ্রেষ্ঠ লালন সাঁইয়ের জীবনাদর্শে আলোকপাত অনেক সহজ হয়ে আসে। অনেকেই জানেন লালনের জন্মবৃত্তান্ত প্রায় সবটাই ধোঁয়াশা। কোথায় তাঁর জন্ম হয়েছিল কেউ জানে না। লালন নিজে এ ব্যাপারে কাউকে কিছু বলেন নি। মলম এবং মতিজান নামক এক কৃষক দম্পতি গুটিবসন্তে আক্রান্ত মূমুর্ষূ এক বালককে উদ্ধার করেছিলেন কালীগঙ্গা নদীর চর থেকে। এই নিঃসন্তান দম্পতিই সন্তান স্নেহে লালনকে মানুষ করেছিলেন। সেসময় লালন এক কিশোর। কিন্তু তাঁর পিতামাতা, গ্রাম-দেশ সম্বন্ধে কাউকে কিছু জানাননি তিনি। সেই বয়স থেকেই প্রথাগত ধর্মসম্প্রদায় এবং জাতপাত ভিত্তিক ধারণার বাইরে বেরিয়ে এক অসাম্প্রদায়িক বিশ্বাসের পথে এগোচ্ছিলেন তিনি। পরবর্তী জীবনে এই মনোভাবই লালনের দর্শন চিন্তার কেন্দ্রবিন্দুতে স্থান করে নিয়েছিল। তাই তিনি পরিণত বয়সে বলতে পেরেছিলেন :
‘লালন বলে জাতের কি রূপ দেখলাম না এই নজরে।
কেউ মালা কেউ তসবী গলে তাইতোরে জাত ভিন্ন বলে
যাওয়া কিন্বা আসার বেলায় জাতের চিহ্ন রয় কারে’।
আজকালকার সাম্প্রদায়িক হানাহানি ও বিদ্বেষের মুখে লালনের এই দর্শন যে ভীষণই বৈপ্লবিক ও প্রাসঙ্গিক সে সন্দেহ নেই। কুষ্টিয়ার ছেউরিয়ায় যেখানে লালনের আখড়া, তা একসময় বৃহত্তর নদীয়ার অংশ ছিল। আগেই বলা হয়েছে যে সুপ্রাচীন নদীয়ায় বৈষ্ণব ও সুফিবাদের যথেষ্ট প্রভাব ছিল যার ছাপ আমরা বাউল সঙ্গীতে লক্ষ্য করি। লালন এই জায়গার লোক হওয়ার সুবাদে তাঁর চিন্তাধারাতেও বৈষ্ণবীয় ভক্তিবাদ এবং সুফিবাদের প্রভাব থেকে থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। সুফিসন্তদের মতো তিনিও ভাবতেন আপনাকে জানার মধ্যেই আছে জগতের রহস্যভেদের চাবিকাঠি। সেই ‘অপার-অজানা’ আছেন আমাদের এই দেহ-দেউলেই। এই শরীরের খোলেই। দেহ এক মাধ্যম ও বাহক - তার বেশী কিছু নয়। দেহ নষ্ট হবে কিন্তু চলতেই থাকবে দেহ থেকে দেহান্তরে ‘অচিন পাখি’র আনাগোনা। লালনের এই ধ্যানধারণা, বিখ্যাত দার্শনিক ও গণিতজ্ঞ দেকার্তে-র দার্শনিক চিন্তার সমান্তরাল। দেকার্তে বলেছিলেন – ‘cogito ergo sum বা সাদা কথায় ‘I think, therefore I exist। চিন্তা ভাবনার ধারক ও বাহক হিসেবে অস্তিত্ব আছে এই শরীরের। লালনও বললেন -
‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়’।
এই খাঁচা (দেহ) যেদিন খসে পড়বে- ‘লালন কয় খাঁচা খুলে সে পাখি কোনখানে পালায়’। মোদ্দা কথা দেহ বিনষ্ট হবে কিন্তু আত্মা ও মন রয়ে যাবে। গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন ‘বাসাংসি জীর্নানি যথা বিহায়’ ইত্যাদি। বাসা জীর্ণ হলে পাখি যেমন বাসা বদল করে, শরীররূপী এই খাঁচা খসে পড়লে পাখি মুক্ত হয়ে বাসা বদল করে। এই আধ্যাত্ম চিন্তা এতটাই শাশ্বত যে ধর্ম ও জাতের জায়গা এখানে কোথায়? সেই কারণেই লালনের চিন্তাভাবনার দর্শনকে কোন প্রথাগত ধর্মের গন্ডিতে বাঁধা মুশকিল।
মন্দির মসজিদে লালনের বড় অনীহা ছিল। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মাচরণের বিরুদ্ধতা বাউলরা সব সময়েই করেছেন একথা আগেই বলেছি। কোন তীর্থস্থানে যেতে হবে না। এই দেহই সব মসজিদের শেষ মসজিদ, সব মন্দিরের শেষ মন্দির। লালন তাই বলেন:
আছে আদি মক্কা এই মানব দেহে
দেখল নারে মন ভেয়ে
দেশ দেশান্তরে দৌঁড়ে এবার
মরিস কেন হাঁপিয়ে’।
তিনি বলেন:
দশ দুয়ারী মানুষ মক্কা
গুরুপদে ডুবে দেখ গা
ধাক্কা সামলায়ে
ফকির লালন বলে সে যে গুপ্ত মক্কা
আদি ইমাম সেই মিঞে’।
বাউলের কাছে মন্দির এই দেহ, মসজিদ এই দেহ, মক্কা-মদিনা-কাশী-বৃন্দাবন এই দেহ। সুফি দর্শনের সঙ্গে লালন বা বাউল দর্শনের বৈপরিত্য এখানেই। মানব-শরীরের মাধ্যমে সেই ‘মিঞে’–কে ধরার প্রয়াস কেবল বাউলই করেন।
এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভাল যে বাউলরা তথাকথিত বিদ্বৎসমাজে ও সমাজের উঁচুস্তরে প্রায় ব্রাত্যই ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ এই সম্প্রদায়ের প্রতি মানুষের আগ্রহ নতুন করে জাগিয়ে তুললেন। রবীন্দ্রনাথ এবং লালন প্রায় একই সময় পৃথিবীতে ছিলেন। তিনি লালনের প্রভাবে এতটাই প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন যে তাঁর কাব্য চিন্তায় বাউ-দর্শন এ বিশেষ জায়গা করে নিয়েছিল। যাই হোক লালনের ভাবনার প্রতিফলন দেখা গেল তাঁর গানে :
আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে/দেখতে আমি পাইনি তোমায় দেখতে আমি পাইনি’। কিম্বা তিনি যখন বলেন ‘আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে তাই হেরি তায় সকলখানে’, তখন লালন-রবীন্দ্রনাথ-দেকার্তে-প্লেটো—সুফি-সন্ত সব একাকার হয়ে যায়। মনুষ্যত্বের আদর্শ ও চিন্তাই এই চিন্তার মূলভিত্তি। নিজেকে জানা ও চেনার মধ্য দিয়েই জানা যাবে ‘তাঁকে’ – আর কোন প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মাচরণ ও তদজনিত ভেদবুদ্ধির প্রচার ও বিচারের দরকার নেই। এ কথাই লালন তাঁর সমগ্র জীবন ও চিন্তায় প্রতিফলন করে গেছেন।
লালনের বাউল-ভাবনায় বাংলার মধ্যযুগীয় নববৈষ্ণব চিন্তা ও সুফি ভাববাদের গভীর প্রভাব আছে। সুফি ভাবধারার সঙ্গে অনেক সাদৃশ্য থাকায় লালনকে অনেকে সুফি-সাধকও বলেছেন। সাম্প্রতিক গবেষকরা এ ব্যাপারে নির্দ্বিধায় বলেছেন লালন সুফি ছিলেন না। কেন? সুফি-দর্শন প্রথমত এবং প্রধানত ইসলাম ধর্মের মধ্যেই বেড়ে ওঠা এক অধ্যাত্ম চিন্তা। সুফিরা ‘আল্লা’ ছাড়া আর কারো অস্তিত্ব স্বীকার করেন না। আল্লার প্রতি অপার ভক্তির মাধ্যমে সুফি সাধক সেই ‘পরম’-কে পেতে চান। এখানেই লালনের চিন্তাধারা বিপরীত মেরুতে অবস্থিত। লালন এবং বাউল-দর্শন মানবদেহের অভ্যন্তরে যে ‘মনপাখি’, মনের মানুষ’ আছে তাঁকে জানার চেষ্টা ছাড়া আর কিছুতে বিশ্বাস করেন না। সেই চিন্তায় আল্লা নেই, কৃষ্ণ নেই। মানুষ তার কাছে আল্লা। তাই তিনি বলতে পারেন :
আল্লা কে বোঝে তোমার অপার লীলে
তুমি আপনি আল্লা ডাকো আল্লা বলে’।
লালন সেই অর্থে সুফিদের মত ধর্মযাজক ছিলেন না। ফারহাদ মাজহার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন লালনকে সুফি বলে ভুল করা হয় এই কারণে যে তাঁর গানে প্রচুর আরবী শব্দ ও ইসলামিক ভাবনা চিন্তার প্রতিফলন আছে। কিন্তু অত্যন্ত সতর্ক ভাবেই তিনি সুফিদের থেকে নিজেকে সরিয়ে এক স্বতন্ত্র দর্শনের উদ্ভাবন করেছিলেন যা প্রথাগত ইসলাম থেকে অনেক দূরে। আল্লাকে বা ‘অচিন পাখি’-কে দেখো এই মানবদেহেই – অন্য কোথাও নয়, অন্য কোন তীর্থে নয়।
লালনের ভাবনা ও দর্শন সুফি দর্শন এবং বৈষ্ণবীয় ভাব রসের জারণে জারিত এক স্বতন্ত্র চিন্তা যা গ্রাম বাংলার লোকসংস্কৃতির আধারে পরিপুষ্ট হয়েছিল। তিনি বৈষ্ণব নন, সুফি নন, হিন্দু নন, মুসলিম নন। জাতের ফাৎনা তিনি ডুবিয়েছেন সাধ-বাজারে। তিনি ব্যাকুল স্বরে বলতে পারেন:
বিবিদের নাই মুসলমানী
পৈতে নেই যার সেও বামনী।
বোঝ রে ভাই দিব্যজ্ঞানী
লালন তেমনি জাত একখানা’।

মোহা ম্মদ রফিক উজ্জামা ন আর ফকির মোহাম্মাদ আলী-র কথায় ...
লালন সাঁই, ফকির লালন জাত-পাতের বহু উর্ধে এক তত্বজ্ঞ দিব্যজ্ঞানী। একজন শাহানশাহ্।
তবে আমি সাঁইজিকে কেন শাহানশাহ্ বলে আখ্যায়িত করেছি, সে সম্পর্কে কিছু বলার প্রয়োজন আছে। সুফি বা ফকিরি সাধনায় যাঁরা সিদ্ধিলাভের পথে অগ্রসর হন, এক পর্যায়ে এসে তাঁদের নির্দিষ্ট দুটি পথের একটি পথ বেছে নিতে হয়। পথ দু’টি হলো— স্লকুমত ও হিকমত। এখানে ‘স্লকুমত’ শব্দের অর্থ রাজস্ব বা বাদশাহী। ‘হিকমত’ শব্দের অর্থ অলৌকিক ক্ষমতা। জাগতিক ক্ষেত্রে রাজত্ব বা বাদশাহী হচ্ছে শাসন-শোষণ এবং জাগতিক ক্ষমতার প্রতিষ্ঠা। ফকিরি সাধকের ক্ষেত্রে রাজস্ব বা বাদশাহী হলো সর্বতোভাবে মানুষের কল্যাণ করা। ইসলামের প্রথম চার খলিফা যা দেখিয়ে গেছেন। তাঁরা শাসক হয়েও নিজেকে শাসক না ভেবে, সব ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে উঠে হয়েছিলেন সেবক। মানুষের সেবক। খলিফা হয়েও ছিলেন ফকের। ফকিরি সাধকরাও তেমনি মানুষ সেবা, মানুষ ভজনার কথা বলেছেন। এমনকি স্বপেম্নও তারা মানুষের অকল্যাণের কথা ভাবতে পারতেন না। শত্রুরও নয়। প্রকৃত বাদশাহ্’র রূপ তো এটাই। এই সাধনায় যাঁরা সিদ্ধি লাভ করেন— তাঁরাই হয়ে ওঠেন শাহানশাহ্। সাঁইজি যখন বলেন:
... গঙ্গাজল কূপজল হয়
বিলে বাঁওড় রয়
সাধ্য কি তার গঙ্গাতে যায়
গঙ্গা না এলে পরে...
তখন উপলব্ধি করি, মানুষের মধ্যে স্রষ্টার বসবাসের কথা, জীবাত্মা আর পরমাত্মার সম্পর্কের কথা। গঙ্গা যখন প্লাবিত হয়—তখন গঙ্গার পানি বিল-বাঁওড়ে চলে আসে। প্লাবন শেষে বিল-বাঁওড়ে আবদ্ধ হয়ে যায়। সেই অবস্থাকে সাঁইজি বলেছেন,‘আমায় রাখলেন সাঁই কূপজল করে আধেলা পুকরে (পুকুরে)...’। অর্থাত্ এই দেহ নামক আধেলা পুকরে, গঙ্গাজল’ নামক পরমাত্মার অংশ বদ্ধ হয়ে আছে। তার বাসনা পরমাত্মার সঙ্গে মিলিত হবার। কিন্তু তার সাধ্য কম, তাই তার সাধনার দ্বারা সে অহর্নিশ স্রষ্টাকে আহ্বান জানায়। স্রষ্টা এসে যখন তার সঙ্গে মিলিত হন, তখন সে বিলীন হয়ে যায় স্রষ্টার অস্তিত্বের মধ্যে। স্রষ্টা থেকে এসেছি, আবার স্রষ্টাতে অবলুপ্ত হবো। সাধকের কাছে তাই স্বর্গ-নরকের অস্তিত্ব নেই। ‘ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’-এর ব্যাখ্যা সাধকের কাছে এমনই।
ফকিরি সাধনার মূল কথাই হলো ‘মিলন সাধন’। জগতে সন্তান-সন্ততি রেখে দেহত্যাগে একটা মায়ার পিছুটান থেকে যায়। কোনো পিছুটান নেই যে ফকিরি সাধকের। সে সহজেই মিলিত হতে পারে স্রষ্টার সঙ্গে। একমাত্র ফকির ছাড়া আর সমস্ত জীবাত্মার সাধন হলো সৃজন-সাধন। এও স্রষ্টার এক লীলা। তার সৃষ্টিকে সচল রাখার কৌশল। তবে ফকিরি সাধনা— সংসার ত্যাগী সন্ন্যাসীর মতো নয়। ফকিরি সাধনায় সাধন-সঙ্গিনী অতি আবশ্যক। সঙ্গিনীর ভূমিকাও প্রায় সমান। কারণ সঙ্গিনী ছাড়া সাধক সম্পূর্ণ নয়। স্রষ্টা ছিলেন আপনাতে আপনি গুপ্ত। নৈরাকারকে আকারে আনতে তিনি আদমকে সৃষ্টি করলেন। কি ছিল সেই আকারবিশিষ্ট আদমের মধ্যে যে, ফেরেশতাকুলকে তিনি নির্দেশ দিলেন আদমকে সেজদা দিতে? সেজদা না দেয়ার অপরাধে আযাযিল ফেরেশতাকে কেন হতে হলো অভিশপ্ত শয়তান ইবলিশ? আল্লাহ ছাড়া যে কাউকে সেজদা দেয়া যায় না— আযাযিল তা জানতেন। তা হলে চিরকালের নিরাকার স্রষ্টা আদমকে সেজদা দিতে বলেছিলেন কেন?— কি রহস্য লুপ্ত ছিল সাকার আদমের ভেতর? কোনো ভেদ বুঝতে না পারায় আযাযিলকে হতে হলো ইবলিশ। স্রষ্টার সেই রহস্য সত্ত্বাই— পূর্ণ মানুষ আদম। নিরাকার স্রষ্টার আকারময় রূপ। তারপর স্রষ্টা আদমকে খণ্ডিত করে হাওয়াকে সৃষ্টি করেন। তাঁদের আনন্দময় মিলনে একাকার হবার মধ্যেই আবার পূর্ণত্ব লাভ করে মানুষ। একাকার মিলনেই সৃষ্টি হয় সন্তান-সন্ততি। এটাই সৃজন সাধন।
মিলন সাধন শুধু একাকার হওয়াতে পূর্ণ হয় না। দুয়ে মিলে এক নয়, শূন্য হয়ে যেতে হয়। আকার নিয়ে নিরাকারে প্রবেশ করা যায় না। শূন্যের কোনো আকার নেই। তাই শূন্য হয়েই নিরাকারে বিলীন হতে হয়। দুয়ে মিলে প্রথমে এক আকার ধারণ করা, তারপর যে নিরাকার থেকে আকার লাভ, সেই নিরাকারে মিশে সবার জন্য পরমানন্দময় শূন্য হয়ে যাওয়া। স্রষ্টা নিজেই পরমানন্দময়-প্রেমানন্দময়। সাধকের প্রেমানন্দ তাই কামসুখ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। বস্তু পতনে কাম, বস্তুকে চেতনলোকে নিয়ে যাওয়াতেই প্রেম। কামসুখ ক্ষণস্থায়ী। প্রেমানন্দ অক্ষয়।
বাউল মানুষ ভজে, যেখানে সাঁই নিত্য বিরাজে। বাউলের কারবার মানুষ, তার স্রষ্টা এবং তার সৃষ্টির অনুসন্ধান। বাউল সত্যের উপাসক। নিজ পরিমণ্ডলে তার সাধন-ভজন আচার, বিহার। লালন তত্ত্ব হচ্ছে সিনায় সিনায় কারবার। এটা বোঝার বিষয়, বোধের বিষয়, বুঝে নেয়ার বিষয়, বলে কয়ে লালন তত্ত্ব জানা বোঝা মুশকিল। লালন ধারায় গুরুত্ব দেয়া হয়েছে গুরুকে। গুরুর তত্ত্ব শিষ্য নেবে সিনা থেকে সিনাতে। তাহলেই তো শিষ্য পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে। গুরু বাঁধা পড়বেন শিষ্যের সিনাতে। এভাবেই চলে আসছে এভাবেই চলবে। ওই যে সাঁইজি বলে গেছেন ‘ভক্তের ডোরে বাঁধা আছেন সাঁই।’ ডোর মানে রশিটা তো এখানেই।

কৃতজ্ঞতা:
মোমেন মাঝি
আবু ইসহাক হোসেন
প্রদোষ কান্তি সরকার
সুধীর চক্রবর্তী
শক্তিনাথ ঝা
সুরজিৎ সেন
লিয়াকত আলি