Total Pageviews

Wednesday, January 19, 2011

কোরক ও কিন্নরী ~ হাসান মোরশেদ

১।
কবরস্থান একটু বেশী ছায়াময় হয়?
জরুরী নয়, তবু এরকম একটা জিজ্ঞাসায় আক্রান্ত হলো রাশেদ আনোয়ার, অক্টোবরের এক প্রায় শেষ হয়ে আসা বিকেলবেলা। মুলফটক দিয়ে বেশ ভিতরে এসে সে ঘুরে তাকাল। দেয়াল তখন অনেক দূরে, দেয়ালের বাইরের সড়ক তবু দৃশ্যমান। দৃশ্যমান সড়কের উপর নরোম রোদ, অথচ কবরস্থানে ছায়া ছায়া প্রায় অন্ধকার। সামিনার বলে দেয়া অনুযায়ী কবরটা এখানেই থাকার কথা। এইতো বড় একটা গাছ, গাছের পেছনে পাকা কবর, তার পাশেই। কিন্তু পাশের কবরটা তো বড় মানুষের, বছর চারেকের পুরনো ও মনে হচ্ছেনা। ঠিক এখানেই তো?
অবশ্য সামিনা নিজেও কবরটা দেখেনি।কবরস্থানে নিষিদ্ধ মেয়েরা,মা’যদিও । সড়কের ওপাশে দাঁড়িয়ে আঙ্গুল উঁচু করে সামিনাকে একবারই দেখিয়েছিলো সামিনা’র স্বামী। স্বামী? রাশেদ আনোয়ারের অস্বস্তি জাগলো।
ছায়া মাড়িয়ে সে এসে দাঁড়ালো কবরটার পাশে।হয়তো এখানেই কবর হয়েছিলো, তার উপর আবার নতুন কবর হয়েছে। কতোদিন পর কবরের উপর নতুন কবর দেয়া হয়? কবর হয়ে যাওয়া মানুষগুলোর ঠিকানা কি কেউ লিখে রাখে এখানে? চারপাশে তাকালো সে অপ্রয়োজনে। উত্তর দেবার মতো কেউ নেই কোথাও। মুল ফটকের পাশে একটা অফিসের মতো দালান আছে কিন্তু তালাবদ্ধ। হয়তো আরো আগে আসতে পারলে কাউকে পাওয়া যেতো কবরটার খোঁজ করার জন্য। কিন্তু ঢাকা থেকে এই জেলাসদরের এসে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকেল হয়ে গেলো। বাংলোটা শহরের বাইরে। সেখানে গাড়ি রেখে, কাপড়বদলে আসতে আসতে প্রায় সন্ধ্যা।
সামিনাকে কি বলবে সে? কবরটা চিনতে পারেনি?
অথচ সামিনা আসতেই চায়নি।প্রথম বিবাহবার্ষিকী উদযাপনে কেউ এমন জায়গায় বেড়াতে আসেনা যেখানে মৃত সন্তান শুয়ে আছে, বিশেষতঃ সেই বিবাহ যখন আর মৃত সন্তানের জনকের সাথে টিকে নেই।
তবু সে জোর করে রাজী করিয়েছে সামিনাকে। স্বপ্ন দেখিয়েছে এই শহরে আমরা একটা বাড়ি কিনবো।বুড়ো হয়ে গেলে আর ঢাকার ধুলোময়লায় নয় বরং এইশহরের চায়ের ঘ্রান আর মায়াবী সবুজে আমরা দুজন কাটিয়ে দেবো শেষদিনগুলো।
সামিনা দূরের দেয়ালের বাইরে মুল সড়কের পাশে দাঁড় করানো গাড়ীর ভিতর। এখানে তার গর্ভের সন্তান শুয়ে আছে, তবু সামিনার অধিকার নেই প্রবেশের।সামিনার হয়ে এই মাটি ছুঁতে এসেছে যেজন তার সাথে মাটিস্থ শিশুটির কোন সম্পর্ক নেই।
কোন প্রার্থনা নয়,কবরের মাটি কেবল নীচু হয়ে স্পর্শ করলো রাশেদ আনোয়ার।এক অযৌক্তিক, অবর্ননীয় পিতৃস্নেহর মতো অব্যাখ্য অনুভূতি তাকে আঁকড়ে ধরলো। তার তৃষ্ণা পেল প্রবল।ঐ তো দেয়ালের ওপাশেই সামিনা। তবু মনে হলো যেনো অনতিক্রম্য দূরত্বে। তৃষ্ণা নিবারনে জন্য এই দূরত্বটুকু অতিক্রম করা জরুরী।সামিনা কি তৃষ্ণার জল? অথচ একবছর কয়েক মাসে আগে ও তার এবং সামিনার পৃথিবী ছিলো পরস্পর থেকে অনেক দূরে, অনেক অচেনা, অনেক বিপরীত।
সামিনাকে নিয়ে অদ্ভূত,ব্যাখ্যাতীত কিছু ঘটে যা কিছু সে কাউকে বলতে পারেনা, সামিনাকে ও না।
সেদিন এক রেঁস্তোরায় বসে কফি খাচ্ছিলো তারা।আলবেয়ার কাম্যু কি করে তার লেখা সহ বদলে গেলেন এক্সিস্টিনিয়ালিজম থেকে এবসার্ডিজমে, বলছিলো সে। সামিনা কিছু বুঝছিলো, অনেকটুকুই বুঝছিলোনা।রাশেদ আগুন গরম কফিতে চুমুক দেয়,সামিনা ফুঁ দিতে দিতে কফি ঠান্ডা করে। ফুঁ দিতে দিতে সামিনা ঠোঁট টিপে হাসছিলো। তার হাসিতে শব্দ হয়না। তবু রাশেদ শব্দ শুনছিলো হাসির অথচ সামিনা নেই। সামিনা আছে, তার অস্তিত্ব টের পাচ্ছে সে, তার হাসির শব্দ শুনছে সে অথচ মুখোমুখি বসা ছিলো সামিনা। তবু সামিনাকে দেখছেনা সে। দৃষ্টিতে, দর্শনে সামিনা নেই!চারদিকে সব ছিলো, সবাই ছিলো। রেঁস্তোরার রঙ্গীন পর্দা, পাশের টেবিলে মুখোমুখি নির্বাক দম্পতি,মোবাইলের রিংটোন, সামিনার নিঃশব্দ হাসির শব্দ শুধু সামিনা ছাড়া।
হয়তো মুহুর্ত কয়েক।সামিনা হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করেছিলো তার হাত।জিজ্ঞেস করেছিলো-হঠাৎ বিষন্ন কেনো?
দেয়া উত্তর মনে নেই এখন আর রাশেদ আনোয়ারের। মনে না হওয়ার অস্বস্তি নিয়ে সে উঠে দাঁড়ায়।সামিনার দিকে ফিরে যেতে যেতে হঠাৎ করেই যেনো মনে পড়ে যায় তার - এই শিশুটার মৃত্যু দরকারী ছিলো। সামিনার বেঁচে উঠার জন্য। সামিনাকে জড়িয়ে ধরে তার আরেকবার নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য।

২।
পায়ের কাছে জোছনা এসে লুটোপুটি খেললে তার ঘুম ভেঙ্গে যায়।
জানালা খোলা ছিলো। অক্টোবরের রাতে এই পাহাড়ী শহরে আলতো করে শীত পড়তে শুরু করে। দরজার ওপাশে টানা বারান্দা। সামিনা উঠে তার নিরাভরন শরীরে আলগা করে শাড়ী জড়ায়।রাশেদ ঘুমিয়ে আছে, ঘুমিয়ে পড়া মুখে তার এক চিলতে হাসি, তৃপ্তি ও সারল্যের। রাশেদের নগ্ন শরীরে চাদর টেনে দিয়ে সামিনা এসে দাঁড়ায় বারান্দায়।
বাংলোটা শহর থেকে বেশ বাইরে একটা পাহাড়ের চুড়ায়।রাত হয়তো প্রায় শেষ।হালকা কুয়াশা পড়েছে, আশেপাশের পাহাড়গুলো জমাটবাধা গাঢ় সবুজের মতো।অনেক দূরের উঁচু পাহাড়ে ছেড়া ছেড়া আলো। রাশেদ বলছিলো ওটা মেঘালয়ের পাহাড়,আলোগুলো খাসিয়া পুঞ্জি। রাশেদ বলছিলো- মেঘালয়ে যেতেই হবে একবার। ওখানে মাথার উপর দিয়ে থোকা থোকা মেঘ ভেসে যায়,হাত দিয়ে সেই মেঘ ছুঁয়ে যায়।
এই লোকটার সাথে দেখা না হলে, এই লোকটার সাথে জীবন নতুন করে শুরু না করলে কতোকিছু অজানা থেকে যেতো সামিনার। কিন্নর বলে অনেক উঁচুতে নাকি একটা জায়গা আছে, সে জায়গার মেয়েরা স্বর্গের অপ্সরাদের চেয়েও সুন্দরী,কোন কোন আদিবাসী গ্রামে ফসল বুনতে যাওয়ার আগে পুরুষেরা নিজ নিজ নারীদের পুজো করে কেননা নারীরাই তো শস্যমতী, উৎপন্নের আঁধার।এতো কিছু জানা হতোনা সামিনার, এমনকি নিজের শরীর। শরীরের চরম তৃপ্তি, অর্গাজম,মাল্টি অর্গাজম, বিছানায় আধিপত্য নেয়া!
অথচ বিবাহিত জীবনের চারটা বছর কি দুর্বিষহ সমর্পণ ছিলো সামিনার। লোকটা এই শহরে চাকরী করতো, বিয়ে করে তাকে নিয়ে এসেছিলো।লোকটা ভালো ছিলোনা, লোকটা মন্দ ছিলোনা। তার কোন অভিব্যক্তি ছিলোনা, তার কোন প্রতিক্রিয়া ছিলোনা। অফিস শেষে সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফিরে টিভি দেখতো, সাথে থাকা মা-বোনের সাথে কথা বলতো, খাওয়া দাওয়া শেষ হলে পর দরজা লাগিয়ে মৃয়মান সামিনাকে টেনে নিতো।ক্লান্তিকর রমণ শেষে সিগারেট টেনে ঘুমিয়ে পড়তো।
দুবছরের বাচ্চাটা শেষপর্যন্ত মারা যাওয়ার পর সরকারী কবরস্থানে দাফন শেষে ঘরে ফিরে ও সে সিগারেট টেনেছিলো। তিনদিন পর সামিনাকে টেনেছিলো, সামিনা ঊরুর ভাজ খুলে দিয়েছিলো নিরবে।কয়েক মিনিট পরে আবার সিগারেট টানতে টানতে বলেছিলো- মরা বাচ্চাকে ভুলতে তোমার আরেকটা বাচ্চা দরকার।
সামিনা ভুলতে চায়নি তো! দুবছরের বাচ্চা, জন্ম থেকেই যার হৃদপিন্ডে ছিদ্র,শ্বাস নেয়ার সময় গড়গড় আওয়াজ উঠতো, নীল হয়ে যেতো ফর্সা তুলতুলে দেবশিশু সামিনা তাকে ভুলতে চায়নি কখনো। তবু লোকটার কি বিভৎস রমণ! সামিনা তখন কাঁপতো, পানিতে হাত ডুবিয়ে কাঁদতো, ক্ষিধে লাগতে লাগতে শরীর অবসন্ন হয়ে পড়তো কিন্তু কিছু খেতে পারতোনা।তবু লোকটার যেনো মরনপণ জেদ আরেকটা সন্তান জন্ম দিয়ে মৃত সন্তানকে ভুলে যাবে,ভুলিয়ে দেবে! পরপর দুবার গর্ভপাতের পর সামিনার আর ঊরুর ভাজ খুলে দেবার শক্তিটুকু ও অবশেষ নেই।
সামিনা হয়তো মরেই যেতো। তার ফিরে যাবার কোন জায়গা ছিলোনা। বাবা ছিলেননা, শয্যাশায়ী মা বড়বোনের সংসারে , ছোটভাই দুবাই। তবু সামিনা বেঁচে উঠলো শামীম ভাই ইংল্যান্ড থেকে ফিরে আসার পর।খালাতো এই ভাইটির স্নেহ ছিলো তার জন্য সবসময়। সামিনাকে জোর করে নিয়ে আসলেন তিনি।
একবছর পর রাশেদের সাথে সামিনার বিয়ের আয়োজন ও তার করা। বলেছিলেন সামিনাকে- জীবন ফুরিয়ে যায়না কখনোই।আরেকবার সাহস করে শুরু কর। রাশেদ অন্য রকম ছেলে।ইংল্যান্ডে ফিরে যাবেনা বলে ওর স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে ফিরে গেছে, ওরা ফিরবেনা আর। ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ায়,তুই ও তোর পড়াশুনোটা শেষ কর।
শামীম ভাই তাকে এই উপলব্দি দিয়েছিলেন জীবন হলো ষাঁড়ের লড়াই। সাহসী ম্যাটাডোরের মতো লড়তে না জানলে প্রথম রাউন্ডেই ফুরিয়ে যেতে হবে, রক্তাক্ত, ছিন্নভিন্ন হয়ে ছিটকে বেরিয়ে আসতে হবে। আর লড়তে জানলে হারতে হারতে ও শেষ মুহুর্তে জিতে যেতে পারে রক্তাক্ত মানুষ।
সামিনা জানে সে জিতে গেছে শেষপর্যন্ত। রাশেদ তাকে প্রথম জানিয়েছি কেবল ঊরুর ভাঁজ খোলে দেয়াই জীবন নয়। জীবন অন্যত্র, জীবন আরো কিছু।চলে যাওয়া সন্তানের জন্য রাশেদের গভীর বেদনাবোধ আছে, কিন্তু নতুন সন্তান জন্ম দিয়ে সেই বেদনা মুছে দেবার কোন তাড়া নেই তার। সামিনার হাতের আঙ্গুল নিয়ে খেলতে খেলতে বলছিলো সে- আমাদের মাঝখানে তৃতীয় কারো কী দরকার? এমনকি সন্তান! দুজন দুজনকে জড়িয়ে থেকে জীবন ফুরিয়ে দেবো। শুন্য করে চলে যাবো ভাণ্ডার!
এই শহরে এসে স্থায়ীভাবে থাকার স্বপ্ন দেখে রাশেদ। সামিনা জানে,এটা তার মৃত সন্তানের প্রতি রাশেদের সৌজন্যপ্রকাশ। রাশেদ তার মাতৃত্বকে শ্রদ্ধা করে, রাশেদ চায় সামিনা ভালো থাকুক তার সন্তানের কাছাকাছি। মৃত সন্তান।
অথচ সামিনার বড় অস্বস্তি হয়।গোপন পাপের মতো এক তীব্র অস্বস্তি তাকে আক্রান্ত করে। রাশেদ তার জীবনের আসার পর এই অস্বস্তি সে আবিস্কার করে। বড় সিদ্ধান্তহীন,পরিনতিহীন এই আবিস্কার, যেনো না হলেই সে বেঁচে যেতো। অথচ জানে সে- আদতে এই আবিস্কারই বাঁচিয়ে তুলেছে তাকে।
মৃত সন্তানের কথা মনে হলে এখন আর সামিনার কোন কষ্ট হয়না। আজ বিকেলে যখন সে একা বসেছিলো গাড়িতে আর রাশেদ গিয়েছে কবরস্থানের ভেতরে তখনো মৃত সন্তানের মুখ ভাসছে তার চোখের সামনে। ঐ ছোট ছোট হাত পা, তুলতুলে শরীরের ঘ্রান,শ্বাসকষ্ট সব স্পষ্ট মনে পড়ে তার কিন্তু এই মনে পড়ায় এখন আর কোন কষ্ট পায়না সে, যে কষ্ট নিয়মতান্ত্রিক, বাঞ্চিত। বরং একটা তীব্র সুখের মতো অনুভূতি জাগে খুব গোপনে।
সুখ? সুখের মতো?
মৃত সন্তানের স্মৃতিচারনে সুখের মতো অনুভূতি? সামিনার ভয় ভয় জাগে। নিজেকে পিশাচিনীর মতো মনে হয় তবু এই সুখের মতো অস্বস্তি সে অস্বীকার করতে পারেনা।এই সন্তান বেঁচে থাকলে সে নিজে আজকের এই বেঁচে থাকা জীবনটা যাপন করতে পারতোনা।
কবরস্থান থেকে বাংলোয় ফিরে আসার পথে রাস্তার পাশে একটা পাহাড়ে তারা থেমেছিলো। সূর্য তখন ডূবছে। রাশেদ বলছিলো চলো পাহাড়ের চুড়োয় বসে সূর্যাস্ত দেখি।পাহাড়ের ঢালে একটা গলফ কোর্স। অবশ্য ছেলেরা গলফ নয় ক্রিকেট খেলছিলো। পাশ দিয়ে হেঁটে যাবার সময় ওরা তাকিয়ে ছিলো। কেউ একজন বোধহয় কিছু বলছিলোও। সামিনার ভালো লাগছিলোনা। রাশেদ হাসছিলো- শরীর নিয়ে তোমার অস্বস্তি এখনো গেলোনা।ছেলেরা তোমার প্রশংসা করছে।
বাংলোয় ফিরে আসার পর রাশেদ বশংবদ দাসের মতো প্রশংসা করছিলো তার শরীরের। সামিনা ওর কৌশল জানে। সামিনাকে জাগিয়ে তোলার জন্য এইসব বদমায়েশী সে খুব ভালো জানে। সামিনাকে নিরাভরন করতে করতে বলছিলো এই পাহাড় চুড়োর রাতে তুমি কাউগার্ল হও। মাই ডিয়ারেস্ট হর্নি গার্ল!
ঘন্টা কয়েক আগের খুনসুটি মনে পড়তে পড়তে সামিনা টের পায় তার শরীর জাগছে আবার। যে শরীর মরে গিয়েছিলো, ঊরুর ভাঁজ খুলে দেয়া ছাড়া যে শরীরের আর কোন ভূমিকা ছিলোনা সে শরীরের এই তীব্র প্রানময়তা সামিনাকে এখন তুমুল দোলায়।
বারান্দায় থেকে জানলা দিয়ে সে ঘরের ভিতর দেখে। রাশেদ ঘুমিয়ে আছে। এই ঘুমন্ত রাশেদকে তেমন পুরুষ মনে হয়না তার এই মুহুর্তে। বরং সারল্য আর তৃপ্তি নিয়ে সে শিশুর মতো,যেনো তার গর্ভজাত শিশু।
সামিনা মুখ ফিরিয়ে নেয়। শরীরের জেগে উঠা আরো তীব্র হচ্ছে। চাঁদ চলে গেছে মেঘের আড়ালে। অন্ধকারে আরো অধিকতর জমাট বেঁধে আছে চারপাশের জঙ্গল, প্রকৃতি। সামিনা আলগা হয়ে থাকা শাড়ী সরিয়ে ফেলে তার শরীর থেকে।
প্রকৃতি এক প্রবল পুরুষ হয়ে জেগে উঠছে। শেষরাতের ঠান্ডাবাতাস, অন্ধকার আকাশে জেগে থাকা তারা, দূরের পাহাড়ের আলো, বনের জমাট সবুজ সব এক কাঠামোতে মিশে গিয়ে তৈরী হচ্ছে প্রবল পুরুষের আকার। সামিনা কেঁপে কেঁপে উঠে। টের পায় তার ঊরুর ফাঁকে প্রস্তুতি।যে পুরুষ আসলে নেই, প্রকৃত সেই প্রবল পুরুষের উত্থিত প্রবেশের জন্য টানটান প্রতীক্ষারত শরীর। সামিনার।


অন্তর্গত
কে কোথায় নিভে গেছে তার গুপ্ত কাহিনী জানি।
নিজের অন্তর দেখি, কবিতার কোন পঙতি আর
মনে নেই গোধূলিতে; ভালোবাসা অবশিষ্ট নেই।
অথবা গৃহের থেকে ভুলে বহির্গত কোনো শিশু
হারিয়ে গেছে পথে, জানেনা সে নিজের ঠিকানা
[সন্তপ্ত কুসুম ফোটেঃ বিনয় মজুমদার]


(উৎসর্গ: প্রিয় শিমুল, আনোয়ার সাদাত শিমুল'কে- যে একদিন বড় হয়ে, আরো বড় গল্পকার হবে)


১.
ঘুমের ভেতর অসুখের ঘ্রান পায় হাসান অথবা অসুখের ঘ্রানে ঘুম ভাঙ্গে। ঘুম ভাঙ্গে কিন্ত চোখ খুলতে পারেনা, চোখ খুলে তাকাতে পারেনা। যেনো চোখের ভেতরে মুঠো মুঠো বালি ঠেসে দেয়া। কড়কড়ে অস্বস্তি।
দু হাত উপরে চেপে ধরে ধীরে ধীরে খুলতে গিয়ে যেনো সে ঝলসে যায়, চোখের উপর হাজার ওয়াটের বাতি জ্বলছে। আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে দৃষ্টি গেঁথে যায় অনেক উঁচুতে জানালার গরাদে। গরাদ ঠেলে রোদ আসছে অথচ বাতাস নেই। ফুসফুসে হাসফাস।
এই কারাগার থেকে সহসা মুক্তি নেই, জেনে তবু কি এক অবোধ্য তাড়নায় সে লাফিয়ে উঠে গরাদ ভাঙবে বলে।
ঘোর। ঘোর কাটলে পরে হাসান টের পায় এটি তার ব্যক্তিগত শোবার ঘর মাত্র। গত রাতে বাতি নেভানো হয়নি। জানালার পর্দা ও টানা হয়নি। বেলা অনেক। বাইরের কড়া রোদ ঘরের ভেতর।

২.
বাচ্চাদের স্কুলের সকালের শিফট শেষ হবার আগে আগে রাস্তার উল্টোপাশে এসে দাঁড়ায় হাসান।
পাড়ার ময়লা নিয়ে যাচ্ছে একটা ভ্যান। ভ্যানের পেছন থেকে ময়লা গড়িয়ে পড়ছে রাস্তায়। মাইকে প্রবল চিৎকার। মানুষের অহেতুক ছুটোছুটি। স্কুলের গেটে এসে ভীড় করছে অভিভাবকরা। হাসানের কোন তাড়া নেই। অফিস ছুটি সপ্তাহখানেকের। কোথাও তেমন যাওয়ার নেই।
বাচ্চারা সব বের হয়ে আসার পর একজন দুজন করে মিস্ট্রেস ও বের হতে থাকে। একেবারে পেছনে চৈতী। হাসান রাস্তা পেরোয়। চৈতী হাত নাড়ে। কলাপাতা রংয়ের জামা, চুল বেনী করা- ওকে বালিকা বিদ্যালয়ের নবম শ্রেনী বলে ভ্রম হয়।
চোখমুখে রোদ ঝলমল আলো ফুটিয়ে ও এসে হাসানের বাহু স্পর্শ করে।-‘ চলো আইসক্রীম খাবো’
কিছুটা দূর হেঁটে ওরা আইস ক্রীম পার্লারে ঢুকে। ফালুদার গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে চৈতী বলে- তোমার তো ছুটি, চলো কাল কোথাও বেড়াতে যাই সারাদিনের জন্য। আমি ছুটি নিতে পারবো।

আইস ক্রীম পার্লারের ঠান্ডায় হাসানের ঘুম পায়। থুতনীতে হাত ঠেকিয়ে বলে-কোথায় বেড়াতে যাবে? এই শহরে নিঃশ্বাস নেয়ার মতো কোন জায়গা খুঁজে পাইনা আমি

চৈতী জানায় শহরের ঠিক অদূরেই নাকি একটা বিনোদন পার্ক হয়েছে। পার্কের ভেতরে পাহাড় আছে। পাহাড়ের নির্জনতায় ছোট ছোট কুটির। চাইলে সারাদিনের জন্য ভাড়া নেয়া যায়। শহরের সব প্রেমিক প্রেমিকেরা নাকি পয়সা খরচ করে প্রেম করতে ভীড় করছে ঐসব ভাড়াটে কুটিরে।
হাসান হাসে- যাওয়া যায়, পুরো দিনের জন্য আমরা ও একটা কুটির ভাড়া নিতে পারি।তবে কাল না। অন্য দিন।
-কাল নয় কেন?
- কাল বিকেলে অথৈর ডাক্তারের এপয়েন্টমেন্ট আছে।
-ওহ!

তারপর ক’মুহুর্তে শীতাতপ যন্ত্রের একটানা আওয়াজ ছাড়া আর কোন শব্দ থাকেনা।হাসান টেবিলে আঁকিবুকি কাটে। চৈতীই ফের কথা বলে
-কি অবস্থা মেয়েটার?
-ভালো না। ডাক্তাররা কিছুই ধরতে পারছেনা। ডায়াগোনোসিস চলছে একটার পর একটা।কিন্তু
-ওর বাবা একটা অমানুষ
-ওঁহু। সবই পরিস্থিতি।
-একমাত্র মেয়ের এই অবস্থায় সে বিদেশে পড়ে থাকতে পারলো?
-সে বিদেশে আছে বলেই অন্ততঃ মেয়েটাকে বাঁচানোর চেষ্টা করা যাচ্ছে
-বাচ্চাটাকে ওর বাবা চিকিৎসার জন্য নিয়ে যেতে পারেনা?
-নাহ। ও নিজেই এখনো বৈধ হতে পারেনি।
-ও তোমার খুব ভালো বন্ধু ছিলো, তাইনা?

হাসান কথা বলেনা। বিরক্ত হয়। চৈতীকে আগে ও বলেছে, তবু কি এক অদ্ভূত কারনে এই প্রশ্ন সে বার বার করে। অথৈ’র বাবা ফয়সাল কখনোই ওর বন্ধু ছিলোনা। সহকর্মী মাত্র। হাসান যখন অফিসে জয়েন করে ফয়সাল তখন মাত্র ক’দিন হয় বিয়ে করেছে প্রেম করে। দু পরিবারেরই অসম্মতিতে।সে দুপুরের লাঞ্চ নিয়ে আসতো বাসা থেকে। হাসানকে জোর করে খাওয়াতো। একদিনের জন্য ও সে হাসানকে বাইরে লাঞ্চ করতে দেয়নি। বাসায় নিয়ে গেছে। ওর বৌ নীলার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে, নীলার তখন বাচ্চা হবে। বাচ্চা হবার সময় প্রচুর রক্তপাত হলো, কাকতালীয় ভাবে রক্তের গ্রুপ মিলে গেলো হাসানের সাথে। হাসান রক্ত দিলো। বছর খানেক পর অফিসের এক প্রোগ্রামে আমেরিকা গিয়ে যখন ফয়সাল আর ফিরলোনা নীলা তখন হাসানকেই জানালো এটা তাদের পুর্ব পরিকল্পিত, আর্থিক দৈন্যদশা মেটানোর নাকি আর কোন পথ ছিলোনা।
আরো ক’দিন পর যখন অথৈ মেয়েটা অসুস্থ হলো- নীলা হাসানকেই জানালো, , আমেরিকা থেকে ফয়সাল ফোন করে অনুরোধ করলো ওর মেয়েটাকে নিজের মেয়ের মতো করে দেখতে, ওদেরকে দেখার আর কেউ নেই।
বন্ধন ভাল্লাগেনা, তবু জড়ায়-হাসান তবু জড়াতে থাকে নানা বন্ধন ও বিমুগ্ধতায়।

চৈতী হাসানের চুলে হাত ছোঁয়ায়। বলে- ‘আমার কিন্তু ভালো লাগে, এই যে একটা বাচ্চার জন্য তোমার এতো কেয়ার।তুমি খুব ভালো বাবা হবে, আমার চিন্তা নেই’
হাসান হাসে-‘ কি জানি, আমার বরং লালন ফকিরকেই ভালো লাগে।বলেছিলেন- জন্ম দিওনা, জন্ম দিলে আত্না খন্ডিত হয়ে যায়।‘
-'হয়েছে। তুমি লালন না। তুমি হলে হাসান। আমার হাসান'

প্রায় নির্জন আইসক্রীম পার্লারে চৈতী আরো ঘন হয়ে আসে, ঘন হয়ে আসে ওর চুলের ঘ্রান।
হাতের আঙ্গুল নিয়ে আনমনে খেলতে খেলতে ও বলে- যাবে এখন আমার সাথে? মেয়েটাকে দেখে আসি। ওর মা একেবারে একা।
চৈতীর হাত ফিরে যায়।
যেতে যেতে বলে - 'আজ আমার কাজ আছে।অন্য কোন দিন যাবো। আজ তুমি একাই যাও'

তারপর আর তেমন কথা এগোয়না। সমস্ত সুঘ্রান নিয়ে মেয়েটা চলে যাওয়ার পর ‘একা’ শব্দটা বড় ভারী ও তপ্ত হয়ে উঠে হাসানের জন্য।হিমহিম আইস ক্রীম পার্লারে ফিরে আসে সকালের হাসফাস, অসুখের ঘ্রান।

ক’বছর আগে কলেজের বন্ধু এন্টনীর সাথে ও বেড়াতে গিয়েছিলো খাসিয়া পল্লীতে। এন্টনীর দাদী থুত্থুড়ে বুড়ি নাকি হাত দেখে ভবিষ্যত বলে। কৌতুহলে সে ও বসেছিল বুড়ির পাশে। হাত ধরে রেখে দীর্ঘক্ষন, ফিসফিসিয়ে বুড়ি বলেছিল-‘ তোর তো শরীর ভরা অসুখ রে ব্যাটা!’

শরীর ভরা অসুখ নিয়ে গ্লাসডোরে ঠেলে বেরিয়ে আসে হাসান।

৩.
বাইরে প্রবল রোদ। থকথকে মানুষের দল। দলবদ্ধ জটলা। অথৈদের বাসায় যাবার জন্য রিক্সা, টেক্সী কিচ্ছু নেই।অলংঘনীয় জ়্যামে আটকে আছে গোটা শহর। জ্যামে আটকে আর্তনাদ করছে একটা ফায়ার সার্ভিসের গাড়ী। একটানা হর্ণ বাজাচ্ছে। একচুল নড়ছেনা কেউ। হাসান রাস্তায় নেমে এসে হাঁটতে থাকে।

ফুটপাত বলে কিছু নাই। মানুষের শরীরের উপর দিয়ে গড়িয়ে হাঁটছে মানুষ। ছুটছে আরেকদল। আরেকদিক থেকে হর্ণ বাজাতে বাজাতে চলে গেলো পুলিশের গাড়ী। কেউ একজন চিৎকার করে বললো-শহরের প্রধান বিপণীতে আগুন লেগেছে। বেশ উঁচুতে আগুনের শিখা। অনে দূর থেকে তার হল্কা এসে ধাক্কা দিলো।

হাসানের শরীর জ্বলছে। কাল ফেরার আগে পিঠে নখের আঁচড় বসিয়ে দিয়েছিলো নীলা।সারা রাত জ্বলেছে, এখন জ্বলছে আবার ।
শহর জ্বলছে। শরীর ভর্তি আগুন নিয়ে হাসান দৌড়ায় এবার।

দৌড়ের ভেতর অসুখের ঘ্রান পায় হাসান অথবা অসুখের ঘ্রান নিয়েই দৌড়ায়। দৌড়ায় অথচ চোখ খুলতে পারেনা, চোখ খুলে তাকাতে পারেনা। যেনো চোখের ভেতরে মুঠো মুঠো বালি ঠেসে দেয়া। কড়কড়ে অস্বস্তি।


।।ব্যক্তিগত পোষাক।।
কফিপটে উত্তাপ।ফুলদানীতে তাজা ফুল।ঘ্রানহীন,রংচঙ্গে।জানলায় ভারী পর্দা।দেয়ালজুড়ে আয়না।
শামীম হায়দার আয়নায় নিজেকে দেখলেন।নিজের প্রতিবিম্ব দেখলেন।শরীরের শীর্নতা ফুরিয়েছে অনেক আগেই।তলপেটে কিছুটা মেদ জমলেও নিজের নগ্ন শরীরকে এখনো ভালো না লাগার মতো সময় আসেনি।শিশ্ন আপাতঃ শিথিল।
কোমরে তোয়ালে জড়ালেন। ভারী পর্দা সরালেন কিঞ্চিৎ।বিকেলের আলো এলো ঘরে।
বালিশে মুখ গোঁজে থাকা সোহানা আক্তার মুখ ফেরালেন।ভ্রুঁতে প্রশ্নবোধ।
শামীম হায়দার পর্দা টেনে দিলেন।
হলিডে হোমসের এই ঘরে এখন আর বিকেল নেই।
স্ত্রী জানেন জরুরী মিটিং আছে।মিটিং শেষে ডিনার পার্টি।ফিরতে রাত হবে।বেশ রাত।বিদেশী ব্যাংকের স্থানীয় শাখার প্রধান ব্যবস্থাপকের এমন রাত হয়। স্ত্রী অভ্যস্ত। সন্তানদ্বয় ও।
বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্ধ্বতন প্রভাষিকা সোহানা আক্তারের ব্যবসায়ী স্বামী আমদানী কাজে সিঙ্গাপুর।একমাত্র সন্তান শ্বাশুড়ীর কাছে নিরাপদ।ছাত্র-ছাত্রীদের একটা অনুষ্ঠান আছে।ফিরতে দেরী হবে।
শামীম হায়দারের ব্যাংক ও সোহানা আক্তারের বিশ্ববিদ্যালয় দুটোই যথাক্রমে একটি সুপারমার্কেটের চতুর্থ ও সপ্তম তলায়। সতের বছর তাদের দেখা হয়নি।দেখা না হওয়ার সতের বছর তারা সুপার মার্কেটের চতুর্থ ও সপ্তম তলায় কার্যরত ছিলেন তেমন ভাবনার কোন কার্যকারন নেই।
। শামীম হায়দারের বাবা ছিলেন মফস্বল শহরের সমাজসেবা কর্মকর্তা। আর সোহানা আক্তারের বাবা ছিলেন শিক্ষা কর্মকর্তা। দু কর্মকর্তাই সেই মফস্বলে বদলী হয়ে এসেছিলেন অন্য কোন মফস্বল থেকে।উপজেলা চত্বরের মধ্যে পাশাপাশি নিবাস ছিলো তাদের। শামীম হায়দার ও সোহানা দুজনই তখন অষ্টম শ্রেনী।
শামীম হায়দার বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়-কালো প্যান্ট,সাদা সার্ট,বাটার জুতো। সোহানা আক্তার উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়- সাদা সেলোয়ার,আকাশী জামা, সাদা উড়না।সোহানা ইতিমধ্যে প্রেমে পতিত।উপজেলা চেয়ারম্যানের চাচাতো ভাই যে কলেজের একাদশ শ্রেনীতে, সে টিফিন পিরিয়ডে বালিকা বিদ্যালয়ের গেটে এসে দাড়ায়। সাইকেলের টুংটাং আওয়াজ হয়।চিঠি বিনিময় হয়।একদিন সন্ধ্যেবেলা বিদ্যুৎবাতি কোন কারনে না জ্বললে উপজেলা শিক্ষাকর্মকর্তার সরকারী নিবাসের দেয়াল টপকে কে যেনো ভেতরে ঢোকে। কর্মকর্তাটি স্ত্রী সমেত গিয়েছিলেন দাওয়াত খেতে এক বিদ্যালয় শিক্ষকের বাড়ীতে। বৃত্তি পরীক্ষা সমাগত বলে একমাত্র কন্যাটি একাকীই ছিলো।
শীর্ণ শামীম হায়দার তার জন্য বেজায় ভারী ছাত্রসখা বইটি নিয়ে সেই সন্ধায় কড়া নেড়েছিল সোহানাদের দরজায়। দরজা খুলেনি কেউ। আসন্ন বৃত্তিপরীক্ষার ইংরেজী রচনা কোনটা বেশী ইম্পোর্টেন্ট - ‘এইম ইন লাইফ’ নাকি ‘জার্নি বাই বোট’ সেই সিদ্ধান্তে আসা জরুরী ছিলো তার জন্য, জরুরী ছিলো সোহানার সাথে কথা বলা। তাই ক্রমাগত কড়া নাড়া ও প্রত্যাখান তাকে অসহিষ্ণু করে তুলছিল। পেছনের দেয়ালের নীচ দিয়ে ভিতরে ঢোকার একটা পথ জানা ছিলো তার। দেয়াল টপকানো ক্লেশটুকু করতে হয়নি তার।
যে উপগত ছিলো সে দেখিনি, যে শয্যাগত ছিলো সে দেখেছিলো। শামীম হায়দার পালিয়ে এসেছিলো।
একুশ বছর পর, সুপারমার্কেটের ছাদে গড়ে উঠা বাহারী রেঁস্তোরার একবারে কোনার টেবিলে বসে সোহানা আক্তার যখন বলছিল- ‘অনেক দিন আমি অর্গাজমের আনন্দ পাইনি’ শামীম হায়দারের মনে পড়ে গিয়েছিল সেই সন্ধ্যা, সেই সন্ধ্যায় কি ঐ আনন্দ পেয়েছিল সে?
জিজ্ঞেস করা হয়নি। কিন্তু সেই রাতে, রেঁস্তোরা থেকে ফিরে আসার পর রাতে তার স্ত্রী দীর্ঘদিন পর অর্গাজমের আনন্দ পান।চোখ বন্ধ নি;শ্বাস নিচ্ছিল শামীম অর্ধ-উত্থিত শিশ্নে ঠোঁট বুলিয়ে স্ত্রী বিড়বিড় করেন- ‘আই লাভ ইউ ম্যান’ ।
খোলাপিঠ নিয়ে সোহানা আক্তার আবার উপুড় হন। শামীম জানালার কাছ থেকে ফিরে আসেন।
-কিছু বলবে?
-নাহ
-খারাপ লাগছে?
-নাহ
-অনুশোচনা
-নাহ!
বিছানার পাশে একটা সিডি প্লেয়ার।আগে খেয়াল হয়নি কারো। খেয়াল করার মতো ধৈর্য্য ছিলোনা কারো।আলগোছে বাটন টেপা হয়। অপরিচিত কন্ঠ গেয়ে উঠে চেনা গান
‘চেয়ে থাকি দাঁড়িয়ে দ্বারে, চেয়ে থাকি
যে ঘরে ঐ প্রদীপ জ্বলে তার ঠিকান কেউ না বলে
বসে থাকি, বসে থাকি পথের নিরালায় গো
চিররাতের পাথার পাড়ে হায়গো… ‘
এয়ারকন্ডিশনারের ঠান্ডায় শীতবোধ হয়।
শামীম হায়দার কফিপট থেকে কফি ঢালেন। এক কাপ। এক কাপ খালি থাকে। ভারী পর্দা সরান আবার। সন্ধ্যা ঘনাচ্ছে। এখন আর বিকেলের রোদ নেই। ঘরের ভেতর আলোর প্রবেশ নেই। সোহানা আক্তার তার খোলা বুক নিয়ে চোখ মেলেননা এবার।
হলিডে হোমসের বাইরের দিকের বাগানে একজোড়া ছেলেমেয়ে।পরস্পরকে জড়িয়ে আছে। মেয়েটার হাতে কিছু একটা। অতোদূর থেকে স্পষ্ট বুঝা যায়না। আইসক্রীম হতে পারে। মেয়েটা ছেলেটার মুখে তুলে দিচ্ছে। দুজন হাসছে।
শামীম হায়দার, সোহানা আক্তারকে শুনিয়ে বলেন- 'দেখো, ওরা প্রেম করছে।'


।। কবি ও প্রেমিকাগন ।।
আমার এমন হয় ।
দীর্ঘ প্রস্তুতির বিনিময়ে কোন কোন কাজ শেষ করতে গিয়ে, শেষ মুহুর্তে আমাকে আঁকড়ে ধরে অবসন্নতা । মনে হয়, থাক । বরং বাদ দেই, বরং ফিরে যাই…
প্রথম যেদিন রিমি’র জামার বোতাম খুলেছিলাম-আমার দীর্ঘ প্রস্তুতি ছিল সেটা,মনে আছে । কারো কারো এইসব সহজে হয়ে যায় । আমার হয়না । বেশ তো ক’দিন হয়ে গেল । এখনো মনে আছে, রিমি’র জামায় পাঁচটা বোতাম ছিলো । ও চোখ বুঁজে ছিলো । আমি প্রথম বোতামে বেপরোয়া ছিলাম,দ্বিতীয় বোতামে কামার্ত, তৃতীয় বোতামে সাহসী হয়ে চতুর্থ বোতামে অবসন্নতা ।মন বলছিল- থাক এতোটুকুই, বাদ দেই এবার, ফিরে যাই । মুহুর্তের অমনোযোগীতায় রিমি চোখ খুলেছিল আর হাতের আঙ্গুল ও অবাধ্য হয়েছিল আমার ।
এই বিকেলে কালো গেটের সামনে দাঁড়িয়ে সেই একই রকম ফিরে যাওয়ার আকুতি টের পাই নিজের ভেতর অথচ এই বিকেলের জন্য, এই গেটের সামনে দাঁড়ানোর জন্য কতোদিনের অপেক্ষা আমার!
এবারো হাতের আঙ্গুল অবাধ্য হয়ে উদ্ধার করে আমাকে । কলিং বেল চাপি ।
মধ্যবয়স্ক কাজের লোক এসে গেট খুলে দেয় ।
আমার কি কিছুটা মন খারাপ হয়?
লোকটা নাম জিজ্ঞেস করে,তারপর জানান দেয়-তিনি ভেতর ঘরে অপেক্ষায় আছেন । আমি লোকটাকে অনুসরন করি কেবল । অনুসরন করতে করতে ঘাড় ঘুরিয়ে বাড়ীটা দেখি । খুব পুরনো নয় অথবা বাড়ীটা পুরনোই,নতুন করে সাজানো হয়েছে । দোতলায় টানা ছাদ, নিচে বেশ বড় একটা বাগান, বাগান পেরিয়ে মুল বারান্দা । আমরা বারান্দায় উঠি । বারান্দা পেরিয়ে ভেতর ঘর ।
ভেতর ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে তিনি। বয়স হয়েছে বুঝা যায় কিন্তু চিবুকে এখনো স্নিগ্ধতা ও আভিজাত্যের মিশেল । বেশ ঘরোয়া কিন্তু দামী শাড়ী জড়ানো গায়ে । কোন কোন মুখ দেখলে সাদা-কালো এলবামের ধ্রুপদী ছবি মনে হয় । এ মুখ সেরকম ।
তাঁর চোখে কৌতুহল,ঠোঁটে চাপা হাসি ।
-টেলিফোনে গলা শুনে আপনাকে আরো বয়স্ক মনে হচ্ছিলো ।
আমি হাসি । সবিনয়ে বলি-
-আমাকে তুমি করে বললে খুশী হবো ।
-ঠিকাছে, ভিতরে এসো ।
আমরা ভেতরে যাই।কাজের লোকটা অন্য কোথাও চলে গেছে।এই ঘরে শুধু তিনি এবং আমি। বেতের সোফায় বসি।পাশের সোফায় বসতে বসতে তিনিই কথা শুরু করেন-
-আমি কিন্তু তোমাকে ঠিক চিনতে পারিনি ।
নাম শুনে চিনে ফেলা অসম্ভব জেনেই আমি আমার নামটা বলি । তারপর বলি
-আমি ঢাকা থেকে এসেছি । সিনেমা বানাই
-ওহ । শুটিং করতে এসেছো? আমাদের ছোটবেলায় এখানে কতো শুটিং হতো । এখন মনে হয় সেরকম হয়না ।
-আমি ঠিক ওরকম সিনেমা বানাইনা । ডকুমেন্টারী করি ।
-আচ্ছা!
টের পাই-আমার সামনে যিনি বসে আছেন-এই শহরের সরকারী বালিকা বিদ্যালয়ের অবসর নেয়া প্রধান শিক্ষিকা,যার স্বামী বছর কয়েক আগে প্রয়াত, ছেলে মেয়েরা লন্ডন ও নিউইয়র্কে সেটেলড, নিজে ও বছরের বেশীর ভাগ সময় এখন বাইরে থাকেন- তার ভেতর আমাকে নিয়ে যুগপৎ কৌতুহল ও অস্বস্তি কাজ করছে ।
আমাদের মধ্যে ছেঁড়া ছেঁড়া কথা হয়
-আমি গত সপ্তাহে লন্ডন থেকে ফিরেছি । এতো ঠান্ডা পড়েছে এবার । ভাল্লাগেনা থাকতে ।
-আমি জানি ।
-জানো?
-জ্বি । আপনার ফেরার অপেক্ষায় ছিলাম । ফিরেছেন জেনেই আমি এসেছি ।
এবার তিনি স্পষ্ট করে আমার দিকে তাকান । কন্ঠ একটু ও না কাঁপিয়ে বলেন
-ঠিক কি কাজে তুমি এসেছো, বলোতো?
আমি বুকের একটু গভীরে বাতাস টেনে নেই । ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে বলি
-একটা ডকু ফিল্ম বানাতে যাচ্ছি । আপনার সাহায্য দরকার । ইনফ্যাক্ট আপনার সাহায্য ছাড়া আমি পারবোনা । সেজন্য আপনার লন্ডন থেকে ফেরার অপেক্ষায় ছিলাম ।
তিনি হেসে উঠেন
-তোমার ফিল্ম বানাতে আমি সাহায্য করবো? কি সাহায্য করবো বলোতো? নানী-দাদীর ক্যারেক্টার করতে হবে? আমি জীবনে ও অভিনয় করিনি ।
তার হাসিতে আমি ও হাসি
-৩০ বছর আগে জন্ম নিলে আপনাকে আমার ফিল্মের নায়িকা বানাতাম ।
এবার আমরা দুজনেই একসাথে হেসে উঠি ।
হাসির রেশ থামার আগেই আমি জরুরী কথাটা বলে ফেলি
-একসময়ের বিখ্যাত একজন কবি’কে নিয়ে আমি ফিল্ম করতে চাচ্ছি । তার জীবনের জরুরী কিছু বিষয় আপনার সাথে জড়িত । এ গুলো আমার জানা দরকার ।
খুব স্থির কন্ঠে তিনি বলেন
-কার কথা বলছো তুমি?
-কবি রায়হান মুস্তাফিজ ।
-তুমি কে?
-আমি তার ছেলে ।
তিনি আর্তনাদের মতো আমার অগ্রজের ডাক নাম উচ্চারন করেন ।
-ও আমার বড় । খুব ছোটবেলায় আপনি ওকে দেখেছেন । আমার জন্ম তার পরে । আমরা তখন এ শহর ছেড়ে চলে গেছি ।


কাজের লোক ট্রলি ভর্তি নাস্তা নিয়ে ঢুকে । আমাদের কথায় স্তব্দতা নেমে আসে । তিনি আমাকে গাজরের হালুয়া এগিয়ে দেন । আমি নাড়াচাড়া করতে থাকি ।
কাজের লোক বেরিয়ে গেলে তিনিই আবার কথা শুরু করেন
-তোমার বাবা আমার কথা বলেছে?
-না । মা ।
- ও । কেমন আছেন তিনি?
-মা মারা গেছেন চার বছর আগে ।
- আমি দুঃখিত ।
-না ঠিকাছে । মারা যাওয়ার আগের দুবছর মা বিছানায় পড়েছিলেন । বড় ভাই কানাডায় চলে গেছে । বাবা ও তার মতো সময় কাটাতো । একমাত্র আমি মায়ের পাশে বসে থাকতাম । সেই সময়ে প্রথম আপনার কথা শুনি । মা অনেক গল্প করতো আপনার ।
-তোমার মা খুব ভালো ছিলেন ।
-আপনার তো বান্ধবী ছিলেন ।
-এক সাথে পড়েছি ।
কথা আবার থমকে যায় । তিনি বাবার কথা জিজ্ঞেস করেননা । তার জানতে ইচ্ছে করেনা নাকি অস্বস্তি?
-মায়ের মৃত্যুর পর বাবা ও চলে গেছে বড়ভাই এর কাছে । কিডনীর সমস্যায় ভুগছে ।
-ও
-বাবার সাথে আমার কখনোই তেমন ঘনিষ্ঠতা হয়নি । মা বিছানায় শুয়ে শুয়ে এতো গল্প করতো মানুষটাকে নিয়ে, পরে মনে হলো তাকে নিয়ে একটা ফিল্ম করা যায় ।
-তোমার মায়ের কাছে আর কি শুনেছো?
-বাবা এবং আপনার দীর্ঘসম্পর্ক ছিলো । আপনি চমৎকার গান গাইতেন আর কবি হিসেবে বাবার খ্যাতি ও ছড়াতে শুরু করেছে, সাথে ভালো চাকরী । প্রথম দিকে কিছুটা আপত্তি থাকলে ও শেষপর্যন্ত দু পরিবারের সম্মতি ছিলো । ছোট্ট মফস্বল শহরে আপনারা ছিলেন আদর্শ জুটি । কিন্তু…
-শেষ পর্যন্ত আমাদের বিয়ে হয়নি ।
-ঠিক এই বিষয়টাই আমি জানতে চাইছিলাম ।
-কেনো তোমার মা তোমাকে বলে যাননি?
আভিজাত্য ও স্নিগ্ধতা জড়ানো কন্ঠে তার এই প্রথম আমি কিছুটা শ্লেষের ইংগিত পাই ।
-না । এটা মায়ের কাছে ও রহস্য ছিলো ।
-তিনি তোমার বাবার বিবাহিত স্ত্রী ছিলেন ।
-মা আপনার বান্ধবী ছিলেন
-আমরা একসাথে পড়েছি ।
-যাইহোক । আপনি তো জানতেন তাকে । অতোটা সপ্রতিভ কখনোই ছিলেন না । নিজের ভেতর গুটিয়ে থাকতেন । বাবার সাথে ও তাকে আমরা খুব বেশী কথাবার্তা বলতে দেখিনি ।
-কিন্তু তোমার বাবা তো তাকেই বিয়ে করেছিলেন
-হ্যাঁ । আমার মায়ের কাছে ও এটা শেষদিন পর্যন্ত রহস্য ছিলো বাবা কেনো শেষপর্যন্ত তাকে বিয়ে করেছিলেন ।
-তাই নাকি? ভালো ।
আমি টের পাই একটা জটিলতা স্পর্শ করছে তাকে । আমি যা জানতে চাইছি তার বদলে কথাবার্তা চলে যাচ্ছে একজন প্রয়াত ও দুজন প্রায় বৃদ্ধ মানুষের বিগত যৌবনের হিসেব-নিকেশে । এখানে দাঁড়িয়ে আমি কার প্রতিনিধিত্ব করছি ? আমার মৃত নিস্প্রভ মায়ের,মৃত্যুর মুহুর্ত পর্যন্ত গুনী স্বামীর প্রতি যার অগাধ মুগ্ধতা ছিলো নাকি আমার সংস্পর্শহীন বাবার যাকে আমাদের কোনদিন তেমন করে বুঝে উঠা হয়নি ?
কিন্তু আমি তো এসব থেকে নিজেকে আলাদা রেখে প্রফেশনালী কিছু তথ্য জানতে চাই শুধু ।
আমি সমস্ত অস্বস্তি ঝেড়ে ফেলে এবার সরাসরি তাকে জিজ্ঞেস করি
-কবি রায়হান মুস্তাফিজের সাথে শেষপর্যন্ত আপনার বিয়েটা হলোনা কেনো? আমার ফিল্মের জন্য এই তথ্যটা জরুরী । প্লিজ আপনি ইজিলি আমাকে বলেন, সমস্ত প্রস্তুতি শেষে ও কেনো রায়হান মুস্তাফিজ বিয়েটা ভেংগে দিলেন ?
ঢং করে আওয়াজ দিয়ে না উঠলে আমি খেয়ালই করতাম না ঘরের দেয়ালে একটা বিশাল ঘড়ি । তার পেন্ডুলাম দুলছে ।
ঠোঁট কামড়ে তিনি উঠে দাঁড়ালেন । তার মুখের রঙ এতোটা সাদা আগে খেয়াল করিনি ।
-আছরের ওয়াক্ত হয়েছে, আমি নামাজ পড়তে যাচ্ছি । তুমি নাস্তাটা শেষ করে যেও ।


তিনি তার সমস্ত আভিজাত্য ও স্নিগ্ধতা নিয়ে চলে গেলে আমি স্থির দাঁড়িয়ে থাকি । পুরনো দিনের বিশাল দেয়াল ঘড়ির কাটাগুলো টিক টিক করে । বছর পঁয়ত্রিশ আগের সদ্য তরুনীকে আমার দেখতে ইচ্ছে জাগে । মফস্বল শহরের তার সৌন্দর্য্য রুপকথার মতো ছড়িয়ে বেড়াতো । মৃত্যুশয্যায় শুয়ে শুয়ে ও আমার মা সেই গল্প বলতেন । তার বলায় কোন হিংসা ছিলোনা । স্বামীর সাবেক প্রেমিকার জন্য তার নিজের ও মুগ্ধতা ছিলো । নাকি এই প্রসিদ্ধ সৌন্দর্য্যকে অস্বীকার করে বাবা তাকেই বিয়ে করেছিলেন বলে আমার অপ্রতিভ, গুরুত্বহীন মায়ের গোপন অহংকার ছিলো?
বাবা লোকটা চিরদিন আমার কাছে বিরক্তিকর এক রহস্য থেকে গেলো । আমি তার মতো এতোটা নির্মোহ, নিমগ্ন অথচ অন্যদের কাছে গুরুত্বপূর্ন হয়ে উঠতে পারলাম না । মায়ের প্রতি তার কোন মনোযোগ ছিলোনা তবু মায়ের কি অসীম মুগ্ধতা ছিলো এই মানুষটার জন্য। দীর্ঘ সম্পর্কের পরিনতিতে বিয়ের সমস্ত আয়োজন শেষে যে প্রেমিক অস্বীকৃতি জানায় তার জন্য ও এই ধ্রুপদী সুন্দরীর এতো অভিমান?
লোকটাকে আমার অসহ্য ঠেকে ।
-তোমার বাবার বিরহের শখ জেগেছিলো । তার কবিত্বের পূর্নতার জন্য নাকি ওটা জরুরী ছিলো
আমি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে দেখি । তিনি ভেতরের সিঁড়ি ভেংগে নেমে এসেছেন আবার । এবার তাকে অনেকটা স্থির দেখাচ্ছে,যদি ও চোখ দুটো লাল হয়ে আছে ।
-জ্বি!
-হ্যাঁ, তুমি তো এটাই জানতে চেয়েছিলে । বড় কবি হওয়ার লোভে তোমার বাবা আমাকে বিয়ে করেননি । তিনি বড় কবি হয়েছেন ।
-ও
আমি কোন ভাষা খুঁজে পাইনা ।
-আমাদের যেদিন আনুষ্ঠানিক ভাবে বিয়ের দিনতারিখ ঠিক হবার কথা সেদিনই তিনি আমাকে জানিয়েছিলেন, কবি হওয়ার জন্য তার বিরহের অভিজ্ঞতা খুব জরুরী । যেনো আমি তাকে সেই অভিজ্ঞতা দান করি । তোমাকে বাবাকে আমি বড় কবি হবার জন্য বিরহ দান করেছিলাম
আমার কাছে সবকিছু পাজলের মতো লাগে । তার দিকে আমি চোখ তুলে তাকাতে পারিনা । যেনো রোমান সম্রাজ্ঞীর দারুন গরিমা নিয়ে তিনি এক কবিযশপ্রার্থী অপরিপক্ক তরুনকে মৃত্যুদন্ড দান করছেন ।
এই গরিমা, তার কন্ঠের তেজ আমার কাছে অসহ্য লাগে ।
-তোমার সিনেমাটা বানানো হলে আমাকে জানিও । বহুদিন সিনেমা দেখিনি । কি নাম দেবে সিনেমার?
বাহ। মুহুর্তের মধ্যে আমি আমার না বানানো সিনেমার নাম খুঁজে পাই । এই নামই হবে গরিমাময়ী সম্রাজ্ঞীর বিরুদ্ধে আমার সামান্য অস্ত্র ।
- সিনেমার নাম হবে ‘কবি ও প্রেমিকা গন’
-প্রেমিকা গন ! ‘গন’ কেনো?

আমার অস্ত্র তবে একেবারে ভোঁতা নয় । তারদিকে আর না তাকিয়ে বাইরে দরজার দিকে পা বাড়িয়ে বলি
-কারন কেবল আপনিই কবি রায়হান মুস্তাফিজ এর একমাত্র প্রেমিকা ছিলেন না ।
আমি তার দিকে তাকাইনা আর ।
কিন্তু তার নিচু কন্ঠের স্পষ্ট উচ্চারন শুনি
-তুমি তোমার বাবার মতোই হয়েছো ।
সম্রাজ্ঞীর আহত কন্ঠ কেমন গোঙ্গানীর মতো শোনায় । বেদনাহত । আমি চোখ নিচু করি ।
কোন কোন দূরত্ব এতো অনতিক্রম্য হয়ে উঠে কেনো?

No comments:

Post a Comment