Total Pageviews

Wednesday, January 19, 2011

গদ্য

দৃশ্যজন্ম দৃশ্যমৃত্যু


দিবাকর সরকার



বাড়ির ছাদে একটা ঝাঁ চক্‌‌চকে বিড়ালি কার্নিস ধরে হাঁটার প্রচেষ্টায়, আর একটা তেলমজানো কাক এসে তার লেজে ঠোক্কর দিচ্ছে।


এই দৃশ্যটুকু আমি দেখছিলাম। চুলহীন ছাদের ওপর। চিত হয়ে শুয়ে মাদুরের বিছিয়ে থাকার ওপর। এই দৃশ্যের সমস্তটুকু আমি শুষে নিচ্ছিলাম চাবির রিং-এর বৃত্ত দিয়ে। বাঁ চোখ চেপে, বুজে। ডান চোখ কেরামতি করে, খুলে।


বিড়ালিটা আমাদের বাড়ির নয়। সম্ভবত দত্ত বাড়ির নতুন আমদানিও নয়। বিশ্বাস বাড়ির এই জন্যই নয়, কারণ ওঁদের বিড়ালিটা গত পুজোয় রাস্তায় একটা টু-হুইলারের তলায় চলে গেছিল। চ্যাপ্টাও হয়ে গেছিল।


সেই ভেদির সম্পর্কে না বললেই নয় একটু। মৃত্যুর আগের কদিন ওকে কোলে বসিয়ো শ্রীমদ্‌‌ভগদ্‌‌গীতা পড়ে শোনাতেন কাকিমা। এদিকে আমি 'পর্যন্ত' শব্দে য-ফলা বসাই না বলে বাবার সঙ্গে প্রায়শই ঝামেলা লাগাতেন বাবা। মানে অতুলদা'র বাবা, যিনি আমাকে বাংলা পড়াতেন। আর প্রত্যেক দিন আমার কাছে নতুন করে বাংলা বানান শিখতেন। বাংলার বানান বিভাগটা আমার সিদ্ধহস্ত দেখে বেজায় চটে যেতেন উনি। ফলে পরের সময়টুকু ছিল বাবার সঙ্গে তুলকালাম বাধিয়ে দেওয়ার পর্ব। আর তুলকালাম শেষে রেগেমেগে-একশা বাবা এবং অতুলদা'র পরাজিত বাবা যখন যিনি-যাঁর বাড়ির দিকে পা বাড়াতেন, ভেদিসোনা জানলা দিয়ে সড়াৎ ঢুকে পড়ত আমাদের বিছানায়। বিছানা থেকে সন্তর্পণে রান্নাঘরে রান্নাঘরের বাসনসংকুল পথ অতিক্রম করে মাছ মুখে সোজা ছুট্‌‌ লাগাত নিজের বাড়ি। মানে অতুলদাদের বাড়ি আর এই ভাবে, নিজস্ব গৃহস্থের পরাজয় মুখ বুজে সহ্য করতে না পেরে, সে বেচারি, প্রায় প্রত্যেক দিন একবার-না-একবার আমাদের মৎস্যমুখী পরাজয় ঘটাতই।


সেই ভেদি, টু-হুইলার চলে যাবার পরও যখন রাস্তা ছেড়ে আমাদের বাড়ি আসেনি, গালাগালি বা ঝাঁটা কিচ্ছু খেতে আসেনি, ওর ঠিকরে বেরিয়ে আসা ফিলিপাইন টিউবকে ঘিরে বিচ্ছু ছেলেদের গোল্লা গোল্লা চোখের উৎসাহ যখন চরমে, অতুলদা'র বাবার বাক্‌‌‌রোধ হয়ে যাওয়ার দৃশ্য আমার কাছে একছটাক অতুলনীয় ঋত্বিক ঘটক।


এই কাকামি-কে যে অতুলদা'র বাবা নির্বাক খেয়াল করছিলেন, তা সহসা আমার দৃষ্টিবৃত্তে ধরা পড়ল। শীতের উড়ন্ত রোদ মাখতে মাখতে তারের জালির ওপর শুকোতে দেওয়া বিউলি ডালের নরমসরম বড়িগুলো পাহারা দিচ্ছিলেন তিনি।


অতুলদা যে-বার মারা যায়, তখন মাটিতে-মাটিতে, পিচে-পিচে, পশ্চিমবঙ্গ, বর্ষার রচনা লিখছে। ১৯৯৪। সে বার মাধ্যমিকের প্রশ্নও নাকি খুব হার্ড হয়েছিল। ভেদি অবশ্য তখনও ওদের বাড়িতে আসেনি যাই হোক, পরীক্ষা দিয়ে সে-ছেলে আর বাড়িমুখো হয়নি। রাস্তায় গুলি খেয়ে মারা যায়। কে বা কারা মারল, কেন মারল, তার কিনারা করার জন্য অবশ্য তিরিশে আইনের পুলিস এখনও আসে। চায়ের পেয়ালায় তাদের অন্-ডিউটি ঠোঁটের সবল টান আমার কানেও এসেছে বার কয়েক।


আমার মনে হয়, বর্ষাই মেরেছে। পা হড়কিয়ে মেরেছে বুলেটে ফুটো করেছে ওর ঢ্যাঙা দেহের বাঁ দিকটা। ...যখন বগলে ফোঁড়া হয়, বাড়িতে বসে কাব্য জরিপ করি না, অথবা মার্জিন অভ্‌‌ মার্জিন পড়তে পড়তে টাটা টি খেতে ভুলে যাই না, তখন এ-সবই ভাবি।...


তবে চিৎকেলিয়ে রাস্তায় যখন পড়েছিল, ওর রক্ত, রাস্তার শরীরে শরীর মিলিয়ে দেবার আবেশে, চারিদিকে শত শত হাত মেলে দিয়েছিল। ওই লাল, যা অ্যাডোব ফটোশপে এখনও আনতে পারেনি, আমাকে আর তাড়া করে বেড়ায় না। পরবর্তীতে ও রকম লাল, মাটি-রক্তের পুনঃশিলীভবন, আমার পঁচিশ বছরের জীবনে আমি অনেক দেখেছি। প্রথম-প্রথম এগুলো দগ্ধ করত। দ্বিতীয়ে-দ্বিতীয়ে এগুলো বিদগ্ধ করেছে।


অন্তঃসারশূন্য ধাতব লেন্সটা চোখের সামনে থেকে সরিয়ে নিলাম। অতুলকাকুও দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে চলে গেলেন। মাদুরটাকে এগরোলের মতো পাকিয়ে সিঁড়ির দিকে যেতেই পাম্প চালানোর আওয়াজ এলো। আর তৎক্ষণাৎ, বায়স-কোপের হাত থেকে বেঁচে কার্নিস থেকে লাফিয়ে চলে গেল বিড়ালিটা। কাকটাও চলে গেল। কলোনিয়াল হ্যাং-ওভারের ইচ্ছাকৃত ইচ্ছায়।


চোখের রমণ শেষে আমিও ফিরলাম। নিচে নীচে।



.................




বাথরুমই পৃথিবীর একমাত্র স্বাধীন জায়গা ~ একথা অনস্বীকার্য। আচ্ছা, স্বাধীন না-বলে স্বেচ্ছাধীন বলি, তাহলে লোকের গোঁসাও হবে না, আবার মিথ্যেও বলা হবে না। দরজা বন্ধ করে এখানে, এই নিজস্ব জগতে, আমি নিজের সত্তা সম্পর্কে সদাজাগ্রত না হয়েও থাকতে পারি। ঘোরো ফেরো, মস্তি করো, জল ঢালো, সাবান ঘষো। তাও আবার উদোম হয়ে এ রকম একটা বস্তুনিষ্ঠ আয়োজন পৃথিবীবাসীর মাথায় কী করে এলো, তা আমাকে সত্যি সত্যিই ভাবায়।


আমি একান্নবর্তী পরিবারে বিশ্বাসী নই। তবু ভাবি, একটা বউ আর গোটা আটচল্লিশ দস্তুর মতো পেটাই স্বাস্থ্যওলা গেঁড়িগুগলি যদি থাকত, আমি বাথরুমে ঢুকে নিশ্চিন্তে শুনতাম তাদের কলকাকলি, অর্থাৎ ক্যালোরব্যালোর। কিন্তু বছর পঞ্চাশ বাদে পৃথিবীটা শুনছি মারা যাবে তাই বউ-বাচ্চার রিস্‌‌ক্ নেওয়াটা ঠিক হবে না।


যাই হোক, বাথরুমের নৈঃশব্দের নাব্যতা অতুলনীয়। নৈঃশব্দের প্লবতায় আমি ভাসি একটা বড়ো টাবে জল নিয়ে তাতে হালকা করে পাছা চুবিয়ে বসে থাকি গরমে এর থেকে শান্তি আর কিছুতেই নেই। ঘরের টেবিলের ওপরে রাখা টেপ থেকে শ্রীকান্ত ভেসে আসে, "বুঝি এলো, বুঝি এলো, ওরে প্রাণ...।" সে-গানের সে-সুর নগ্নতাকেও অস্বীকার করে। কুলুপআঁটা দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে আসে দেশ-কাল-পাত্র'র কোনো বাছবিচার করে না এই রবীন্দ্রনাথ। একচেটিয়া বেওসা, প্রলিফারেইশন কাকে বলে, এই আক্কেলমন্দবুড়োর কাছে শেখা উচিত।




............




অতুলদা'র বাবা মারা গেলেন। কাকুর এই জীবনাবসানে পাড়ার মার্জারকুল তাঁর এস্টেট-এ এসে সমবেদনা জানিয়েছিল। মজন্তলি সরকার অবশ্য স্টেট-এ থেকেও জানায়নি। আমার বানান বিভাগের সূচিভেদ্য স্তর অতিক্রম করে অনুভব করেছি সেই ভাষার নিঃসহায় মাতৃত্ব বিড়ালি ও কাকের মধ্যে কলোনিয়াল বৈরিতার অবসানও দেখেছি।


চাবির রিং-এর বৃত্তের মধ্যে উঁকি মেরেছিলাম ওদের এস্টেট-এর অর্ধবৃত্তাকার উঠোনে। ঝাঁ চক্‌‌চকে ওই বিড়ালিটা ততদিনে রঙচটা, চোখেকালি, শীর্ণকায়।


আমার ভাষার নিঃসহায় মাতৃত্বহীনতার মুহূর্তে আরও দুটি দৃশ্য দেখেছি। দত্ত বাড়ির সব থেকে ছোটো সদস্য মিঠাইকে দেখলাম, ওদের কাজের মাসির আরও বাচ্চা ছেলেটিকে গৃহস্থের এক কোণায় ডেকে সদ্য কেনা ক্যাম্বিস বলটা দ্যাখাচ্ছে। আর এক কোণে, মার্জিন অভ্ মার্জিন-এ, কনকচূড় খই, অগুরু, আর ধূপ ~ ছড়ানো, ছিটানো ও ছড়িয়ে পড়ার আগে, দৃশ্যমৃত্যু ও দৃশ্যজন্মের সমাবর্তন উৎসবে নিছক কলোনিয়াল আড্ডায়...

No comments:

Post a Comment