Total Pageviews

Wednesday, January 19, 2011

গদ্য / চিন্তন

অচিন পাখি
সংকলন : মৃত্তিকা দাস

এই প্রবন্ধের শরীরে গাথা আছে বিভিন্ন কথা, লেখা, কথোপকথন। একটা পথ চলার সাক্ষী এ লেখা। সে পথ নিস্তব্ধ, গভীর, নির্জন। একটা ছটফটানি হাতছানি, ব্যস আর বুঝতে পারি না। দেখতে পাই না এ দু'নয়নে। ভিতরের কোন এক নাছোড় বান্দার ফরমায়েশে তৈরি হয়ে চলে এ লেখা। আর আমি হাঁটতে থাকি শুধু নিজের ভিতরে, আরো গহীনে অচীন পাখির সাক্ষাৎের আশায়। এই লেখার প্রথম অংশ আবু ইসহাক হোসেন-এর লেখা,দ্বিতীয়-তৃতীয় অংশ মোমেন মাঝি-র লেখা এবং শেষ অংশে প্রদোষ কান্তি সরকার-এর লেখা ধারণ করতে পেরে কৃতজ্ঞ। প্রতিটি লেখার কর্তিত রূপ এখানপ ব্যবহৃত হয়েছে।

বাউল শব্দের উৎপত্তি ও অর্থ
ব্যবহারগত দিক দিয়ে বাউল শব্দটির ইতিহাস খুব প্রাচীন নয় বলে গবেষকদের অধিকাংশের মত। তাদের মতে বাংলা সাহিত্যে বাউল শব্দের ব্যবহার আমরা লক্ষ করি মালাধর বসুর ‘শ্রীকৃষ্ণ বিজয়’ কাব্যের মাধ্যমে। মালাধর বসু তাঁর কাব্যে উপমা হিসেবে বাউল শব্দটি এভাবে ব্যবহার করেছেন,
‘মুকুল মাথার চুল/নাংটা যেন বাউল/রাক্ষসে রাক্ষসে বুলে রণে।’
বাউল শব্দটির ব্যবহার আরো ব্যাপক অর্থে আমরা লক্ষ করি ‘চৈতন্য চরিতামৃত’ কাব্যে। সেখানে বাউলের ছবি আঁকতে গিয়ে বাউলকে এভাবেই বর্ণনা করা হয়েছে,
‘বাউলকে কহিও লোক হইল আউল /বাউলকে কহিও হাটে না বিকায় চাউল /বাউলকে কহি কাযে নাহিক আউল /বাউলকে কহিও ইহা করিয়াছে বাউল’
মোটামুটিভাবে বলা যায় পঞ্চদশ শতকে বাউল শব্দটা আমাদের গোচরে আসে। বাউলরা তাদের আদিপুরুষ হিসেবে বীরভদ্রকে মানে যার জীবনকাল ছিল (১৪৭৩-১৫৪৪)। এ প্রসঙ্গে ডক্টর এম.এ. রহিম তার বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস গ্রন্থে বলেন, বাউলগণ নিত্যানন্দের পুত্র বীরভদ্রকে তাদের প্রথম গুরুরূপে অভিহিত করে এবং বিশ্বাস করে যে, তিনি মাধব বিবি নামক জনৈক মুসলমান রমণীর কাছ থেকে বাউল ধর্মমত শিক্ষা করেন’ । এসব তথ্যের উপর নির্ভর করে বলা যায় যে বাউল শব্দের আবির্ভাব পঞ্চদশ থেকে ষোড়শ শতকের মধ্যে।
বাউলমতের উদ্ভব নিয়ে যেমন চূড়ান্তভাবে কিছু বলা যায় না তেমনি বাউল শব্দটির উদ্ভব নিয়ে রয়েছে নানা মুণির নানা মত। কোন কোন গবেষকের মতে সংস্কৃত ‘ব্যাকুল’ বা ‘বাতুল’ শব্দ হতে বাউল শব্দের উৎপত্তি যার অর্থ হলো উন্মাদ, পাগল। আবার কারো কারো মত হিন্দি ‘বাউর’ শব্দ থেকে বাউল শব্দটি বাংলায় এসেছে যার অর্থ হলো পাগল। ড. এস এম লুৎফর রহমান বাউল শব্দের উদ্ভবের ইতিহাস ঘাঁটতে গিয়ে চর্যাগীতি রচনার কথা উল্লেখ করে দেখিয়েছেন যে বাউল শব্দটি একটা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে বর্তমান আকারে এসেছে। তিনি মনে করেন বাজির, বাজ্জিল, বাজুল এগুলি বাউল শব্দের আদিরূপ। তার মতে বাউল শব্দটির বিবর্তনের ক্রমপর্যায় এমন -- বাজ্রী-বাজ্জির-বাজির-বাজ্জিল-বাজিল-বাজুল-বাউল। বিবর্তনের বিভিন্ন পর্যায়ে শব্দটির রূপ ভিন্ন হলেও এর অর্থের কোন হেরফের হয়নি। এক্ষেত্রেও বাউল বলতে ভাবে উন্মাদ বা পাগলকেই বোঝানো হত। কিছু কিছু পণ্ডিতের মতে বাউল শব্দটি উৎপত্তিগতভাবে বাংলা। অর্থাৎ বাংলা থেকে বাউল শব্দের উৎপত্তি।
ড. আনোয়ারুল করীম-এর মতানুসারে বাউল শব্দের উৎসভূমি পারস্য। তিনি বলেছেন, মরুভূমিতে এখানে-সেখানে বিচরণকারী সংসারত্যাগী একশ্রেণীর সঙ্গীতাশ্রয়ী, সুফী সাধক বা ‘আল’ অথবা ‘বউল’ নামে পরিচিত ছিল। এরা অধ্যাত্মবাদী এবং এদের সাধনপদ্ধতি ছিল গুপ্ত ও যৌনাচারভিত্তিক। আমাদের আলোচ্য বাউল সম্প্রদায় পারস্যের এই ‘আল’ বা ‘বউল’ সম্পদায়ের উত্তরসূরি’ । তিনি বাউল শব্দের বাংলায় প্রথম ব্যবহার বিষয়েও ভিন্ন মত পোষণ করে বলেছেন, চর্তুদশ শতকে শাহ মুহাম্মদ সগীরের ‘ইউসুফ জোলেখা’ গ্রন্থে সর্ব প্রথম এই ধর্মীয় সাধকদের ‘বাউল’ এবং ‘বাউর’ নামে চিহ্নিত করা হয়েছে’।
বাউল শব্দের উদ্ভব ও বিকাশের ইতিহাস যা-ই হোক সর্বক্ষেত্রেই এটা একই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে এ ব্যাপারে কারো কোন দ্বিমত নেই। অর্থাৎ বাউল বলতে এমন এক ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমষ্টিকে বোঝায় সমাজের চোখে যারা নি:স্ব এবং পাগল। তাদের কোন সামাজিক মর্যাদা নেই, বিষয় সম্পত্তি বা সামাজিক প্রতিপত্তি বলতে কোন কিছুই নেই। তাদের কোন স্খায়ী বসতবাড়ি নেই। তারা একস্খান হতে অন্য স্খানে ঘুরে বেড়ায় এবং পরান্নে জীবন ধারণ করে বেঁচে থাকে। বাউল সে যে সমাজেরই হোক তার বৈশিষ্ট্য, জীবনযাপন প্রণালী, সমাজে তার সামাজিক অবস্খান একই। ড. আনোয়ারুল করীম তার ‘রবীন্দ্রনাথ ও বাংলার বাউল’ গ্রন্থে বলেন, একশ্রেণির সাধক যারা ‘ফকির’ বলে পরিচিত এবং পেশায় ভিক্ষজীবী, সাধনসঙ্গিনী নিয়ে এক অঞ্চল থেকে আর এক অঞ্চলে গান গেয়ে ফেরে, সমাজে যাদের পরিচয় অতি সাধারণ, অর্থাৎ যারা অন্ত্যজ, তাদেরকে বাউল বলা হয়ে থাকে। মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যে বাউল সম্প্রদায়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে সেখানে তারা সামাজিকভাবে নিন্দিত’।
বাউল সম্প্রদায়ের বিকাশ এবং বিস্তারের সর্বশেষ পর্যায়ের পর্যালোচনায় দেখা যায় বাংলাদেশে সংসারত্যাগী বাউলের পাশাপাশি গৃহী বাউলেরও উদ্ভব হয়েছে। তবে তাদেরও সামাজিক অবস্খান ও মর্যাদা সমাজে খুবই হীন। তাই দেখা যায় বাউল সে গৃহী বাউল হোক আর গৃহত্যাগী বাউলই হোক সমাজের তাদের অবস্খান একেবারেই নিম্নস্তরে।

একভাণ্ড ইতিহাস ও দর্শন
চৈতে-নিত্যে-অদ্বৈ এই তিন পাগলের ভাবশিস্য বাউল ধর্মের শিরোমনি সিদ্ধপুরুষ ফকির লালন শাহ (বাঙালির ধর্ম প্রচারক) কলিকালের অবতার চৈতন্য।জাত-পাতের যাঁতাকলে পিষ্ট দরিদ্র মানুষের গৌরাঙ্গ, জাতহীন। নারী পুরুষ এক দেহে ধারণ করে আবির্ভূত।সিদ্ধপুরুষ লালন বাংলা ও এর বাইরে থেকে আসা সমস্ত মতবাদ আত্তীকরণের সর্বোচ্চ বঙ্গীয় প্রকাশ।
সমগ্র সিন্দ্ধু ও গাঙ্গেয় উপত্যকা তথা ভারতবর্ষ হাজার হাজার বছর ধরে ধারণ করছে অসংখ্য মানবের জীবন।নৃতাত্বিকভাবে জন্ম হয়েছে অনেক ভাষা, সংস্কৃতি বা এর বিশেষ রূপ ধর্ম।শত শত ধর্মীয় সম্প্রদায়ের হাজারো রীতি-নীতি, আচার-অনুষ্ঠান, পূজা-অর্চনার যে সনাতনী সংস্কৃতি তাই পরবর্তিতে হিন্দু ধর্ম নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।পারসিয়ান ও আরবীয়রা মশলার ব্যবসাসূত্রে ভারতের সাথে পরিচিত হয়। এবং সিন্দ্ধু অঞ্চলের মানুষদেরকে সিন্দ্ধ্ বা ইন্দু বা হিন্দু বলে তারা অভিহিত করে ফলশ্রুতিতে তাবত দুনিয়ার মানুষের কাছে ভারতীয়রা হিন্দু ও তাদের সংস্কৃতি বা ধর্ম হিন্দু ধর্ম নাম লাভ করে বলে অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মত। বহুবিধ তণ্ত্র-মণ্ত্র- ডাক-যোগ দর্শনের প্রকাশ্য ও গোপন চর্চা অথবা কপিল, বৃহস্পতিদের বস্তুবাদী চার্বাক দর্শনের অভূতপূর্ব ভূমি ভারত। ভিন্ন ভিন্ন ধর্মীয় বা দার্শনিক সম্প্রদায়ের সহ অবস্থানের ফলে জীবনাচরনের মিলন, ভিন্নতা, ধর্মের ক্রমবিকাশ, নতুন নতুন ধর্মের আবির্ভাবে ভারত যেন এক গরম তাওয়া ।এখানে উদ্ভুত বৌদ্ধ ধর্ম পারস্য, মধ্যপ্রাচ্য আর মধ্য এশিয়া বাদ দিলে সমগ্র এশিয়ায় প্রভাব বিস্তার করে।ভারতীয় ধর্ম বিস্তারিত হয়েছে অর্থাৎ রাষ্ট্রক্ষমতা ছাড়া ধর্মের অনুপ্রবেশ ঘটেছে ফলে ব্যক্তি বা ভাষা সম্বন্ধী ধর্মসমূহ প্রবাহিত হয়েছে। অর্থাৎ রাষ্ট্রক্ষমতা ও ধর্ম অনুপ্রবেশ করেছে যুগপৎভাবে।দার্শনিক এই অবস্থানের কারণেই হয়তো ভারতীয়রা উপনিবেশ গড়ে তুলে নি কখনো কিন্তু উপনিবশিত হয়েছে বার বার।উপনিবেশকারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল মোগল আর ইংরেজরা।
সপ্তম শতকের তিরিশের দশকে মক্কা জয়ের পর আরবরা ইসলামের দর্শন হাতে নিয়ে দিগ্বিজয়ে বের হয় এবং ইসলাম ধর্ম প্রবাহিত হয়ে পশ্চিম দিকে মরোক্ক পর্যন্ত। পুরানো সকল সংস্কৃতির খোলনলচে পালটে ফেলে এমন কী মুখের ভাষা পর্যন্ত প্রতিস্থাপিত করে কায়েম করে আরব বিশ্ব।এ প্রবাহের অতিরিক্ত সংযোজন স্পেন। এরপর ফ্রান্সের গলে গিয়ে ক্ষান্ত হয় আরবদের পশ্চিমমুখী যাত্রা। পূর্ব প্রবাহ ব্যাপকভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয় পারস্যে।পারসিক সংস্কৃতির কাছে মুষড়ে পড়ে আরব সংস্কৃতি।ইরানে ইসলাম রূপান্তরিত হয়। ইরানের পার্শ্বে বাগদাদ দীর্ঘ দিন ইসলামের কেন্দ্রবিন্দু ছিল।আব্বাসীয়রা মুতাজিলাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। ইসলামে যৌক্তিকভাবে আল্লার উপস্থিতি প্রমাণে প্রভাব বিস্তারকারী মুতাজিলারা ব্যর্থ হলে প্রভাব বিস্তার করে সুফীজম।যার উর্বর ভূমি হলো পারস্য বা ইরান।
সপ্তম শতক থেকে শুরু করে ত্রয়োদশ শতকে এসে মুসলমানরা মোটামুটি পুরো ভারতবর্ষ দখল করে।কিন্তু ততোদিনে ইরানের দেয়ালে ধাক্কা খাওয়া ইসলাম অনেকটা ভিন্নরূপে যা কীনা প্রধানত ইরানের সুফীদের দ্বারা প্রচারিত হয় ভারতে।মোহাম্মদ ও খোলেফায়ে রাশেদীনের পরে যে নামগুলেো শুনা যায় তা হল‌ –-- বড় পীর আব্দুল কাদের জিলানী, খাজা বাবা মইনূদ্দীন চিশতী, বাবা ফরীদ, নিজাম উদ্দীন আউলিয়া, শাহ জালাল ইত্যাদি যারা সকলেই সুফী।পারস্য আর মধ্য এশিয়া থেকে ঝাকে ঝাকে পীর-আউলিয়ারা ভারতে ধর্ম প্রচার করে যাকে বলা যায় ইসলামের বিস্তার।
মরমি কবি ফকির লালনকে জানার চেষ্টার প্রারম্ভে পদ্মা-মেঘনা-যমুনা বিধৌত ব-দ্বীপের অনিশ্চিত কৃষিভিত্তিক দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবন এবং সনাতনী তথা হিন্দু, বৌদ্ধ এবং ইসলাম এই তিন ধর্মের মিথষ্ক্রিয়ার মানস জগৎ বিবেচনায় রাখা দরকার। হিন্দু ধর্মজাত বৈষ্ণব ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্মের সহজিয়া মতবাদ, ইসলামের সুফী মতবাদ বাংলায় যা মূলত মারেফত বা মাইজভাণ্ডারী নামে পরিচিত -- এই তিন মূল ধারার মিলনের ফলে উদ্ভূত বাংলার ধর্ম হলো বাউল ধর্ম।
বাউল একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়।বাউলদের ধর্মের তত্ত্ব ও দর্শন আছে, সাধন পদ্ধতি আছে, সাধক জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা আছে, জগৎ ও জীবন সম্পর্কে তাদের একটি দৃষ্টিভঙ্গি আছে, এ সমস্তই ব্যক্ত হয়েছে তাদের গানে।এই সম্প্রদা্য়ের সাধকগণের তত্ত্ব দর্শন ও সাধনা সংবলিত গানই বাউল গান।রূপ থেকে স্বরূপে ওঠাই বাংলার বাউলদের সাধনা। কীভাবে পুরূষ-প্রকৃতি ( জীবাত্মা-পরমাত্মা/ নারী-পুরুষ) বিভক্ত হ'ল এবং কীভাবে দুই দেশে না থেকে একত্রে রইল। পদ্ম কোথায় প্রস্ফুটিত হয়, পদ্ম পুস্পের রসে কীভাবে সাধন হয় এবং সহস্রদল হতে রজঃস্রোতের সঙ্গে রসরাজ লীলা করতে করতে অগ্রসর হয়ে তিন দিন তিন রূপ ধারণ করে শেষে সহজ মানুষ রূপে আত্মপ্রকাশ করেন।তারপর প্রকৃতি-পুরুষের শৃঙ্গার দ্বারা উর্ধ্বগত হয়ে স্বস্থানে গিয়ে যুগল হয়ে নিত্যরস লীলা আস্বাদন করেন -- বাউল সাধনার মূলভাবটি মোটামুটি এর মধ্যে ব্যক্ত। এর থেকে বোঝা যায় বা্উল সাধনা নারী-পুরুষের যৌথ সাধন পদ্ধতি।
অদ্বৈতাচার্য ও নিত্যানন্দ প্রকৃতি-পুরুষ মিলন ঘটিত ধর্মসাধনার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। নিত্যানন্দের পুত্র বীরভদ্রের সময় হতে বাউলরা সম্প্রদায় হিসেবে প্রকাশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং গুরু পরম্পরায় ব্যাপ্ত হয় সারা বাংলায়।
বাউল সাধনার তিন স্তর। প্রবর্ত -- ভগবানের নিকট দৈন্য ও গুরুর করুণা প্রার্থনা। সাধক -- দেহতত্ত্ব, মনের মানুষ, সাধনার স্বরূপের জ্ঞান লাভ। সিদ্ধ –-- সাধনার পূর্ণতার স্বরূপ। ফকির লালন ছিলেন সিদ্ধপুরুষ। বিশাখা লালনের সাধিকা।

লালন তথা বাউলদের যৌন সাধন
বাঙালির কাছে যৌনতা বিষয়টি অনেক বড় ট্যাবু।নিয়মিত যৌন কাজে লিপ্ত হবে কিন্তু মুখে বলবেনা। চিন্তা করুন লালনের জীবন কাল আঠার শতকের শেষের দিক থেকে উনিশ শতক, সমগ্র ভারত বৃটিশদের দখলে। তথাকথিত মুসলমানদের (মোঘল) হাত থেকে নাছারারা ক্ষমতা দখল করেছে, মুসলমানরা জাত যাওয়ার ভয়ে শিক্ষা-দীক্ষা বাদ দিয়ে না বুঝে কোরান মুখস্ত করে জাত রক্ষায় ব্যস্ত।হিন্দুরা জাত-পাতের ঘেরাটোপ আর ইংরেজি শব্দ মুখস্ত করে অফিসের কেরানী বা বাবুগিরির মধ্যে ঘোড়পাক খাচ্ছে। এমন সমাজে সম্পুর্ণ ভিন্ন স্কুল হল বাউলদের।
আধ্যাত্বিকতার চর্চায় মানবদেহকে ঈশ্বরের আবাস (বারামখানা) মনে করে বলে বাউলরা দেহ্তত্ত্বে ব্যাপক জ্ঞান অর্জন করে। লালনের গানের বিশাল অংশ জুড়ে দেহতত্ত্বের গান। দেহ থেকে দেহে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ঈশ্বরের ধারাবাহিকতায় সঙ্গম বা নারী-পুরুষের মিলন বাউলদের সাধনার মূল কেন্দ্রবিন্দু।
লালনের সময়কালে বা তার আগে পরে বাউলরা সবসময় নিজেদের সাধন পদ্ধতির ব্যাপারে গোপনীয়তা রক্ষা করত। যেহেতু তাদের আখড়ায় অনেক সাধিকা থাকতো এবং বাইরের মানুষকে তারা নিজেদের জীবনাচরণ বলতোনা ফলে সহজেই নানারকম কুৎসা রটনা করেতে পেরেছে নিন্দুকেরা। আবদ্ধ সমাজে যৌনতা বিষয়ে গুজব ছড়ানো খুবই সহজ। আর বিশাল এই সম্প্রদায়ের কোথাও কোথাও নাকি বিপথগামী কিছু বাউল আখড়ার পাশে পতিতালয় গড়ে নিতো। এটি মূল ধারা নয়।
এবার আসা যাক সোজা কথায় তাদের সাধনা কী? লালনের গানে প্রায়ই শোনা যায় 'সহজ মানুষ' বা 'অটল রূপ' 'মনের মানুষ' 'অচিন পাখি' বা আলেকজনা এর দ্বারা কী বুঝায়? খুব সহজ ভাবে বললে এর দ্বারা গুরু, মুর্শিদ, রাসুল, আদম, ভগবান, আল্লা, ঈশ্বর ইত্যাদিকে বুঝায়। কিন্তু লালন ঈশ্বরের সর্বোচ্চ রূপ মানবদেহের প্রানের ধারার সাথে কীভাবে মিশে থাকে সে রহস্য উৎঘাটনে সচেষ্ট ছিলেন। লালন তথা বাউলদের এ লক্ষ্যে সাধন পদ্ধতির সম্পর্কে যৎসামান্য জানা যায়।
পুরুষের বীজ আর নারীর রজঃ মিলিত হয়ে মানবের জন্ম। আর এই দু'য়ের উৎপত্তি সঙ্গমকালে। যৌন উত্তেজনার চুড়ান্ত পর্যায়ে সহজ মানুষ বা ঈশ্বরের অটলরূপ উপস্থিত হয়। বাউলরা এই স্তরে পৌঁছে স্থির থেকে সাধন করতে চায়। কাম নদীর নিন্মমুখী ধারাকে ঊর্ধমুখী করে যারা দীর্ঘক্ষণ ধরে অরগাজমে থেকে সহজ মানুষ সাধন করতে পারে তারা হলো সিদ্ধ পুরুষ।ফকির লালন একজন সিদ্ধপুরুষ।এবার দেখা যাক লালন তার গানে কী বলছেন:
আমি কী সন্ধানে যাই সেখানে
মনের মানুষ যেখানে।
আঁধার ঘরে জ্বলছে বাতি
দিবা রাতি নাই সেখানে।

যেতে পথে কাম নদীতে
পারি দিতে ত্রিবিণে (ত্রিবেণী)
কত ধনীর ধারা যাচ্ছে মারা
পইড়ে নদীর তোড় তুফানে।

রসিক যারা চতুর তারা
তারাই নদীর ধারা চিনে
উজান তরী যাচ্ছে বেয়ে
তারাই স্বরূপ সাধন জানে।

লালন বলে মইলাম জ্বলে
মইলাম আমি নিশি দিনে
আমি মনিহারা ফণির মতো
হারা হলাম পিতৃধনে।
এমন অসংখ্য গানে গানে লালন বা বাংলার অন্যান্য বাউলরা নিজেদের প্রেম, কাম, সাধনের কথা বলে গেছেন। রূপ (ঈশ্বর বা পরমাত্মা) থেকে স্বরূপে (মানব ও ঈশ্বর লীন) ওঠাই বাংলার বাউলদের সাধনা।
ছোটবেলা থেকে শুনতাম আল্লা থাকে সাত আসমানের উপরে।মনে করতাম আমরা তো এক আসমান দেখি তার উপরে বুঝি বাকীগুলো। বিজ্ঞানের হাতেখড়িতেই গ্রহ নক্ষত্র ইত্যাদি পড়ে সব কিছু কেমন যেন হয়ে গেল। হিসেব মেলে না। ছোট বেলাতেই গ্রামের লোকজনের মুখে শুনেছি 'খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়... আট কুঠুরী নয় দরজা...।' কার গান কী বলছে কিছুই বুঝতাম না। কাউকে জিজ্ঞেস করলে আমাদের দেহে আত্মার যাওয়া আসা পর্যন্ত উত্তর মিলতো।কিন্তু কোথায় আট কুঠুরী নয় দরজা বা সাত আসমান?
বাউলদের সম্পর্কে জানা খুবই কঠিন কাজ। বলা হয়ে থাকে 'শম্ভুকের মতো আত্মসংকোচনশীল, আত্মগোপনশীল জীবন যাত্রার রীতি এই বাউলদের'। বাউলরা তাদের আধ্যাত্বিকতায় ব্যবহার করেছে ভারত পারস্য ও আরবের মিথ।ভারত হল মিথের মক্কা। ফলে ধর্মের তত্ত্ব ও মিথের সহযোগিতায় তাদের সম্পর্কে কিছু ধারণা করা যেতে পারে। লালনের খুবই পরিচিত একটি গানের কথায় আসা যাক:
ধন্য ধন্য বলি তারে
বেঁধেছে এমনও ঘর শুন্যের উপর
আ মরি শুন্যের উপর পোস্তা করে
ধন্য ধন্য বলি তারে।
খুব সুন্দর বোঝা যাচ্ছে ঈশ্বর তার বারামখানা এই মানব দেহ শক্ত করে তৈরী করেছে। কিন্তু কোথায়? শুন্যের উপর। শুন্য কী? বিজ্ঞানে এর কোন সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। যে কোন কিছুকে আমরা আপেক্ষিকভাবে শুন্য ধরতে পারি। শুন্যের জন্মভূমি ভারত। বুদ্ধের মূল দর্শনই হলো শুন্যবাদ। নাগার্জুন শুন্য সম্পর্কে বলেছেন " অস্তি-নাস্তি-তদুভয়ানুভয়চতুষ্কোটি বিনির্মুক্তং শুন্যরূপম"। সহজ ভাবে বললে দাঁড়ায়:
আছে যে তা নয়
নাই যে তাও নয়
আছে নাই উভয়ই তাও নয়
আছে নাই উভয়ই যে নয় তাও নয়।
এই চার মুক্ত কোন কিছু হলো শুন্য। এরই উপর ঈশ্বর পোস্তা করে ঘর বেঁধেছে। তাই ফকির লালন বলছেন ধন্য ধন্য বলি তারে। পরের স্তবক:
ঘরে মাত্র একটি খুঁটি
খুঁটির গোড়ায় নাইকো মাটি
কিসে ঘর রবে খাড়ি
ঝড়ি-তুফান এলে পড়ে।
ঘরের একটি খুটি বলতে কী বোঝায়? প্রাণিবিজ্ঞানে পড়েছি সমস্ত প্রানিজগতকে মোটা দাগে দুভাগে ভাগ করা যায় মেরুদণ্ডী, অমেরুদণ্ডী।এই মেরুদণ্ড প্রাণির বিবর্তনের খুবই বড় একটি ধাপ। মেরুদণ্ডের কশেরুকার ভিতর দিয়ে তিনটি স্নায়ু পেচিয়ে পেচিয়ে (কুণ্ডলী স্ত্রীবাচক কুণ্ডলিনী) মাথায় গিয়ে মিলেছে। যা ভারতীয় তান্ত্রিকদের কাছে অনেক সময় ত্রিবেণী নামেও পরিচিত। সুষুন্মা, ইড়া,পিঙ্গলা। সুষুন্মা অক্ষের মতো যাকে পেচিয়ে বাকি দুটি। ইড়া বাম শুক্রাশয় থেকে ডান নাসারন্ধ্র পর্যন্ত। শ্বেত বর্ণের শান্ত সৌম্য ও চাঁদের সাথে তুলনীয়। পিঙ্গলা (লাল) ডান শুক্রাশয় থেকে বাম নাসারন্ধ্র পর্যন্ত বর্ধিত। ভয়াবহ শক্তিশালী ও সূর্যের সাথে তুলনীয়।
ত্রিবেণীর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত স্তরে স্তরে বিভিন্ন কুঠুরী বা পদ্ম ফুলের বর্ণনা করা হয়েছে। পদ্ম গাঙ্গেয় অঞ্চলের খুব সাধারণ ফুল এবং প্রচুর মিথ এর সাথে যুক্ত। ব্রহ্মা স্বপ্ন দেখেন। তার নাভিমূল থেকে পদ্ম ফুল ফুটে স্বরস্বতী পদ্মফুলের উপর আবির্ভূত হন। প্রাণির দেহে ফুলের সনাক্তকরণ যাদের গ্রামদেশে বাড়ী তারা সহজেই করতে পারবেন। গরু ছাগলের বাছুর হওয়ার পর লোকজন পাহাড়া থাকে যেন ফুল না খেয়ে ফেলে। গরু তৃণভোজী কিন্তু এই আমিষ জাতীয় খাদ্য সরিয়ে না ফেললে সে অবশ্যই খায়। লালন তার গানে সরাসরি ফুল শব্দটিও ব্যবহার করেছেন।
কমল কোঠা কারে বলি
কোন মোকাম তার কোথা গলি
সেইখানে পড়ে ফুলি
মধু খায় সে অলি জনা।
একমাত্র খুঁটি সুষুন্মার শুরু থেকে শেষ অবধি কুণ্ডলিনীর (ত্রিবেণী) বিভিন্ন স্তরে সাধনার মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন চৈতন্য জাগ্রত করে শেষে ঈশ্বরের সাথে লীন হওয়াই দুনিয়ার সমস্ত সাধকের উদ্দেশ্য। সাধকের রূপান্তরের এই স্তর বা চক্র বা ফুল বা কুঠুরী বা আসমান উপমায় কখনও সাত কখনও আট বা নয় ধরনের স্তরের কথা বলা হয়ে থাকে। লালন ৭, ৮, ৯, সবই ব্যবহার করেছেন:
দেশ দেশান্তর দৌঁড়ে কেন মরছ রে হাপিয়ে
আদি মক্কা এই মানব দেহে
দেখনারে মন ধ্যেয়ে।
মানুষ মক্কা কুদরতি কাজ
উঠেছে আজগবি আওয়াজ সাত তলা ভেদিয়ে।
আছে সিং দরজায় তারি একজন নিদ্রা ত্যাগি হয়ে
দেখনারে মন ধ্যেয়ে।
অথবা যে গানটি ধরে আলোচনা করছি তার পরের অন্তরায়:
মূলাধার কুঠুরী নয়টা
তার উপরে চিলে কোঠা
তাহে এক পাগলা ব্যটা
বসে একা একেশ্বরে।
ভারতীয় মিথে সাধনার এই স্তরসমূহকে মুলতঃ সাত চক্রেই আলোচনা করা হয়েছে। কোথাও বা উপবিভাগ করেছে আট বা নয় চক্রে। সুষুন্মার ভিত্তি বা মূলকে বলা হয় মূলাধার চক্র।



মূলাধারের অবস্থান যৌনাঙ্গ ও পায়ু পথের মাঝে। চিত্রে বৃত্তের ভিতর চতুর্ভূজের দ্বারা বুঝানো হয়েছে পার্থিব বিষয় আশয়। হাতির পিঠের উপর নিন্মগামী ত্রিভূজ দ্বারা যোনী তথা বিশ্বমাতা, এর মাঝখানে পুরুষ প্রতীক শিবলিঙ্গ যাকে সাড়ে তিন প্যাচে জড়িয়ে সর্প দেবী কুণ্ডলিনী। এবার আসা যাক হাতির কথায়। হাতি ভারতে একটি মিথিক চরিত্র। মিথ অনুসারে একদা হাতি মেঘের মতো রূপ পরিবর্তন করতে পারত, উড়তে পারত।একদিন সে উড়ে গিয়ে বসল এক ডালে। ঐ গাছের নীচে এক সাধু তার শিষ্যদের পড়াচ্ছিলেন। এমন সময় ডাল ভেঙ্গে কয়েকজন শিষ্য মারা গেল আর হাতি সুন্দর উড়ে গিয়ে বসল অন্য ডালে। সাধু সাথে সাথে রেগে গিয়ে সমস্ত হাতি জাতিকে অভিশাপ দিলেন। হাতি তার রূপ পরিবর্তন ও উড়ার ক্ষমতা হারাল। এর পর থেকে হাতি পৃথিবীতে হেঁটে চলা একখণ্ড অভিশপ্ত মেঘ। হাতির এই সিম্বল থেকে বোঝা যায় শর্তমুক্ত হলে সহজেই পৌঁছানো যায় পরবর্তি কুঠুরীতে। মূলাধার স্তর সাধকদের কাছে খুবই স্থুল পর্যায়। এর দ্বারা পরিচালিত মানুষজন সক্রিয় নয়।
পরের চক্র স্বধিস্থান।


এটি কুণ্ডলিনীর বিশেষ আবাস।শরীরের যৌনাঙ্গ বরাবর এর অবস্থান। এই চক্রে কুণ্ডলিনী জাগ্রত হলে জীবনের প্রধান লক্ষ্য হয় সেক্স। চিত্রে জলের অসুর মকর এর প্রধান উপাদান। ফ্রয়েড জীবনের এই চক্রের আলোচনা করেছেন ভালোভাবে। ভারতীয় সাধকেরা এই কুঠুরী উত্তরণের ব্যাপারে দ্বিধাবিভক্ত। একটি ধারা কামকে হ্যা বলেছে অন্যটি না। বাউলরা প্রথমটি।
৩য় তলা হলো মনিপুর।


নাভির লেভেলে এর অবস্থান। মানুষের ভোগবাদীতা,দখল মনোবৃত্তি ইত্যাদির প্রকাশ এখানে। বর্তমান পশ্চিমা জগতের জীবনে এই চক্রের প্রাধান্য।
উল্লেখিত চক্রসমূহ সাদামাঠা। যারা এর মধ্যে জীবন যাপন করে তাদের জাগতিক চাওয়া পাওয়াই নির্ধারণ করে জীবনের সুখ-দুঃখ।এরা নিষ্ক্রিয় বা প্রতিক্রিয়াশীল। গুরু ঠাকুর বলেছেন 'পনের আনা মানুষ আসে খায় সন্তান উৎপাদন করে মারা যায়।'
পরবর্তি চক্র সমূহ উঁচু স্তরের।অনেকটা শরিয়ত-মারিফতের পার্থক্যের মতো। দান্তের মতে নতুন জীবনের শুরু।
চক্র চার অনাহত।


হৃদপিণ্ডের বরাবর এই পদ্ম। অনাহত মানেই আঘাত হীন। আমাদের সাধারণ অভিজ্ঞতা হল আঘাত ছাড়া শব্দ অসম্ভব। কিন্তু বিজ্ঞানের Big Bang আল্লার কুন বা ভারতের ওঁম এই সব শব্দ আমাদের চেনা বস্তুর আগে। সাধকেরা চিরন্তন সেই আঘাতহীন শব্দ শোনার সাধনা করে। রাবেয়া বসরী বলেছেন নৈশব্দই সেরা ইবাদত। তিনি নদীর পারে বসে এই ইবাদতই করতেন।অনাহত শব্দ শোনার পরে পরবর্তি কুঠুরীতে গমন।
চক্র পাঁচ বিশুদ্ধ ।


এর অবস্থান গলায়। কুণ্ডলিনী যখন এই তলে পৌঁছা্য় তখন সাধকের সাথে ঈশ্বরের কথাপকথোন হয়। চিত্রে নিন্মমুখী ত্রিভুজের ভিতর পূর্ণ বৃত্ত হলো পূর্ণ চন্দ্র। লালন তার বহু গানে বলেছেন এই চাঁদের কথা। এখানকার দেবতা হলো অর্ধনারিশ্বর শিব। সাধকেরা দেখতে পান পারে যাওয়ার তরী।
লালন অসংখ্য গান লিখেছে পারাপার তত্ত্বের। চির মুক্তি লাভের এই যাত্রা খুবই বিপদ সংকুল। ঠিক সেই ফুলসেরাতের পুলের বর্ণনা। ওপারে আছে চির যৌবন অনন্ত ভূমি এক কথায় স্বর্গ।
সিদ্ধ পুরুষ হতে আর দু চক্র বাকী।
অহনা ষষ্ঠ চক্র।


দুই ভ্রুর মাঝে উপরে মেয়েরা যেখানে টিপ পড়ে সেখানে এই চক্রের অবস্থান। সুফীদের ফানা ফিল্লা্হ বা ঈশ্বরের সাক্ষাৎ বা দিদার। রামকৃষ্ণের বর্ণনায় এ স্তরে কিছুটা আমি বা ইগো থেকে যায়। তিনি বলেন এ যেন ঠিক কাঁচে ঘেরা বাতি। সবই দেখা যায় তবু থেকে যায় বাঁধা। মোহাম্মদের মিরাজে আল্লা ও তার মাঝে একটি পর্দা ছিল।
সহস্র সপ্তম চক্র।



এই স্তর হল বাকা বিল্লাহ। ইউসুফ হাল্লাজের 'আয়নাল হক' বা আমিই সত্য। রামকৃষ্ণের বর্ণনায় কোন ধরণের বাঁধার অস্তিত্ত্ব নেই। শুধুই আলোর ঝলকানী। লালনের মতে দিবা রাতি নাই সেখানে। লালনের গানে দেখুন সহস্রের কথা:
যে রূপে সাঁই বিরাজ করে দেহ ভুবনে
গুরুর দয়া যারে হয় সেই জানে।
শহরে সহস্র পারা তিনটি পদ্মার এক মহেরা
আলেক ছোঁয়ার পবন খোড়া ফিরছে সেখানে।
গুরুর দয়া যারে হয় সেই জানে।
সহস্রের উপরে চিলে কোঠায় পাগলা ব্যাটা থাকেন।
এর পর লালন বলেন:
উপর নীচে সারি সারি
সাড়ে নয় দরজা তারি
লালন কয় যেতে পারি
কোন দরজা খুলে ঘরে।
সাড়ে নয় দরজা বলতে দুই চোখ, দুই কান, দুই নাক, মুখ, যৌনাঙ্গ, পায়ু। যৌনাঙ্গে নারীর দুই দরজা পুরুষের একটা গড়ে সাড়ে নয়।
ধন্য ধন্য বলি তারে
বেঁধেছে এমনও ঘর শুন্যের উপর
আ মরি শুন্যের উপর পোস্তা করে
ধন্য ধন্য বলি তারে।

বাউল ও সুফিবাদের আলোয় লালন-দর্শন
লালন একজন ফকির-দরবেশ, একজন সুফি-সন্ত, লালন বৈষ্ণব, তান্ত্রিক কিম্বা তত্বজ্ঞ কবি, লালন হিন্দু না মুসলমান – তিনি যে প্রকৃতপক্ষে কে এবং কী, এ ব্যাপারে দ্বিধা দ্বন্দের শেষ নেই।
লালন তো বাউল অবশ্যই ছিলেন। বাউল-শ্রেষ্ঠ ছিলেন বললেও অত্যুক্তি হবে না। বাউল সঙ্গীত বাংলার লোকসংস্কৃতির এবং লোকগাঁথার এক বিশেষ অঙ্গ। বাংলার জলবায়ুতেই তার পরিপুষ্টি। অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত তথাকথিত অসংস্কৃত একশ্রেণীর গ্রাম্য লোকদের মুখে মুখে রচিত হত বাউল গান। ধর্মীয় বা লোকাচারের মোড়কে গ্রাম্যমানুষকে নীতি কথা শেখানোর জন্য বাউলশ্রেণীর উদ্ভব হয় নি, যেমনটি দেখা যায় অন্যান্য কিছু লোকসঙ্গীতের ক্ষেত্রে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে গম্ভীরা, ভাদু, টুসু, মুর্শিদী ইত্যাদি। বাউল গান যদিও গ্রামীণ কথ্য ভাষায় গীত হত, কিন্তু এর পরতে পরতে যে গভীর তত্ত্বজ্ঞান লুকিয়ে আছে, তা বুঝতে বেশী সময় লাগে না। লালন ফকিরের বাউল গান এর সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ। ‘তত্ত্বকথা শ্রবণ, তত্ত্বসার গ্রহণ এবং তত্ত্ববিষয়ক চিন্তাই ছিল তাঁর মূল লক্ষ্য। দীর্ঘ আধ্যাত্ম সাধনায় তাঁর হৃদয়ে যে জ্ঞান সঞ্চিত হয়েছিল, তা প্রকাশ করার জন্য তিনি সুর ও ছন্দ অবলম্বন করেন। একারণেই তাঁকে তাত্ত্বিক কবি বলা হয়েছে’। এক কথায় বলা চলে লালন ছিলেন ‘মিষ্টিক’, যে অর্থে বৈষ্ণববাদ সুফিবাদ ‘মিষ্টিক’, সেই একই অর্থে লালনের ধ্যান-ধারণা ‘মিষ্টিক’। ‘মিষ্টিসিজম’ অল্পবিস্তর সব বাউলগানেই প্রচ্ছন্ন, কিন্তু লালন-গীতিতে তা এক অন্যরূপ, ভিন্নতর মাত্রায় জাজ্বল্যমান।
বাউল সঙ্গীত ও তার ইতিহাসকে বাদ দিয়ে লালনের তত্ত্বজ্ঞান ও দার্শনিকতার সঠিক মূল্যায়ন হতে পারে না। লালনের জীবন ও কর্মের ধারাটিকে সঠিক ধরতে গেলে বাউল সঙ্গীতের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট একবার দেখে নিতে হবে। কেউ-ই সঠিক জানেন না বাউল সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা কে বা কারা। এটুকু বলা যায় বাউল ফকির বা গুরুরা কোন এক বিশেষ ধর্মের অনুগামী ছিলেন না। মুসলিম এবং হিন্দু দুই সম্প্রদায়ের লোকই বাউল সম্প্রদায়ভু্ক্ত ছিলেন আগে এবং এখনও। কয়েকজন বিখ্যাত ফকির গুরুর নাম এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যেতে পারে যেমন হরিগুরু, বনচারী, অখিল চাঁদ কিম্বা পাগল নাথ, সাহেব ধনি প্রমুখ। একটি ব্যাপার বিশেষ উল্লেখ্য এই ব্যাপারে যে এই সব ফকির বা গুরুরা সবাই নদীয়া জেলার অধিবাসী ছিলেন এবং প্রায় সবাই ষোড়শ শতাব্দীর পরের দিককার। অনেক গবেষক এই কারণেই মনে করেন বাউল সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়েছিল এই নদীয়াতেই। নদীয়া অবিভক্ত বাংলার সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ছিল সেই সুপ্রাচীন কাল থেকে শুরু করে ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষভাগে বখতিয়ার খিলজির হাত ধরে বাংলায় মুসলিম শাসন চালু হয়। সুফি প্রভাব তখন বাংলার সর্বত্র। সুফিচিন্তা ও ভাববাদের মধ্যে গ্রামবাংলার অত্যাচারিত ও দিকভ্রান্ত মানুষ দিশা খুঁজে পেতেন। এমনকি অনেক গবেষক মনে করেন চৈতন্যদেবের ভাবধারাতেও সুফিপ্রভাব ছিল। ‘চৈতন্যমঙ্গল’-এর লেখক জয়ানন্দ বলেছেন সেই সময় অনেক ব্রাক্ষণ জালাল উদ্দীন রুমির ‘মাথানবী’ পড়তেন। কৃষ্ণদাস কবিরাজের ‘চৈতন্য-চরিতামৃত’ গ্রন্থে চৈতন্যর সঙ্গে পীর-দরবেশের সাক্ষাৎকারের কথা আছে। চৈতন্য ভাগবত-এ আছে মহাপ্রভুর যখন ভাবদশার উদয় হত তখন –‘মুঞি সেই মুঞি -- সেই কহি কহি হাসে’। যা কিনা সুফি চিন্তা ‘আনা’ল হক’-এর সমার্থক (ভাবার্থ: I am the real)। প্রখ্যাত সমালোচক প্রমথ চৌধুরীর কথায় চৈতন্য মহাপ্রভুর হাত ধরে ব্যপ্ত ভারতবর্ষের মধ্যযুগের এই নব বৈষ্ণব ধর্ম সনাতন হিন্দু ধর্মের একটি নবশাখা মাত্র। তবে এই নবত্বের কারণ মুসলমান ধর্মের প্রভাব। মুসলমান ধর্ম যে প্রধানত ঐকান্তিক ভক্তির ধর্ম, একথা কে না জানে? ভারতবর্ষের মধ্যযুগের বৈষ্ণবধর্ম যে মুসলমান ধর্মের এতটা গা-ঘেঁষা, তার কারণ পাঁচশ বছর ধরে হিন্দু ও মুসলমান ধর্ম পাশাপাশি বাস করে আসছিল’। নববৈষ্ণব ধর্মের মধ্যে যে পৌত্তলিকতা বর্জিত একশ্বরবাদী চিন্তার ধারণা আছে সুফি চিন্তাধারার সঙ্গে তার অনেকটাই মিল। ষোড়শ শতাব্দীতে গিয়ে যখন বাউল সাধকদের উল্লেখ দেখা যায় নদীয়ার আশেপাশে, তাতে স্বভাবতই মনে করা যেতে পারে এই সম্প্রদায়ের মধ্যে বৈষ্ণব চিন্তা ও সুফি ভাবধারার ছাপ আছে। বাউলতত্ত্বে বারবার বলা হয় নিজেকে জানার কথা, খানিকটা যেন ঊপনিষদের ‘আত্মানং বিদ্ধি’ বা গ্রীক দার্শনিক প্লেটোর চিন্তার প্রতিফলন – ‘know thyself। বৈষ্ণবরা কৃষ-প্রেমের মধ্য দিয়ে যেখানে পৌঁছোতে চায়, সুফিতত্ত্ব যে ‘এক এবং অদ্বিতীয়’-কে জানতে চায়, তত্ত্বজ্ঞ বাউল তার কোন নামকরণ বা চিহ্নিতকরণ করতে পারেন নি। তাই তাকে ‘মনের মানুষ’ বা কখনো শুধু ‘মন’ বা কখনো আবার ‘অচিন পাখি’ ডেকেছেন। এই অধরা অজানাকে জানার রহস্যভেদ করার আকুলতাই বাউল গানের ছত্রে ছত্রে ধ্বনিত হয়।
আলেখ দুনিয়ার বীজে আলেখে সাঁই বিরাজে
আলেখে খবর নিছে, আলেখে কয় কথা।
.......
আলেখ মানুষের রসে সনাতন সদা ভাসে
বাউলে তোর লাগল দিশে যেতে নারবি সেথা’।
এক্ষেত্রে আলেখ সাঁই শব্দটি হয়তো অলক্ষ্য স্বামীর অপভ্রংশ। সুফিসন্তদের মতো বাউলরা সেই অজানাকে জানা ও চেনার দুর্জ্ঞেয় রহস্য ভেদ করতে চান প্রেমের মাধ্যমে যা মনের গভীরে তুষের আগুনের মত সর্বদাই জ্বলছে। এই প্রেমানলে সুফি দরবেশ যেমন পাগল, বাউলও হন বাতুল বা উন্মাদ। বাউলের এই উন্মাদ অবস্থার পরিচয় পাওয়া যায় তার গানে:
‘আসার সাঁই দরদী আর কতদিন রব?
দেশ বিদেশে ঘুরিয়া বেড়াই, আর বা কোথা পাব?
যার জন্যে হয়েছি পাগল, তারে কোথায় পাব?
মনের আগুন দ্বিগুণ জ্বলে তারে কি দিয়ে নিবাব?’
এই প্রেমোন্মাদনার মাধ্যমে বাউল সব সময় সেই অজ্ঞাত রহস্যময়কে জানার চেষ্টা করে চলেন। স্বভাবতই পারেন না। তাই সুফি কিম্বা বেদান্তজ্ঞানীর মত তিনি দৃষ্টি ফেরান নিজের ভেতর। তিনি বলতে পারেন সেই কারণে – ‘যা নেই ভান্ডে, তা নেই ব্রম্মান্ডে’। এখানে ভান্ড অর্থ এই শরীর। এই ভাবনার সঙ্গে সুফি ‘কুরবাত’-এর ধারণা সমাপতিত হয়ে যায়। বাউল ধ্যানধারণার মধ্যে এভাবে একদিকে যেমন প্রচ্ছন্নভাবে বৈষ্ণব প্রেমতত্ত্ব মিশে আছে তেমনি আছে সুফি আত্মোপলদ্ধির ধারণা। বাউল মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন এই অজ্ঞেয়-অধরা আর কোথাও নয়, মন্দিরে নয়, মসজিদে নয়, গীর্জায় নয় আছেন এই শরীরের খোলেই। যদিও তিনি রহস্যময় কিন্তু সঠিক ভাবে ডাকলে তাঁর সাড়া অবশ্যই পাওয়া যায়।
মানুষ হাওয়ায় চলে, হাওয়ায় ফিরে, হাওয়ার সনে রয়।
দেহের মাঝে আছে রে সোনার মানুষ ডাকলে কথা কয়’।
এই রহস্যভেদের জন্য বাউল দ্বারস্থ হন গুরু বা মুর্শিদের কাছে ঠিক যেমন সুফিভক্ত যান পীরের দরজায়। গৎ বাঁধা ধর্মাচরণ বাউলের নয়। তীর্থভ্রমণ, পূজাপাঠ, এবং অনুষ্ঠান-আচার যেমন বাউলের কাছে পরিত্যাজ্য সুফির কাছেও তেমনি।
আমার নাই মন্দির কি মসজিদ
পূজা কি বকরিদ
তিলে তিলে মোর মক্কা কাশী
পলে পলে সুদিক’।
সুফিসাধক এবং হিন্দু তত্ত্বজ্ঞানীর মত বাউলও বিশ্বাস করেন সংসার মায়াময়। এই পার্থিব জীবন মরীচিকা। তাই তো বাউল নিজের চারপাশে গড়ে তোলে পার্থিব জীবন বিমুখ মনোভাব। সুফি অনুগামী বা হিন্দু তাত্ত্বিকের থেকে বাউল এখানে স্বতন্ত্র। সুফি চিন্তার সঙ্গে অনেক সমাপতন সত্বেও বাউলকে দেখা যায় এক নিজস্ব রীতিনিয়ম তৈরী করে নিতে। তিনি কোন জাতপাতের উপর নির্ভরশীল নন। তাঁর নিজস্ব পথ স্বকীয় চিন্তার আলোকে উদ্ভাসিত হয়। তুলনামূলকভাবে সুফিবাদ দৃশ্যতই এবং পরিপূর্ণভাবে ইসলামনির্ভর। সুফি ভাববাদ যেহেতু ‘আল্লা’ নির্ভর, তাই তাঁদের ‘পরম লক্ষ্য’-র ব্যাপারে ধ্যানধারণা অনেক স্বচ্ছ। এ ব্যাপারে বাউলদর্শন অনেকটাই অনিশ্চিয়তার অন্ধকারে নিমজ্জিত। এত সব সমাপতন থেকে, সে কাকতালীয় হোক আর ইচ্ছাকৃত, ধারণা করা যেতে পারে বাউলতত্ব বৈষ্ণববাদী প্রেম ও সুফি একেশ্বরবাদী আত্ম-অনুসন্ধান ও আত্মোপলব্ধির ভিতের উপর গড়া।
বাউল ভাববাদের এই পরিপ্রেক্ষিতটির কথা মাথায় রাখলে বাউল-শ্রেষ্ঠ লালন সাঁইয়ের জীবনাদর্শে আলোকপাত অনেক সহজ হয়ে আসে। অনেকেই জানেন লালনের জন্মবৃত্তান্ত প্রায় সবটাই ধোঁয়াশা। কোথায় তাঁর জন্ম হয়েছিল কেউ জানে না। লালন নিজে এ ব্যাপারে কাউকে কিছু বলেন নি। মলম এবং মতিজান নামক এক কৃষক দম্পতি গুটিবসন্তে আক্রান্ত মূমুর্ষূ এক বালককে উদ্ধার করেছিলেন কালীগঙ্গা নদীর চর থেকে। এই নিঃসন্তান দম্পতিই সন্তান স্নেহে লালনকে মানুষ করেছিলেন। সেসময় লালন এক কিশোর। কিন্তু তাঁর পিতামাতা, গ্রাম-দেশ সম্বন্ধে কাউকে কিছু জানাননি তিনি। সেই বয়স থেকেই প্রথাগত ধর্মসম্প্রদায় এবং জাতপাত ভিত্তিক ধারণার বাইরে বেরিয়ে এক অসাম্প্রদায়িক বিশ্বাসের পথে এগোচ্ছিলেন তিনি। পরবর্তী জীবনে এই মনোভাবই লালনের দর্শন চিন্তার কেন্দ্রবিন্দুতে স্থান করে নিয়েছিল। তাই তিনি পরিণত বয়সে বলতে পেরেছিলেন :
‘লালন বলে জাতের কি রূপ দেখলাম না এই নজরে।
কেউ মালা কেউ তসবী গলে তাইতোরে জাত ভিন্ন বলে
যাওয়া কিন্বা আসার বেলায় জাতের চিহ্ন রয় কারে’।
আজকালকার সাম্প্রদায়িক হানাহানি ও বিদ্বেষের মুখে লালনের এই দর্শন যে ভীষণই বৈপ্লবিক ও প্রাসঙ্গিক সে সন্দেহ নেই। কুষ্টিয়ার ছেউরিয়ায় যেখানে লালনের আখড়া, তা একসময় বৃহত্তর নদীয়ার অংশ ছিল। আগেই বলা হয়েছে যে সুপ্রাচীন নদীয়ায় বৈষ্ণব ও সুফিবাদের যথেষ্ট প্রভাব ছিল যার ছাপ আমরা বাউল সঙ্গীতে লক্ষ্য করি। লালন এই জায়গার লোক হওয়ার সুবাদে তাঁর চিন্তাধারাতেও বৈষ্ণবীয় ভক্তিবাদ এবং সুফিবাদের প্রভাব থেকে থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। সুফিসন্তদের মতো তিনিও ভাবতেন আপনাকে জানার মধ্যেই আছে জগতের রহস্যভেদের চাবিকাঠি। সেই ‘অপার-অজানা’ আছেন আমাদের এই দেহ-দেউলেই। এই শরীরের খোলেই। দেহ এক মাধ্যম ও বাহক - তার বেশী কিছু নয়। দেহ নষ্ট হবে কিন্তু চলতেই থাকবে দেহ থেকে দেহান্তরে ‘অচিন পাখি’র আনাগোনা। লালনের এই ধ্যানধারণা, বিখ্যাত দার্শনিক ও গণিতজ্ঞ দেকার্তে-র দার্শনিক চিন্তার সমান্তরাল। দেকার্তে বলেছিলেন – ‘cogito ergo sum বা সাদা কথায় ‘I think, therefore I exist। চিন্তা ভাবনার ধারক ও বাহক হিসেবে অস্তিত্ব আছে এই শরীরের। লালনও বললেন -
‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়’।
এই খাঁচা (দেহ) যেদিন খসে পড়বে- ‘লালন কয় খাঁচা খুলে সে পাখি কোনখানে পালায়’। মোদ্দা কথা দেহ বিনষ্ট হবে কিন্তু আত্মা ও মন রয়ে যাবে। গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন ‘বাসাংসি জীর্নানি যথা বিহায়’ ইত্যাদি। বাসা জীর্ণ হলে পাখি যেমন বাসা বদল করে, শরীররূপী এই খাঁচা খসে পড়লে পাখি মুক্ত হয়ে বাসা বদল করে। এই আধ্যাত্ম চিন্তা এতটাই শাশ্বত যে ধর্ম ও জাতের জায়গা এখানে কোথায়? সেই কারণেই লালনের চিন্তাভাবনার দর্শনকে কোন প্রথাগত ধর্মের গন্ডিতে বাঁধা মুশকিল।
মন্দির মসজিদে লালনের বড় অনীহা ছিল। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মাচরণের বিরুদ্ধতা বাউলরা সব সময়েই করেছেন একথা আগেই বলেছি। কোন তীর্থস্থানে যেতে হবে না। এই দেহই সব মসজিদের শেষ মসজিদ, সব মন্দিরের শেষ মন্দির। লালন তাই বলেন:
আছে আদি মক্কা এই মানব দেহে
দেখল নারে মন ভেয়ে
দেশ দেশান্তরে দৌঁড়ে এবার
মরিস কেন হাঁপিয়ে’।
তিনি বলেন:
দশ দুয়ারী মানুষ মক্কা
গুরুপদে ডুবে দেখ গা
ধাক্কা সামলায়ে
ফকির লালন বলে সে যে গুপ্ত মক্কা
আদি ইমাম সেই মিঞে’।
বাউলের কাছে মন্দির এই দেহ, মসজিদ এই দেহ, মক্কা-মদিনা-কাশী-বৃন্দাবন এই দেহ। সুফি দর্শনের সঙ্গে লালন বা বাউল দর্শনের বৈপরিত্য এখানেই। মানব-শরীরের মাধ্যমে সেই ‘মিঞে’–কে ধরার প্রয়াস কেবল বাউলই করেন।
এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভাল যে বাউলরা তথাকথিত বিদ্বৎসমাজে ও সমাজের উঁচুস্তরে প্রায় ব্রাত্যই ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ এই সম্প্রদায়ের প্রতি মানুষের আগ্রহ নতুন করে জাগিয়ে তুললেন। রবীন্দ্রনাথ এবং লালন প্রায় একই সময় পৃথিবীতে ছিলেন। তিনি লালনের প্রভাবে এতটাই প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন যে তাঁর কাব্য চিন্তায় বাউ-দর্শন এ বিশেষ জায়গা করে নিয়েছিল। যাই হোক লালনের ভাবনার প্রতিফলন দেখা গেল তাঁর গানে :
আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে/দেখতে আমি পাইনি তোমায় দেখতে আমি পাইনি’। কিম্বা তিনি যখন বলেন ‘আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে তাই হেরি তায় সকলখানে’, তখন লালন-রবীন্দ্রনাথ-দেকার্তে-প্লেটো—সুফি-সন্ত সব একাকার হয়ে যায়। মনুষ্যত্বের আদর্শ ও চিন্তাই এই চিন্তার মূলভিত্তি। নিজেকে জানা ও চেনার মধ্য দিয়েই জানা যাবে ‘তাঁকে’ – আর কোন প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মাচরণ ও তদজনিত ভেদবুদ্ধির প্রচার ও বিচারের দরকার নেই। এ কথাই লালন তাঁর সমগ্র জীবন ও চিন্তায় প্রতিফলন করে গেছেন।
লালনের বাউল-ভাবনায় বাংলার মধ্যযুগীয় নববৈষ্ণব চিন্তা ও সুফি ভাববাদের গভীর প্রভাব আছে। সুফি ভাবধারার সঙ্গে অনেক সাদৃশ্য থাকায় লালনকে অনেকে সুফি-সাধকও বলেছেন। সাম্প্রতিক গবেষকরা এ ব্যাপারে নির্দ্বিধায় বলেছেন লালন সুফি ছিলেন না। কেন? সুফি-দর্শন প্রথমত এবং প্রধানত ইসলাম ধর্মের মধ্যেই বেড়ে ওঠা এক অধ্যাত্ম চিন্তা। সুফিরা ‘আল্লা’ ছাড়া আর কারো অস্তিত্ব স্বীকার করেন না। আল্লার প্রতি অপার ভক্তির মাধ্যমে সুফি সাধক সেই ‘পরম’-কে পেতে চান। এখানেই লালনের চিন্তাধারা বিপরীত মেরুতে অবস্থিত। লালন এবং বাউল-দর্শন মানবদেহের অভ্যন্তরে যে ‘মনপাখি’, মনের মানুষ’ আছে তাঁকে জানার চেষ্টা ছাড়া আর কিছুতে বিশ্বাস করেন না। সেই চিন্তায় আল্লা নেই, কৃষ্ণ নেই। মানুষ তার কাছে আল্লা। তাই তিনি বলতে পারেন :
আল্লা কে বোঝে তোমার অপার লীলে
তুমি আপনি আল্লা ডাকো আল্লা বলে’।
লালন সেই অর্থে সুফিদের মত ধর্মযাজক ছিলেন না। ফারহাদ মাজহার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন লালনকে সুফি বলে ভুল করা হয় এই কারণে যে তাঁর গানে প্রচুর আরবী শব্দ ও ইসলামিক ভাবনা চিন্তার প্রতিফলন আছে। কিন্তু অত্যন্ত সতর্ক ভাবেই তিনি সুফিদের থেকে নিজেকে সরিয়ে এক স্বতন্ত্র দর্শনের উদ্ভাবন করেছিলেন যা প্রথাগত ইসলাম থেকে অনেক দূরে। আল্লাকে বা ‘অচিন পাখি’-কে দেখো এই মানবদেহেই – অন্য কোথাও নয়, অন্য কোন তীর্থে নয়।
লালনের ভাবনা ও দর্শন সুফি দর্শন এবং বৈষ্ণবীয় ভাব রসের জারণে জারিত এক স্বতন্ত্র চিন্তা যা গ্রাম বাংলার লোকসংস্কৃতির আধারে পরিপুষ্ট হয়েছিল। তিনি বৈষ্ণব নন, সুফি নন, হিন্দু নন, মুসলিম নন। জাতের ফাৎনা তিনি ডুবিয়েছেন সাধ-বাজারে। তিনি ব্যাকুল স্বরে বলতে পারেন:
বিবিদের নাই মুসলমানী
পৈতে নেই যার সেও বামনী।
বোঝ রে ভাই দিব্যজ্ঞানী
লালন তেমনি জাত একখানা’।

মোহা ম্মদ রফিক উজ্জামা ন আর ফকির মোহাম্মাদ আলী-র কথায় ...
লালন সাঁই, ফকির লালন জাত-পাতের বহু উর্ধে এক তত্বজ্ঞ দিব্যজ্ঞানী। একজন শাহানশাহ্।
তবে আমি সাঁইজিকে কেন শাহানশাহ্ বলে আখ্যায়িত করেছি, সে সম্পর্কে কিছু বলার প্রয়োজন আছে। সুফি বা ফকিরি সাধনায় যাঁরা সিদ্ধিলাভের পথে অগ্রসর হন, এক পর্যায়ে এসে তাঁদের নির্দিষ্ট দুটি পথের একটি পথ বেছে নিতে হয়। পথ দু’টি হলো— স্লকুমত ও হিকমত। এখানে ‘স্লকুমত’ শব্দের অর্থ রাজস্ব বা বাদশাহী। ‘হিকমত’ শব্দের অর্থ অলৌকিক ক্ষমতা। জাগতিক ক্ষেত্রে রাজত্ব বা বাদশাহী হচ্ছে শাসন-শোষণ এবং জাগতিক ক্ষমতার প্রতিষ্ঠা। ফকিরি সাধকের ক্ষেত্রে রাজস্ব বা বাদশাহী হলো সর্বতোভাবে মানুষের কল্যাণ করা। ইসলামের প্রথম চার খলিফা যা দেখিয়ে গেছেন। তাঁরা শাসক হয়েও নিজেকে শাসক না ভেবে, সব ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে উঠে হয়েছিলেন সেবক। মানুষের সেবক। খলিফা হয়েও ছিলেন ফকের। ফকিরি সাধকরাও তেমনি মানুষ সেবা, মানুষ ভজনার কথা বলেছেন। এমনকি স্বপেম্নও তারা মানুষের অকল্যাণের কথা ভাবতে পারতেন না। শত্রুরও নয়। প্রকৃত বাদশাহ্’র রূপ তো এটাই। এই সাধনায় যাঁরা সিদ্ধি লাভ করেন— তাঁরাই হয়ে ওঠেন শাহানশাহ্। সাঁইজি যখন বলেন:
... গঙ্গাজল কূপজল হয়
বিলে বাঁওড় রয়
সাধ্য কি তার গঙ্গাতে যায়
গঙ্গা না এলে পরে...
তখন উপলব্ধি করি, মানুষের মধ্যে স্রষ্টার বসবাসের কথা, জীবাত্মা আর পরমাত্মার সম্পর্কের কথা। গঙ্গা যখন প্লাবিত হয়—তখন গঙ্গার পানি বিল-বাঁওড়ে চলে আসে। প্লাবন শেষে বিল-বাঁওড়ে আবদ্ধ হয়ে যায়। সেই অবস্থাকে সাঁইজি বলেছেন,‘আমায় রাখলেন সাঁই কূপজল করে আধেলা পুকরে (পুকুরে)...’। অর্থাত্ এই দেহ নামক আধেলা পুকরে, গঙ্গাজল’ নামক পরমাত্মার অংশ বদ্ধ হয়ে আছে। তার বাসনা পরমাত্মার সঙ্গে মিলিত হবার। কিন্তু তার সাধ্য কম, তাই তার সাধনার দ্বারা সে অহর্নিশ স্রষ্টাকে আহ্বান জানায়। স্রষ্টা এসে যখন তার সঙ্গে মিলিত হন, তখন সে বিলীন হয়ে যায় স্রষ্টার অস্তিত্বের মধ্যে। স্রষ্টা থেকে এসেছি, আবার স্রষ্টাতে অবলুপ্ত হবো। সাধকের কাছে তাই স্বর্গ-নরকের অস্তিত্ব নেই। ‘ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’-এর ব্যাখ্যা সাধকের কাছে এমনই।
ফকিরি সাধনার মূল কথাই হলো ‘মিলন সাধন’। জগতে সন্তান-সন্ততি রেখে দেহত্যাগে একটা মায়ার পিছুটান থেকে যায়। কোনো পিছুটান নেই যে ফকিরি সাধকের। সে সহজেই মিলিত হতে পারে স্রষ্টার সঙ্গে। একমাত্র ফকির ছাড়া আর সমস্ত জীবাত্মার সাধন হলো সৃজন-সাধন। এও স্রষ্টার এক লীলা। তার সৃষ্টিকে সচল রাখার কৌশল। তবে ফকিরি সাধনা— সংসার ত্যাগী সন্ন্যাসীর মতো নয়। ফকিরি সাধনায় সাধন-সঙ্গিনী অতি আবশ্যক। সঙ্গিনীর ভূমিকাও প্রায় সমান। কারণ সঙ্গিনী ছাড়া সাধক সম্পূর্ণ নয়। স্রষ্টা ছিলেন আপনাতে আপনি গুপ্ত। নৈরাকারকে আকারে আনতে তিনি আদমকে সৃষ্টি করলেন। কি ছিল সেই আকারবিশিষ্ট আদমের মধ্যে যে, ফেরেশতাকুলকে তিনি নির্দেশ দিলেন আদমকে সেজদা দিতে? সেজদা না দেয়ার অপরাধে আযাযিল ফেরেশতাকে কেন হতে হলো অভিশপ্ত শয়তান ইবলিশ? আল্লাহ ছাড়া যে কাউকে সেজদা দেয়া যায় না— আযাযিল তা জানতেন। তা হলে চিরকালের নিরাকার স্রষ্টা আদমকে সেজদা দিতে বলেছিলেন কেন?— কি রহস্য লুপ্ত ছিল সাকার আদমের ভেতর? কোনো ভেদ বুঝতে না পারায় আযাযিলকে হতে হলো ইবলিশ। স্রষ্টার সেই রহস্য সত্ত্বাই— পূর্ণ মানুষ আদম। নিরাকার স্রষ্টার আকারময় রূপ। তারপর স্রষ্টা আদমকে খণ্ডিত করে হাওয়াকে সৃষ্টি করেন। তাঁদের আনন্দময় মিলনে একাকার হবার মধ্যেই আবার পূর্ণত্ব লাভ করে মানুষ। একাকার মিলনেই সৃষ্টি হয় সন্তান-সন্ততি। এটাই সৃজন সাধন।
মিলন সাধন শুধু একাকার হওয়াতে পূর্ণ হয় না। দুয়ে মিলে এক নয়, শূন্য হয়ে যেতে হয়। আকার নিয়ে নিরাকারে প্রবেশ করা যায় না। শূন্যের কোনো আকার নেই। তাই শূন্য হয়েই নিরাকারে বিলীন হতে হয়। দুয়ে মিলে প্রথমে এক আকার ধারণ করা, তারপর যে নিরাকার থেকে আকার লাভ, সেই নিরাকারে মিশে সবার জন্য পরমানন্দময় শূন্য হয়ে যাওয়া। স্রষ্টা নিজেই পরমানন্দময়-প্রেমানন্দময়। সাধকের প্রেমানন্দ তাই কামসুখ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। বস্তু পতনে কাম, বস্তুকে চেতনলোকে নিয়ে যাওয়াতেই প্রেম। কামসুখ ক্ষণস্থায়ী। প্রেমানন্দ অক্ষয়।
বাউল মানুষ ভজে, যেখানে সাঁই নিত্য বিরাজে। বাউলের কারবার মানুষ, তার স্রষ্টা এবং তার সৃষ্টির অনুসন্ধান। বাউল সত্যের উপাসক। নিজ পরিমণ্ডলে তার সাধন-ভজন আচার, বিহার। লালন তত্ত্ব হচ্ছে সিনায় সিনায় কারবার। এটা বোঝার বিষয়, বোধের বিষয়, বুঝে নেয়ার বিষয়, বলে কয়ে লালন তত্ত্ব জানা বোঝা মুশকিল। লালন ধারায় গুরুত্ব দেয়া হয়েছে গুরুকে। গুরুর তত্ত্ব শিষ্য নেবে সিনা থেকে সিনাতে। তাহলেই তো শিষ্য পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে। গুরু বাঁধা পড়বেন শিষ্যের সিনাতে। এভাবেই চলে আসছে এভাবেই চলবে। ওই যে সাঁইজি বলে গেছেন ‘ভক্তের ডোরে বাঁধা আছেন সাঁই।’ ডোর মানে রশিটা তো এখানেই।

কৃতজ্ঞতা:
মোমেন মাঝি
আবু ইসহাক হোসেন
প্রদোষ কান্তি সরকার
সুধীর চক্রবর্তী
শক্তিনাথ ঝা
সুরজিৎ সেন
লিয়াকত আলি

No comments:

Post a Comment