Total Pageviews

Wednesday, January 19, 2011

গল্প

একটি ছেলের পাঁচটি গল্প
দিবাকর সরকার

 
গল্প এক – ঘুম ও ঘোড়া
 
টগবগ করে ছুটে চলেছে ঘোড়া। ঘোড়ার ওপর জলসাঘরের রাজা। ঘোড়সওয়ার হিসেবে রতুর বেশ নামডাক। কত বার কত ভিন্ন জাতের ঘোড়াকে বাগে এনে, আদর করে, বশ করে চেপে বসেছে তার পিঠে। ছুটে এসেছে মাইল খানেক। সকাল হলে অবশ্য জলসাঘরের ঝাড়বাতি নিভিয়ে দেন মা। চিৎকার চেঁচামেচি করে বের করে আনেন।
 
 
কিন্তু আজ পরিস্থিতি কিছুটা আলাদা। আজ রাতে তার জলসাঘরে প্রবেশ করা হয়নি। সুঠাম ঘোড়ায় চড়ার ইচ্ছেটুকু কেড়ে নিয়েছে একটা সংবাদ। আর সংবাদের কেন্দ্রে থাকা মানুষটিকে দেখতে সে এখন বাস্তুহারা হয়ে অনেক দূরে। একটি সরকারি আরোগ্য নিকেতনে।
 
স্ট্রেচার গাড়ির ওপর যে লোকটাকে নিয়ে যাওয়া হল, তার ডান পা অতিমাত্রায় ফুলে গেছে। হাঁটুর নিচে গোড়ালি অবধি শরীর জোগান দিয়েছে অপরিমেয় রক্ত। মনে হচ্ছে প্লাস্টিকের ব্যাগে মুরগির মাংস রাখা। ছুটে চলেছেন তাঁর স্ত্রী। স্ট্রেচার গাড়ির সমগতিতে। সে উন্মাদিনীর চোখের সামনে গাড়ি চলে গেছে ওই গোড়ালির ওপর। কে আর ধরবে সেই গাড়িটিকে। ঝাঁ চকচকে রাস্তার ওপর চাপা দেওয়ার উৎসাহে চতুর্গুণ গতি ধারণ করে ওই কালো টায়ার এই মুহূর্তে কলকাতার কোন্ রাস্তায় তা অনুমান করতে জনতার ভিড় আরও বেড়ে গেল।
 
পুলিশ! রাতে এসব প্রায়ই হয়! আত্মহত্যা করেছে এক যুবতী। কারণ অনুসন্ধানে পুলিশ তাকে নিয়ে এসেছে এখানে। যখন আনা হয় পুলিশের চ্যাংদোলায়, মুখখানা ছিল ঢাকা। কিন্তু এমার্জেন্সির একটু ভিতরেই দেয়ালের পাশে ডাক্তারের সামনে তার মুখাবরণ খুলে দেয় পুলিশ। তখনই রতুর চোখে উঁকি দেয় অবর্ণনীয় একটি মুখ। আত্মহত্যার শেষেও আত্মবিষণ্ণতা কাটেনি তার। যন্ত্রণার উপশম হবে ভেবেছিল যে দড়িটায়, সে দড়ি তাকে এতটা যন্ত্রণা দিয়েছে যে সে এখন টেরই পাচ্ছে না মূল যন্ত্রণা তার দূর হয়েছে কী না।
 
আরে! এ ছেলেটা তো আমাদের পাড়ারই। কাকুর রুদ্ধশ্বাস কথায় সম্বিৎ ফেরে রতুর। কে, কোন্ ছেলে? সে দেখতে পায় এক তার সমবয়সি যুবক, অন্যের অকুণ্ঠ সহযোগিতায় ঢুকছে এমার্জেন্সির গহ্বরে। বুক ভেসে গেছে রক্তে। পাড়ায় দল-বিদল সংঘর্ষে তার বাঁ চোখে ক্ষুর চালিয়ে দিয়েছে কেউ। পাশে শুয়ে ছিলেন এক ভদ্রলোক। অনুত্তেজিত। দুই মাসের ওপর যাঁর স্ত্রী আর মেয়ে হাসপাতালে, তার উত্তেজনা প্রশমন হবে বইকী। আর জি কর তার বর্তমান বাসস্থান। দিনে অফিস, দুপুরে হোটেল আর রাতে আর জি কর। এসব ঘটনা তার চোখসওয়া। তবু চিৎকার শুনে চোখ চেপে ঘুরে বললেন, দু-মাসের মধ্যে বার চারেক দেখলাম হারামজাদাকে, যানোয়ার কোথাকার, কী করে কে জানে!
 
কাকু কাকিমার অবস্থা নিয়ে বিচলিত ছিলেন। স্বাভাবিক কারণে খানিকটা অপ্রকৃতস্থ। এখন যেন তার ওপর যেন আরও একটা অস্বস্তির বোঝা চেপে বসল। এক পাড়ায় থাকে। বাজারে দেখাও হয়। তাই বলে অ্যানটিসৌশ্যাল বুঝতে পারেননি।
 
কাকুকে ডাইভার্ট করার জন্য রতুর দাদা পেনশন অ্যাকাউন্টের ব্যাপারে খোঁজখবর নিল, ফ্ল্যাট কদ্দূর জানতে চাইল।
 
এ এক অদ্ভুত দৃশ্য।
 
পাশে এক মুসলিম ভদ্রলোক। উৎসাহী জনতার ধারাভাষ্য অনুযায়ী সে বহুক্ষণ মৃত। সহমর্মীরা নিয়ে গেল তাকে। তার পাশেই এক হিন্দু। শুয়ে আছেন বলে তাকেও বলা হচ্ছে মৃত। অন্তত রতুর দিক থেকে সে খানিকটা মৃত। ছোটো সিংগল বেডখানা রজনিগন্ধার ফ্যাবিউলাস কিছু স্টিক দিয়ে সজ্জিত। স্টিকগুলো যেন গুলির ছররা। চারটি কোণায় অন্যের কাঁধে ভর দিয়ে এল তার পরিচিত কেউ। একটি বৃত্ত নির্মাণ করে মৃত লোকটিকে কী যেন বলল ওরা। যাক, কী বলল না বলল, তা জানার চন্দ্রবিন্দুমাত্র উৎসাহ নেই রতুর।
 
সে সরে যেতেই তড়িৎগতিতে সেই জায়গাটা দখল করল রতু। জমির হাহাকার চারিদিকে। দাঁড়ানোর জন্যও আজকাল জমি দখল করতে হয়।
 
রাত দুটো তিন। যদিও তার মোবাইল ঘড়ি মিনিট পাঁচেক এগিয়ে সেট করা। সেই কখন এসেছে। দুরপাল্লার অশ্বের মতো দাদার কালো চকচকে অ্যাকটিভার পিছনে চেপে। তার না আছে ড্রাইভিং সিটে বসার অভ্যাস, না আছে পিছনে বসে সহযাত্রীর চরিত্রে দুরন্ত অভিনয় করার ক্ষমতা। কাজেই ভয় লাগে বইকী। নিশুতি রাতে সমস্ত তন্দ্রা চূর্ণ করে, সমস্ত সন্দিগ্ধ কুকুরকে বাকরুদ্ধ করে দিয়ে নধরকান্তি দুটো টায়ার পিচের সঙ্গে সংঘর্ষের বিপ্লব বজায় রেখে তাদের পৌঁছে দিয়েছিল আর জি কর-এ। পথে উড়ে যাওয়ার সময় স্ট্রিট লাইটের অলস আলো যেন অপারেশন থিয়েটারের আলো। সেই রাস্তায় এখনও কত কাজ হবে, কত অপারেশন, কত লেনদেন। কত কালো টায়ার বৃদ্ধের পা-কে মাংসের দলায় পরিণত করবে, কত ক্ষুর চোখে ধার পরখ করবে, কত যুবতী আত্মহত্যার জন্য প্রস্তুত হবে, তার সংখ্যা বিচার্য না। পিছনের সিটে সতর্ক গ্রিপ, হেলমেটের নিচে চশমার চঞ্চলতা সামলে এগিয়ে যাওয়ার সময় তার মনে হয়েছিল, সত্যিই তো, যদি এই যন্ত্রশকটটা না থাকত, কে নিয়ে যেত এই রাতে! রতুর মনে পড়েছিল, সিঙ্গুরে টাটার জমিদখল, গাড়ি তৈরির ব্যবস্থাপনাকে নস্যাৎ করে দিতে সে পথে নেমেছিল। সে বন্ধুমহলে কলকাতার প্রচুর গাড়ি তুলে দেওয়ার পক্ষে কথা বলেছিল। ভাগ্যিস এই বালখিল্য প্রতিরোধে কান দেয়নি সরকার। যদি এই যন্ত্রশকটটা না থাকত, কে পৌঁছে দিত এই রাতে! বিপ্লব তো মূর্খামি!
 
রমলা কাকিমাও আউট অভ ডেইনজার।
 
আর জি কর হাসপাতাল-এর এমার্জেন্সি। ঢোকার মুখে দালাল চক্রের ইতিউতি চাহনি। এখানে ওখানে নোংরা ও পানের পিকদগ্ধ দেয়াল। বৃষ্টি আসলে নোংরারা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। সাবলীল ভঙ্গিমায় ছুটে যায় রুগ্‌ণ জরাক্রান্ত বৃদ্ধের পিঠের নিচে, নির্লজ্জের মতো ভিজিয়ে দেয় জালিজালি হয়ে যাওয়া কাপড়খানা। ভেজা শরীর শারীরিক ভগ্নতা দেখানোর ক্যানভাস হয়ে ওঠে। ভোকাল কর্ড ফুলে ওঠে, কিন্তু আওয়াজ বেরোয় না। সেই প্রতিরোধহীন দেহকে জড়িয়ে ধরে তরলমতি জল উপদ্বীপ সৃষ্টি করার খেলায় মেতে ওঠে।
 
সে এক লাফে সরে যায়। বুঝতে অসুবিধা হয় না তার, মৃতদেহগুলিকে সরিয়ে নিয়ে গেলেও পূর্ণমাত্রায় সরাতে পারেনি। না হলে জায়গাগুলি ফাঁকা থাকত না। তবে এমার্জেন্সির ভিতরেও নয়, ঠিক বাইরেও নয়। দেহদুটি চলে গেলেও যতটা অস্তিত্ব এখনও পড়ে আছে, তাকে ঠেলা মেরে সরিয়ে দিয়ে সে দখল করল একটা সিংগল বেড সমান জমির ফালি। যে অঞ্চল সে অধিকার করল, লুণ্ঠন করল সেখানকার শান্তি। তার অবয়ব ঢেলে দিয়ে জমির শ্বাসরোধ করে সে বসে পড়ল। জমি দখলের মজাটা তাহলে এখানেই! বেঁচে থাকার মজাটা আসলে অন্যের বেঁচে থাকাকে চুরমার করে দিয়েই।
 
দুই হাঁটুর ওপর মুখের বাঁ গাল স্থাপন করল। রমলা কাকিমা, কাকু ও তার পাড়ার বন্ধু, অক্সিজেন সিলিন্ডার, স্যালাইনের কর্ড, শ্যুগার মাপার যন্ত্র, লম্বা গোলাকার হলুদ লাল ট্যাবলেট চোখের নিমেষে মিলিয়ে গেল। কাকিমা ঘুমালো কি-না জানার শক্তিটুকু নিঃশেষিত হলে সে পূর্ণ মাত্রায় অক্সিজেন টানতে লাগল।
 
সে এখন জলসাঘরের অযুত যোজন দূরে এক রহস্যময় উপদ্বীপে। চরম উত্তেজনায় বাকি রাতটুকু কাটানোর জন্য কালো কুচকুচে অ্যাকটিভাটাকে খুঁজতে লাগল।
 
 
 
 
 
 
 
গল্প দুই – স্কুলছুট
 
যখন স্কুলে, ব্যাকরণে ঘোষধ্বনি বুঝতে পারতো না সে। অংক সূত্রানুযায়ী নামবে না তো প্রদোষবাবুর বকুনি। এদিকে জীবনবিজ্ঞানের হঠকারিতা। ওদিকে ইতিহাসে গুহামানবের অস্ত্র গড়ার কারনামা। কেন পড়তে হয় এসব, পড়ে হবেই বা কী, তার অর্থ তার কাছে স্পষ্ট নয়। পেন পেনসিল রবার বই ব্যাগ এসব নিয়ে যাওয়াও বেশ ঝকমারি। তার ওপর কোনো দিন যদি ব্যাজ পরতে ভুলে যায়, প্রহার অবশ্যম্ভাবী। জোরজার করে স্কুলে পাঠানো হয় বলেই সে আসে। দিন যায়, সংস্কৃতের ধাক্কা আসে। সে ধাক্কা যে-সে ধাক্কা নয়। লতাম লতে লতা মুখস্থ করতে না পারায় ক্লাস এইটেই সে স্কুলছুটের দলে নাম লেখায়। অসহ্য দমবন্ধকর পরিস্থিতির চাপে হাঁপ ধরে যাচ্ছিল তার, আর, না পারতে পারতে এক অজানা ভয়। তাই স্কুলপালানোই তার মুখ্যকর্ম হয়ে দাঁড়ায়।
 
পাঁচিল টপকে পগার পার হওয়াই লক্ষ্য। হয় স্কুলের সামনের পাঁচিল, অথবা ছাদখোলা বাথরুমের দেয়ালকে সে টার্গেট করত। সপ্তাহে দুদিন সে এই ভাবে স্কুল থেকে পালাতো। মনিটরের কাছে খবর পেয়ে প্রধান শিক্ষক তলব করলেন নিতাইকে। চারটে রাসভারি থাপ্পড় তার গালে পিঠে পড়ল। কাঁদতে কাঁদতে উশকোখুশকো চুল নিয়ে সে যখন ক্লাসে এসে বসল, বেশির ভাগ ছেলেই চুপ মেরে গেল।
 
মনিটর সায়ক কিছুটা ভয়ে কিছুটা কষ্টে নিতাই-এর পাশে এসে বসল। বলল, দ্যাখ, আমি তো বাধ্য হই নাম লিখতে। তোর নাম না লিখলে আমি শাস্তি পাবো। তুই আর পালাস না, প্লিজ। হেডু বড্ডো মারে।
 
প্রধান শিক্ষক শ্রেণি শিক্ষককে ডেকে জানিয়ে দিলেন একটু নজরে রাখতে। তবু নিজের দেওয়া কড়া শাস্তির ওপর তাঁর অশেষ আস্থা। ওতেই কাজ হবে বলে হাসির উষ্মা ছড়িয়ে দিলেন ঘরের চতুর্দিক। শ্রেণি শিক্ষকের কপালের ভাঁজ খুলতে না খুলতেই এসে গেল গরমের ছুটি।
 
গরমের ছুটিতে নিতাইকে দ্যাখে কে! নিতাই মানে, আমাদের রতু। ওরই নাম গল্পের স্বাদ বদল হেতু নিতাই হয়ে গেছে। পুকুরে ঝাড়া দুঘণ্টা এলোপাথাড়ি সাঁতার। হাঁটুজল গলাজল এক করে উন্মাদের মতো পুকুরবিহার। বিকালে ফুটবল। ওপাড়ার যদুদের সঙ্গে রোজ ম্যাচ। ফ্লাড লাইট নেই, দর্শক নেই, কমেন্টেটর নেই, নেই স্পনসর – তবু এ যেন বিশ্বকাপ ফুটবলের সেমিফাইনাল ম্যাচ। ইস্টবেঙ্গল ভার্সাস ব্রেজিল। ওপাড়ার যদু যদি বাইচুং হয়, এপাড়ার নিতাই রোবিনহো। কিন্তু ক্লাসের ডিফারেন্স! গতবারের আগের বার ৬-০, আর গত বছর ৯-০ ছিল। ভাবলেই যদুর গা জ্বলে যায়, নিতাই হ্যাটট্রিক করেছিল। আর এবার? ব্রেজিল তার বেস্ট টিম নিয়ে হাজির! সবাই আশা করছে এক ডজন গোল আর রোবিনহোর ডাবল হ্যাটট্রিক।
 
পোড়া দুপুরের শেষ বেলায় টানটান উত্তেজনায় খেলা শেষ হল। কিন্তু অপ্রত্যাশিত ঢঙে যদুরা নিতাইদের হারিয়ে দিল ২-০ গোলে। যদু প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগ ভেদ করতে না পারলেও মাঝমাঠ থেকে জিদানের মতো এমন দুটো মোক্ষম পাস বাড়িয়েছিল যে পৃথিবীর সবথেকে খারাপ স্ট্রাইকার ট্যালা-ও জালে বল জড়ালো। অ্যাওয়ে ম্যাচে এইরকম কীর্তি স্থাপন অপ্রত্যাশিত ভেবে যদুর কী কান্না!
 
অন্য দিকের দৃশ্যটি বড়োই বিরল। হোম ম্যাচে পর্যুদস্ত কিশোরের কান্না পুকুরের জলে ধুয়ে যাচ্ছে। সে স্নান করছে কান্না ধুয়ে যাওয়ার জন্য। আর ভাবছে, এ কী হল, আজ কিছুতেই গোলমুখে খেলাটা ঠিকঠাক হচ্ছিল না। নিজেকে তার ট্যালার থেকেও খারাপ খেলোয়াড় বলে মনে হচ্ছিল। মান্তুটাও ফালতু খেলেছে। ৩৬ মিনিটের মাথায় নবুটা রেড কার্ড দেখল। তাহলে কি আজকের দিনটাই ওদের সাথে ছিল না? এ বার থেকে কি তাহলে পরাজয়ও অভ্যেস করতে হবে?
 
চৈত্রের সূর্যে তাদের প্রিয় মাঠের ঘাসও হলুদ বর্ণ ধারণ করল। হারের দগদগে ঘা নিয়ে গরমের ছুটি শেষ হয়ে গেল। বরাবরের মতো নিতাই ভুলে গেল ছুটির কাজের কথা। পুরোদমে ক্লাস শুরু। ঘা শুকাতে না শুকাতে অংক স্যারের হাঁকডাক। গরমের ছুটির কাজ আদায় করছেন তিনি। নিতাই বেঞ্চির তলায় ঢুকে গেল। কিন্তু স্যারের তো ইগলের চোখ। ঠিক ধরে ফেলা আর কাজ না-পাওয়ায় পিটুনি।
 
বৈশাখ মধ্যগগনে। স্কুলের টিফিন পিরিয়োডে নিতাইকে দেখা গেল স্কুল গেটে ঠেস দিয়ে আলুকাবলি খাচ্ছে। কে যেন জামায় দিল টান। মান্তুর চোখে পড়ল, কী একটা গুজুরগুজুর করছে ওরা। যা করে করুক, মান্তু চুটিয়ে খেলার নেশায় বিভোর। টিফিন শেষ হওয়ার ঘণ্টা পড়লে হুড়মুড়িয়ে যে যার ক্লাসে ছুটল। সায়ক খেয়াল করল, নিতাই হাওয়া। এবং খোঁজ খবর নিয়ে জানা গেল, এবারও একই পথ। বাথরুমের দেয়াল টপকে। উঁচু ক্লাসের দাদারা নিজেরা পালাতে না পেরে কোপ সংবরণ করতে না পেরে হেডস্যারকে জানিয়ে দিয়েছে।
 
কিছু ছেলেকে তার খোঁজে পাঠালেন উপপ্রধান শিক্ষক। বেজায় চটেছেন তিনি। দ্রুততার সঙ্গে ষষ্ঠ পিরিয়োডের পর স্কুলের পঠনপাঠন সেদিনের জন্য মুলতুবি ঘোষণা করা হল। অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল আর স্টাফ কাউন্সিল-এর জরুরি মিটিং। যা উঠে আসবে সিদ্ধান্ত স্বরূপ, জানানো হবে স্কুলের ম্যানেজিং কমিটিকে।
 
যদিও, স্কুলের বাইরে, অনেক দূরের নেতাজি স্পোর্টিং ক্লাব-এর মাঠে তিরগতিতে রক্ষণভাগ ফালাফালা করে এগিয়ে যাচ্ছে নিতাই। বীরেশপল্লির ছেলেরা যদুকে ভাড়া করে এনেছে এই খবর ছোটু স্পাইয়ের মাধ্যমে কানে আসতেই কালীবাড়ির হয়ে নেমে গেছে। কালীবাড়ির হয়ে জীবনে মাঠে নামার ছেলে সে নয়, কিন্তু যদুকে ভাড়া করে আনা হয়েছে, বীরেশপল্লির পক্ষ থেকে সে অগ্রিম পঞ্চাশ টাকা পেয়েছে শুনে নিতাই হাজির হয়েছে বিদেশির মুখে চুনকালি মাখাতে। বল নিয়ে এগোনোই বলে দিচ্ছে যে সামনের টুর্নামেন্টে বীরেশপল্লি মনের ভুলেও যদু-টদুর নাম নেবে না।
 
উচিত শিক্ষা দিতে বাবা-কে ডেকে প্রধান শিক্ষক তাকে বিদেয় করলেন। মনে মনে আনন্দ ধরে রাখতে পারছে না নিতাই। এ যেন সাক্ষাৎ স্বাধীনতা অর্জন। বাবার টিমটিমে মুদির দোকান। উইলস ফ্লেক আর রাকেশ খৈনি ছাড়া বিশেষ কিছু চোখে পড়ে না। বাড়িতে পড়ার চল নেই। ভাড়ার আড়াইশো টাকা গুনে দিতে বাবার দম ফেটে যায়। একদিক থেকে বাঁচা গেছে, স্কুলের খরচ আর চালাতে হবে না। এ বার ছেলেটাকে রোজগারে নামিয়ে দিতে পারলে তাঁর মরেও শান্তি। তাই নিতাই-এর কানটা ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেলেন স্টেশন পার্শ্বস্থ সাইকেল স্ট্যান্ডের মালিকের নিকট।
 
করজোড়ে দাঁড়িয়ে নিতাই-এর বাপ। নিতাই ভুরু কুঁচকে। পাশেই। একটা শেডের তলায় স্যান্ডো গেঞ্জি পরে অভদ্রের মতো দাঁড়িয়ে সাইকেল স্ট্যান্ডের মালিক। ঘোলাটে চাহনি দিয়ে নিতাইকে জরিপ করছেন তিনি। হাতের হাতপাখাটা অর্ধবৃত্ত এঁকে চলেছে।
~ পারবে তো?
~ হ্যাঁ হ্যাঁ, একটু শিখিয়ে-পড়িয়ে নেবেন। আপনার ছেলের মতো।
~ আরে ছেলেরাই আজকাল পকেট মারে!
 
স্থির হল মাসিক দুশো টাকার বিনিময়ে সে সাইকেলগুলো যত্ন করে সাজিয়ে রাখবে আর প্রয়োজনবোধে হুজুরের ফাইফরমাশ খাটবে। বাড়িতে নিতাই-এর মা বললেন, পারবে তো? ও তো জীবনে কোনো দিন সাইকেলই চালায়নি। বাবা ধমকে দিয়ে বললেন, মাসশেষে দুশো টাকা কি আমার শ্বশুর দেবে? শিখতে হবেই! আর ছেলেকে ঘরে পুতুপুতু করে রাখতে হলে নিজে গতরে খাট্ মাগি!
 
যে ভদ্রলোক আগে আসবেন, তাঁর সাইকেল বাইরের দিকে। যিনি গভীর রাতে, তাঁরটা ওই-ই-ই ভিতরে। প্রতি সাইকেল ছাড়ার সময় দুটাকা নিয়ে কালো ব্যাগে ভরতে হবে। কাজটা মোটেও সহজ নয়। ভুরু কুঁচকে সে বোঝার চেষ্টা করে দ্বিতীয় বারের পরাধীনতায় তার স্বাধীনতা প্রথম বারের থেকে কতটা বেশি বা কম।
 
ভোর ছটায় স্ট্যান্ড খোলে। ধুপ ধরায়। চারধারে গন্ধ ছড়িয়ে এগিয়ে যায় বাঁশে টাঙানো গণেশের দিকে। সম্মুখস্থ তাকে রাখা আলুতে পুঁতে দেয়। হুজুরের একটা কথা মাথায় রাখার চেষ্টা চালায় যে স্ট্যান্ডে সাইকেল-এর সঙ্গে বন্ধুত্ব না করলে সাইকেল বেঁকে বসে। মানে সাইকেলের হ্যান্ডেল বেঁকে যায়। একটা পড়লে বাকিগুলো হুড়মুড়িয়ে পড়ে। বেশ কয়েকদিন তাই হয়েছিল। কেই বা অতক্ষণ লাইন দিয়ে দাঁড়াতে চায়? তাই পড়ে গেছে। একদিন এক ভদ্রলোকের সিটকভারটা হেঁচড়ানোর একটা দাগ পড়ে গেল। মালিকের সঙ্গে বচসার শেষে টাকা না দিয়ে তিনি চলে গেলেন। ব্যবসা লাটে উঠবে দেখে মালিক তো রেগে কাঁই। এক মাস পরে বললেন, আর এক সপ্তাহ দেখবো, যদি এ রকম চলতে থাকে, তাহলে বের করে দেবো।
 
এদিকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার কোর কমিটিতে শোরগোল উঠল। সরকার রীতিমতো উদ্‌‌বেগ প্রকাশ করলেন। স্কুলছুটের মতো জ্বলন্ত সমস্যার নিরসনে এক বিরাট সভার আয়োজন করলেন মিনিস্ট্রি অভ হিউম্যান রিসোর্স ডিভেলপমেন্ট। ডিম্বাকৃতির টেবিলে নীল লেবেল জড়ানো জলের বোতল, একহারা মাইক্রোফোন, প্রচুর কাগজপত্র, প্রেস রিপোর্টার, ফটোগ্রাফার, চোখধাঁধানো ফ্ল্যাশ, আর একগুচ্ছ পণ্ডিতের চাঁদের হাট তথা মগের মুলুক।
 
নিতাই-এর হিশাব মেলে না। কুড়িটা সাইকেলে সাইকেল-পিছু দুটাকার হিশেব করে সে মালিককে কিছুতেই বুঝিয়ে উঠতে পারছে না খোয়া যাওয়া টাকার হিশাব। একজন দুজন করে কতজন যে কাল দেবো পরশু দেবো বলে কাটিয়েছে, সে ভুলেও গেছে। স্মরণেও আসছে না লোকগুলোর মুখ। দু-একজনকে ধরলেও তারা নিজস্ব স্বভাবগুণে অস্বীকার করেছে।
 
কাজকারবার নেই। পেটে লাথি খেয়ে সে এখন বাড়িওলার ছাদে।
 
শিক্ষক-শিক্ষিকা বাড়ি থেকে বাড়ি সার্ভে করছেন। বাবা-মা'র সঙ্গে কথা বলছেন, বোঝাচ্ছেন, কিছু বাড়িতে সন্তানকে স্কুলে না পাঠানোর পিতামাতাকে রীতিমতো বকাঝকা করছেন। কিন্তু স্কুলমুখী করে তোলার ক্ষেত্রে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারি যৌথ অভিযানে সবাই ভুলে গেলেন নিতাই ওরফে রতুকে ফিরিয়ে আনার কথা। তাকে স্কুলমুখী করে তুলে কিছু হবে না জেনেই হয়ত তার কথা শিক্ষাবাহকরা মাথায় আনেননি।
 
ওদিকে রতুবাবু একটা বিসলেরি-র বোতলের একপাশ অন্যপাশে জলের ভিতর দিয়ে দেখছিল জগতটাকে। গালে এখনও বাবার পাঁচ আঙুলের ছাপ। সে-যন্ত্রণা কমে গেছে। বিসলেরি-র বোতল তাকে শান্ত করে তুলেছে। কে বলেছে জগৎ পুড়ে খাক। বাবার দোকানের গায়ে ঝুলে থাকা নারকেল দড়িটায় আগুন ঘুমচোখে থাকে। সরু লিকলিকে একটা ধোঁয়া বেরোয়। যে-ধোঁয়া কোনো দিনই আকাশ টপকাতে পারে না। কোনো কিছুই টপকে বেশি দূর এগোনো যায় না ভেবে সে আশ্রয় গ্রহণ করে তার বাবার কাছেই। সে কাজ পায়, বাবার দোকানেই। যে-দোকানে বিক্রিবাটা হয় না, সে-দোকান চালাতে তার মতো ওস্তাদ পৃথিবীতে আর কেউ নেই।
 
বকতে বকতে কচি-বুড়ো শিক্ষক-শিক্ষিকার প্রাণ ওষ্ঠাগত। দাবদাহে অস্থির হয়ে ওঠেন তাঁরা। একেই ভাপসা গরম, তার ওপর মাইলের পর মাইল হাঁটা। এসব অনর্থক কাজের কোনো মানে আছে? পয়সা জুটলে না হয় হোতো। অন ডিউটি পেয়ে রোদে ঘুরে সার্ভে করা, স্কুলছুটদের ধরে আনা, ছিঃ, এগুলো কোনো কাজ? স্কুলে ক্লাসে যেতেই ইচ্ছা করে না এঁদের। শিখিয়ে পড়িয়ে হবেটাই বা কী। বাপ-মার ঠিক নেই এমন ছেলেবিলে নিয়ে স্কুল ফেঁদেছে...
 
পদধ্বনি এবং পদধ্বনির প্রতিধ্বনিতে চাপা পড়ে যাবে এদের গোঙানি। অন্তত এমনই ভেবেছিল হিউম্যান রিসোর্স ডিভেলপমেন্ট। তাই ভবিষ্যতের কথা ভেবে, উন্নততর ভারতবর্ষের কথা ভেবে, নতুন আইন-এর মাধ্যমে স্কুলছুটদের ঘর থেকে স্কুলঘরে আনার সুবিশাল কর্মযজ্ঞ আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষণা করে তারা। আর তীব্র গরমে বেকার কিশোর তার গাল আর নাকে দোকানের একটা বিসলেরির বোতল চেপে ধরে। জলের স্বাধীনতা আন্দোলনের থিম সং হয়ে ওঠে, ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা কুল কুল...
 
***
সংসারের মজাটা হল বাবা-মাকে ঘিরে। তাঁরা থাকলে শৃঙ্খলের সমস্যা, না থাকলে শৃঙ্খলার সমস্যা।
 
গল্প তিন – রতু ও সুকান্ত
 
রতু আর রতু নেই। রাতের পর রাত কাটিয়ে সে আজ সুকান্ত।
 
গল্প চার – বাহাদুর ও লালগড়
 
রক্তে রাঙা অর্জনগড়। ক্যাপশনেই বাজিমাত। ছোটোবেলায় যারা বাহাদুর পড়েনি, তারা জানে না। ওঃ, বাহাদুর ঘোড়া ছুটিয়ে যাবে। বলিষ্ঠ চেহারা। পরনে হালকা কমলা-হলুদ শর্ট পাঞ্জাবি। জিন্সের প্যান্টের রংওলা প্যান্ট। কে জানে, হয়ত জিন্সের প্যান্টই হবে। একটা বিকট বদমাইশ, যার সামনের দাঁত সোনার, তাকে মেরে ও তার চোরাই কারবার ধ্বংস করে উদ্ধার করবে অর্জনগড়। রক্ত ঝরবে ঠিকই, কিন্তু অপ্রয়োজনে নয়। বাহাদুরের বুদ্ধি ও পেশিশক্তি, ভালো পুলিস ও এনসিসি ক্যাডেটদের কেরামতি, এই সব মিলিয়েই বিজয়গাথা রচিত হবে।
 
মমতার উক্তি, প্রয়োজনে যৌথবাহিনি প্রত্যাহার করতে হবে। (কিন্তু অপ্রয়োজনে নয়।)
 
সে দ্যাখে, এক ক্যাপিটালিস্টের হাত থেকে কোনোক্রমে মুক্তি পেয়ে আরেক ক্যাপিটালিস্টের হাতে ধীরে ধীরে নিজেকে সমর্পণ করতে থাকে নির্বোধ লালগড়... নির্বোধতর সবুজগড় হওয়ার প্রয়াসে।
 
গল্প পাঁচ – রতু ও সুকান্ত
 
পাঠক, আপনি নিশ্চয়ই এতক্ষণ ভাবছেন গল্পের গোরুকে শুধু গাছেই নয়, গাছের মগডাল অবধি চড়ানোর ছ্যাবলামো কোন্ পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে তা অক্ষ(র)যাত্রাই দেখাতে পারে। হয়ত এও ভাবছেন, গল্প লিখতে বললেই এ লিখে দেবে। এই সব লেখা আবার ছাপাবেও। আসলে নিজেরা বার করে তো, যা খুশি তাই করে। কেউ কেউ ভাবছেন, চারটি গল্পের মধ্যে সবথেকে দুর্বল কাঠামো বিশিষ্ট গল্প প্রথমটি। আরও একটু এগিয়ে বলি, আরও বহুজনে এই অবধি পড়ে ভীষণ চটে গিয়ে বলছেন – কে বলেছে, তোর/তোমার/আপনার কথা ভাবছি? নিজেকে ইমপর্ট্যান্স দেওয়ার কিছুই তো দেখছি না!
 
আর কিছু বলব না। জানি, এবার হাসছেন। আসলে আমি এইটিই এতক্ষণ ধরে দেখতে চাইছি। কে শেষ পর্যন্ত হাসে। কতক্ষণ বাদে এত যন্ত্রণার গল্পগুলো পড়েও গর্দভের মতো হাসে। হাসে এবং মুচকি হেসে নিজের বোকামোকে ভালোবাসে।
................
 
চিঠি শেষ। পাঠকের বোকামোর প্রতি শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা জানিয়ে ঘুমাতে যায় রতু। সে হাসে, নিজের বোকামোর প্রতি মিনিট পাঁচেক খিলখিল ছড়িয়ে দেয়। আসলে সে চাকরি করে কীটদগ্ধ ঘৃণ্য পরিবেশ কলুষিত একটি বিরাট উঁচু বিদ্যালয়ে, যেখান থেকে প্রত্যেকদিনই সে পালিয়ে আসতে চায়, ছাত্র নয়, শিক্ষক হিসেবেই, পাঁচিল টপকে। ভাবনা আর ভাবনার বহিঃপ্রকাশের মধ্যে বিরাট ফারাক। সে মুখে বললেও বাস্তবে কিছুই পারে না। তাই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র এবং কেন্দ্রীয় চরিত্রকে কেন্দ্রিক করে তোলার জন্য দায়ী যেসব চরিত্র, চকিতে তাদের নাম বদলে ফেলে। ভীষণ বোকা টিচার হলে যা হয়, ভীষণ ভীষণ গাধা টিচার হলে যা হয় – ব্যথা লাগলে কেটে গেলে আয়োডিন খোঁজে, হোমিওপ্যাথির সন্ধান করে, কম্পিউটারে মগ্ন থাকে এবং কদাকার বোকার মতো, অতি অতি গাধার মতো সারাদিন পড়িয়ে চলে...

2 comments:

  1. প্রথম দুটো ছাড়া বাকিগুলো শেষ হয়নি। এগুলো তুলতে তোকে কে বলল? কী করিস কী এসব!

    ReplyDelete