যেকোনো ক্ষমতার জন্য আজ পুঁজির বিপণন মনস্তত্তই প্রধান আশ্রয়, মুনাফার সংখ্যা-ভাষাই তার কথোপকথনের ভেতরের কাঠামো । উতপাদন-সূচকের বিরাট সাইনবোর্ডের আড়ালে চাপা পড়ে যাচ্ছে মানুষের বেঁচে থাকার অনটনরুদ্ধ বা ছিন্নমূল বা প্রজন্মবাহিত জীবনরীতি, সম্পর্কের বিবিধ আখ্যান, অস্তিত্বের অনর্থ-সংকট । স্বেচ্ছাচার, অবদমনের প্রতিরোধী সমস্ত মতামত হয়ে উঠছে সন্ত্রাস, আড়ালে পড়ে থাকছে লালসা আর বিপন্নতার সভ্য যোগাযোগ । বিপণনচতুর বিশ্বপুঁজি আর ক্ষমতার পরিপূরক আগ্রাসনের সামনে সমস্ত জৈবনিক, সামাজিক আখ্যনের যে সংকট, তারই ইঙ্গিত দিতে চেষ্টা করলাম এই লেখায় ।
১) যারা খবরের ক্রেতা এবং যারা খবর হয়
টুইন টাওয়ার ধবংস থেকে দান্তেওয়াড়া, মিডিয়ার ব্যস্ত কাউন্টারে একটার পর একটা বিনোদন খাদ্য, একই সঙ্গে জনমতকে সম্মতি বা সমালোচনার নিরাপদ পরিধির মধ্যে জায়গা করে দেওয়ার চ্যালেঞ্জ, একের পর এক, বিরামহীন – রাষ্ট্র, ধনকুবের বাণিজ্য-সামরিকজোট এবং সমস্ত প্রাতিষ্ঠানিক সন্ত্রাসের মুখোমুখি পালিয়ে চলা উদভ্রান্ত আতঙ্কিত মানুষের মিছিল, কাঁটাতার ঘেঁষে একের পর এক উদবাস্ত শিবির, রাষট্রনায়কদের বিবৃতির পর বিবৃতি, সন্ত্রাসকে নিকেশ করবার শপথ, দূর্ঘটনাস্থল থেকে একেকটা অসহায় মুখ, বীভতসতার বর্ণনা, উভয়পক্ষের ক্ষয়ক্ষতি-হতাহতের পরিসংখ্যান আর ক্রমশ মিডিয়ার বিনোদনযন্ত্র প্রতিআক্রমণ-প্রতিশোধের স্বয়ংক্রিয় যুক্তি তৈরি করে চলবে, আলোচনা, প্রশ্নোত্তর, মতামত বিনিময়ের মাধ্যমে, প্রত্যক্ষ্যদর্শীর ফুটেজ থেকে ফুটেজ়ে ক্রমশ যুক্তিটা আরও স্বতসিদ্ধ দেখানোর চেষ্টা হতে থাকবে । এইভাবেই প্যালেস্তাইন থেকে ইরাক, আফগানিস্তান থেকে উত্তর কোরিয়া, নন্দীগ্রাম থেকে সোপোর মিডিয়া ক্রমাগত জনমতে ক্ষমতার অবদমনমূলক ভাষ্যকে জায়গা করে দিচ্ছে । আর এই মহান প্রজেক্টে গ্রহীতা তো তারাই যাদের সঙ্গে সংবাদের সম্পর্কটা মূলত বিনোদনমূলক, নিশ্চিন্ত নিরুপদ্রব দূরত্বের । আর যারা গোয়ালতোড়, কালাহাণ্ডি কিংবা দান্তেওয়াড়া, বিজাপুর অথবা হাসিমারা, গরুমারায় থাকে? অথবা প্যালেস্তাইনের মানুষ যারা বেঁচে থাকে ইজরায়েলি মারণাস্ত্রের চোখে চোখ রেখে, শশব্যস্ত মৃত্যুকে ফাঁকি দিতে দিতে? ইজরায়েল আমেরিকার ব্যয়বহূল সামরিক আতাঁত, ধনী দেশের সামরিক জোট, মহড়া, রাস্ট্রসঙঘের নিরাপত্তা পরিষদে কেবলমাত্র বৃহত সামরিক, আর্থিক শক্তিধর উন্নত বিশ্বের একচ্ছত্র সিদ্ধানতের অধিকার, মিডিয়া এই সন্ত্রাসের কাঠামো, তার নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে না, কারণ মিডিয়াকে এই কাঠামোই বাঁচিয়ে রাখে। ক্ষমতা এবং ক্ষমতা প্রসারণের সমস্ত প্রয়াসকে মিডিয়াইতো করে তোলে স্বতসিদ্ধ, প্রাকৃতিক নিয়মের মতো স্বাভাবিক। ফলে বরাবর ক্ষমতার বৃত্তের বাইরে যেখানেই ক্ষমতার জন্য তৈরি হচ্ছে চ্যালেঞ্জ, ফোকাসটা মিডিয়ার ঠিক সেখানেই। টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পরে ফরাসী লেখক বদরিলার যখন বলছে, “আমরা এটা চেয়েছি, কিন্ত করেছে ওরা”(We who wished it, but they who did it)প্রচারমাধ্যম বদরিলারকে সন্ত্রাসের দার্শনিক বলতে শুরু করল। বদরিলার তো একচ্ছত্র ক্ষমতার প্রতি জনমতের সহজাত ঘৃণাই উগড়ে দিয়েছে, কিন্ত না, সন্ত্রাসের একমুখী ক্ষমতানির্দিষ্ট সংজ্ঞাকে মিডিয়া কিভাবে পারে প্রশ্ন করতে?
ভারতের ছ-সাতটি প্রদেশ জুড়ে গত কয়েক বছর ধরে যে আদিবাসী জনজাতি, পিছড়ে বর্গ, ভূমিহীন কৃষকের সশস্ত্র অভ্যূথথান দানা বেঁধেছে সেটার অবলম্বন যে মতবাদই হোক না কেন, যেটা অস্বীকার করা যাচ্ছে না সেটা হল, ক্ষমতার বৃত্তের একেবারে প্রান্তসীমায় বসবাসকারী মানুষ ক্রমশ জবরদখলী ক্ষমতার বিপরীতে নিজেদের জীবনজীবিকা রক্ষার তাগিদে সংগঠিত হচ্ছেন, তৈরি হচ্ছে রাস্ট্রীয় ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করে নতুন নতুন আঞ্চলিক ক্ষমতার কেন্দ্র। প্রচারমাধ্যমের ক্রমাগত মিথ্যাচারের বিপরিতে গিয়ে অরুন্ধুতীর লেখা (Walking With the Comrade , বা অন্য শিরোনামে Gurdian পত্রিকায় Gandhi, But With Guns) ঠিক এই জরুরী বিষয়টাকেই তুলে আনল। ‘হ্যাঁ, আমরা প্রতিরোধী মতামতকেও অন্তরগত করে নিই। কিন্ত শুধু তা মুলধারায় অষ্টপ্রহর বলে যাওয়া বিকৃত, অর্ধেক বা সুবিধাজনকভাবে দোমড়ান মোচড়ান তথ্য এবং দৃস্টিকোণ যা সকাল সন্ধ্যে লক্ষ্য লক্ষ্য শহর, আধাশহরের জনতাকে আমরা গেলাই তোমার মত তার বিপরিতে গিয়ে নেহাতই একটা ব্যতিক্রমী, চমকপ্রদ প্রডাকশন্ হল, মাওবাদী সন্ত্রাসের একঘেয়ে খবরের বাইরে একটা আলাদা রোমাঞ্চের ব্যবস্থা। আর আমাদের খবরের বিপণনে আ্ররো একটু বৈচিত্র্য এল । যখনই মিডিয়া কোনো প্রতিরোধী মত প্রকাশ করে, মিডিয়ার সমষ্টিগত মনস্তত্ত ঠিক এটাই । ছত্তিসগড়ের মাওবাদী মুক্তাঞ্চলে পুকুর খুঁড়ে মাছ চাষ, জলাশয়-পুকুর-নালায় বৃষ্টির জল জমিয়ে আঞ্চলিক সেচ ব্যবস্থার উদ্যোগ যা আরো ব্যাপক আকার নিলে শেষ পর্যন্ত ঊষর, খরাপ্রবণ বস্তার-দন্ডকারণ্যের আদিবাসীদের দিতে পারে বছরের অর্ধেক সময়ের কৃষিকাজের যোগান, অপুষ্টিজর্জর বস্তারের শিশুর জন্য নিয়মিত সব্জী - গেরিলা আর্মির সশস্ত্র দাপটের খবরের পাশাপাশি অনিয়মিত হলেও আসতে শুরু করেছে মাওবাদী মুক্তাঞ্চলে এই অন্যতর কর্মকাণ্ডের খবর কিন্ত মূলধারার মিডিয়ার কাছে এই ধরনের জনমুখী উন্নয়নের খবর এখনো ব্রাত্যই,ড়জোর কৌতুহলের বাজারব চাহিদা মেটাতে মিডিয়া এই মানুষ-মাটির প্রতি বিশ্বস্ত কর্মকাণ্ডকে আদিবাসীদের অসহায়তার সামনে মাওবাদীদের ভাবমূর্তি তৈরির প্রয়াস হিসেবে দেখাতে চাইছে । অথবা নকশালদের বিপথচালিত রবিনহুড দেখাবার সেই পুরনো গল্পটা একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আবার চালু করার চেষ্টা হচ্ছে, ভাবখানা এমন যে ওরা তো আর অন্ধকার জগতের অর্থলোলুপ ভিলেন নয়, ওরা আমাদেরই ঘরের ছেলেমেয়ে , ওরা যা বলতে চায় বা করতে চায় তা ওরা রাজনৈতিক মূলধারায় এসে বলুক না, আদিবাসীদের বঞ্চনা বা সরকারী-বেসরকারী জবরদখল, এসবকে রাজনৈতিক বিতর্কে তুলে আনার জন্য তো মিডিয়া আছে । পণ্য বিপণনের অবস্থানটাও ঠিক এরকম – একটা বিশেষ উপযোগিতার পণ্যকে প্রথমে স্পেশাল ডিসপ্লে দাও, বিপণন বিগ্যাপনের চাতুর্যে দিনকতক ঐ একটি পণ্যের বিক্রয়ক্ষমতায় বাকি দোকানের ক্রয় বিক্রয় নতুন উচ্চতায় পৌঁছবে, তারপর ধীরে ধীরে প্রাথমিক চমকটা কেটে গেলে ঐ পণ্যটি অন্য পণ্যের সঙ্গে পাশাপাশি জায়গা করে নেবে । ক্ষমতার ভাষ্যের সঙ্গে গোপনে তাল ঠোকা নাগরিক বুদ্ধিবৃত্তিকে কোনো সন্দেহ নেই অরুন্ধুতির সন্দর্ভ সামনে নিয়ে আসছে কিন্তূ ঘুরে ফিরে আসছে মিডিয়ার ব্যক্তিবিশেষের খ্যাতিকে ব্যবহারের প্রশ্ন, বিপণনের চতুর অভিসন্ধি ।
ভিন্ন মত, বিপরীত মতের বিপণন – প্রায়ই যখন মিডিয়ার আসল চেহারা, তার পণ্য শরীর, তার ব্যবসা আর লালসার কর্পোরেট দাঁতনখ শান হারাতে থাকে তাকে নির্ভর করতে হয় এই ক্যাটেগরিটির ওপর । আউটলুকের প্রথম ইস্যুতে ছাপা হয়েছিল কাশ্মীরের ভবিষ্যত নিয়ে কাশ্মীরী জনতা কি ভাবে তার ওপিনিয়ন পোল । কাশ্মীরী জনতার স্বাধীনতার লড়াইকে পাকিস্তানের মদতপুস্ট জঙ্গি কার্য্যকলাপ বলে দেখানো ভারতীয় প্রচারমাধ্যমে সেই প্রথম । এই ওপিনিয়ন পোলের স্পষ্ট রায় – সাতাশি শতাংশ মানুষ কাশ্মীরের স্বাধীনতার পক্ষে, সঙ্গে জনতার ভারতীয় মিলিটারী শাসনের অবসানের দাবি । প্রকাশের পরবর্তী কয়েকদিনে শিবসেনা, আর এস এস মুম্বইয়ে কয়েক লাখ পত্রিকার কপি জ্বালিয়ে দিল, ভাঙচুরের চেষ্টা হল পত্রিকার দফতরে । কাশ্মীর নিয়ে ভারতীয় জনতার বোধে, বিশ্বাসে এই ওপিনিয়ন পোল কতদূর পৌঁছতে পারল ? কাশ্মীরের লড়াইকে পাকিস্তানের আগ্রাসন দেখিয়ে, কখনো ধর্মীয় বিদ্বেষ, কখোনো জাতীয়তা সামনে রেখে আমাদের সরকারী, বেসরকারী প্রচারমাধ্যম, মুম্বইয়ের বারোভাতারী সিনেমা কারখানা কাশ্মীর আর আমাদের মাঝখানে অবিশ্বাসের ব্যবধান বাড়িয়ে চলল । প্রচারের এই প্রগাড় আড়ম্বরে ব্যতিক্রমী দু একটি প্রশ্নচিহ্নে কি এসে যায় ?
যে সব শব্দবন্ধে তার অর্থের বিস্তারে , স্বতসিদ্ধ ধরে নেওয়া ব্যাখ্যায় প্রচার মাধ্যম গ্রামের মানুষ, পিছড়ে বর্গ, আদিবাসী জীবনকে দেখে তার মানটা কে তৈরি করে ? মিডিয়া যখন তথাকথিত কোনো ‘সন্ত্রাসবাদী’র অন্ধকার জগত ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার খবর দেয়, তখন আমরা ব্যাখ্যা চাইতেই পারি ঠিক কেমন এই স্বাভাবিক জীবন ? মহারাস্ট্রের বিদর্ভ, ওড়িশার কালাহান্ডি বা বাংলার বাঁকুড়ার মতো ? ক্ষুতকাতর, আত্মহত্যাপ্রবণ কৃষক, ঘরে ঘরে হাড় জিরজিরে পেট ফুলে ওঠা অপুষ্ট শিশু, পানীয় জলের জন্য কয়েক মাইলের হাঁটা পথ, ওষুধের দোকান বা ডাক্তারের ঠিকানা আরো দূরে, যেখানে মায়েরা অর্ধনগ্ন থাকে, ক্ষুধা, অপুষ্টির থাবায় যেখানে প্রতিনিয়ত ওঁত পেতে থাকে মৃত্যু, মৃত্যুর সামনে বিপর্যয়ের সামনে যেখানে মানুষ শুধু মূক, বধির, অন্ধ হওয়ার চেষ্টা করতে পারে – সত্যিই কি স্বভাবিক এই জীবন না ! আর মিডিয়া যাকে অন্ধকার জগত বলে কেমন সেই আতঙ্কের গহ্বর ? পঁচাত্তরটা সি আর পি এফের লাশের সামনে দাঁড়িয়ে চিদাম্বরম, রামন সিংয়ের মুখে দুশ্চিন্তার জমাট মেঘের মতো ? সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম থেকে ওড়িশা ছত্তিসগড় একের পর এক কর্পোরেট লুটেরা চুক্তি(MOU), পরিকল্পনা জনতার প্রতিরোধের সামনে ভেস্তে গেল- এটাই কি সেই অন্ধকার ?
কর্পোরেট স্বার্থকে জনমতে জায়গা করে দেওয়া আর প্রতিরোধমূলক ভিন্ন জনমতের বিপণন, এই দুইএর বাইরে মিডিয়ার একটা প্রতিরক্ষামূলক ভূমিকা থেকে যাচ্ছে যার নাম সংস্কার, জনমুখী উন্নয়ন, সরকারী সিদ্ধান্তগ্রহ্ণণে জনতার অংশগ্রহণের পক্ষে জোরালো সওয়াল, সরকার বেসরকারের যেকোনো চুক্তি সমঝোতাকে প্রকাশ্যে, মতামত বিনিময়ে বিতর্কে নিয়ে আসার নাগরিক উদ্যোগ । সন্দেহ নেই এই ভূমিকাটিই মিডিয়ার একেকটি ব্র্যান্ডনেমকে জনপ্রিয় করে, কিছুকাল প্রচারের যন্ত্রকলাকে গণমাধ্যম বলে মনে হয় কিন্ত মিডিয়ার আসল আনুগত্যকে চিনতে আরো দেরি হয়, প্রতিরক্ষার সমান্তরাল ব্যবস্থাকে গণমাধ্যমের সদিচ্ছা, দায়িত্ব ইত্যাদি ভোঁতা শব্দে আমরা ভাবতে শুরু করি । ততদিনে মিডিয়া আর এক ইস্যুতে চলে গেছে । খবর নামক একটা জরুরী বুদ্ধিবৃত্তির এবং বিনোদন পণ্যের আসল লক্ষ্য ক্রমাগত এক দিন থেকে আরেক দিনে, এক হপ্তা থেকে আরেক হপ্তায়, বড়জোর এক কি দুই কি তিন মাসের ফেরে রঙ বদলে, ফোকাস বদলে ক্রমাগত কাটতি, সার্কুলেশনটা বাড়িয়ে যাওয়া, বিগ্যাপনদাতার জন্য আরো লোভনীয় হয়ে ওঠা । যে পণ্যের বিষয়বস্তু, তার ভেতরের ক্রিয়াবিক্রিয়া থেকে শুরু করে গ্রাহকের হাত পর্যন্ত সবকিছুর কেন্দ্রেই জনতা (পাঠক এবং দর্শক জনতা, মূলত নাগরিক এবং মফস্বলের আধা-নাগরিক) বাজারের সঙ্গে তার পরিবেশনের সম্পর্ক বাকি পণ্যের তুলনায় অনেক অপ্রতক্ষ্য তো হবেই – অনুপুঙ্খ বিবরণের অছিলায়, নিরপেক্ষতার আবহে তার প্রকৃত দায় আসলে বিপণনের, বাজার দখলের । এক হেডলাইনে ভারতীয় অর্থব্যবস্থার ঊর্দ্ধগামী সূচকের ঊজ্জ্বল ব্যাখ্যা, আর এক খবরে অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর সংখ্যায় ভারতের প্রথম হওয়ার তথ্য, সিঙ্গুরের লড়াই ন্যায্য কিন্ত লালগড়ের আদিবাসীদের বিক্ষোভ সন্ত্রাসবাদী । ‘যে জনতা পাঠক(ক্রেতা), উপরন্ত যারা যত কাছের অথবা প্রভাবশালী পাঠক, আরো নির্দিষ্ট করে বললে যারা যত এই পণ্যব্যবস্থা এবং ক্ষমতার অন্যান্য কেন্দ্রের কাছে আছে, যাদের মতামতকে আমাদের সুখ্যাতি, ব্র্যান্ড ইমেজ পরোয়া করে, খবর এবং তার পরিবেশনের মূল লক্ষ্য এই জনসমষ্টির বিনোদন চাহিদা । যখন আমরা আদিবাসী সমাজের অভাব, বঞ্চনা, বিক্ষোভ নিয়ে খবর করি তার পেছনেও রয়েছে আমাদের নাগরিক ক্রেতার মতামতের প্রতি পরোক্ষ দায় । বিষয়টা খুব স্পর্শকাতর দায়বদ্ধতার, প্রান্তিক, পিছড়ে বর্গ, প্রত্যন্ত দূর্গম অঞ্চলের মানুষ যখন রাষ্ট্র এবং তার কর্পোরেট চালিকাশক্তিকে আঘাত করছে, তখন আমাদের মধ্যস্থতাটা, পশ্চাদপদ জনজাতির ন্যূনতম জীবন জীবিকার অধিকার নিয়ে গলা ফাটানোটা আসলে রাস্ট্রের চালু আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় একটা প্রতিরক্ষামূলক উদারতার পক্ষে ওকালতি করে । প্রশাসনিক ক্ষমতার একবগগা পেশীশক্তি ব্যবহারের পাশাপাশি গণতান্ত্রিক বিক্ষোভ প্রদর্শনের, দরাদরি করার প্রশস্ত রাস্তা, অপারেশন গ্রীন হান্টের পাশাপাশি উন্নয়ন পরিকল্পনার সুফল প্রত্যন্ত মানুষের কাছে পৌছে দেওয়ার স্লোগান । না, আমরা কোনোমতেই অবস্থাটা আয়ত্তের বাইরে যেতে দিতে পারি না । কর্পোরেট মুনাফা নির্দিষ্ট উন্নয়ন, সংস্কারের পদক্ষেপকে জনপ্রিয় করে তুলতে আমরা প্রশাসনিক দূর্নীতিকে টার্গেট করব, একের পর এক দূর্বৃত্তায়ন, দূর্নীতি, সরকারী আমলার কর্তব্যে অবহেলার খবরে ক্রমশ মনে হবে যে উন্নয়নের উজ্জ্বল কর্মকান্ডে জনতার অংশগ্রহণের পথে প্রধান অন্তরায় প্রশাসনিক দূর্নীতি, অতএব চাই প্রশাসনিক সংস্কার, গরিবী হটানোর আরো সরকারী স্কীম, উন্নয়নের স্পেশাল টাস্ক ফোর্স, বলপ্রয়োগের পরিবর্তে জনগণকে অনুকূলে নিয়ে আসার জন্য ঢালাও ইনসেন্টিভ, প্যাকেজ, মধ্যস্থতার ব্যবস্থা’। মিডিয়ার এই ‘ড্যামেজ কন্ট্রোল’ এর দর্শন কোনো পুঁজিবাদী দূরদৃষ্টি নয়, বাজার দখলে মরিয়া মুনাফার স্বয়ংক্রিয়তা । কেউ বলছেন, মিডিয়ার কোনো সার্বভৌম চরিত্র নেই, মিডিয়া প্রতিনিয়ত বহুধারায়, বহুমতে বিচ্ছিন্ন, উদ্দেশ্যহীন । অনেকাংশে ঠিক কিন্ত পুঁজি এবং ক্ষমতার সমষ্টিগত উদ্দেশ্যের বাইরে মিডিয়ার অবস্থানকে কোনোভাবেই কি ব্যাখ্যা করা সম্ভব ? মিডিয়ার বহুমূখীনতায় যারা দিশেহারা সেই অধূনান্তিক প্রতিভূরা কি খবর কে পণ্য বলতে রাজী নন, অথবা সার্কুলেশন, কাটতি, বিগ্যাপন, চ্যানেল জনপ্রিয়তার সূচক, পুরস্কার, প্রতিযোগিতার গ্ল্যামার দুনিয়াকে পণ্যের বিপণন ? এখনও দেশের যে বিরাট জনসমাজ প্রাক পণ্যব্যবস্থায় পড়ে আছে, এখনও যাদের কাছে টুথব্রাশ, খবরের কাগজ থেকে শুরু করে তেলমশালা পর্যন্ত প্রত্যেকটি নাগরিক নিত্য ব্যবহারের পণ্য শুধুই বিলাসদ্রব্য, ব্যয়বহুল নিত্য ব্যবহারের নাগরিক সামগ্রী তারা মিডিয়া এবং নাগরিক পণ্য ব্যবস্থায় কোন চাহিদা তৈরি করতে পারে ?
২) পুঁজি এবং শ্রমের পালটে যাওয়া ফোকাসঃ উপনিবেশের নয়া রীতি
বিশ্বায়নের যুগে এসে পুঁজির মৌলিক চরিত্র, ক্রমাগত শ্রমশক্তিকে মুনাফায় রূপান্তরিত করার মূল বৈশিষ্ট্যগুলো একই আছে কিন্ত আমূল বদলে গেছে পুঁজির পরিচিতি, তার রূপের প্রশ্নটি, তার আগ্রাসনের বাজারী কুশলতা । পুঁজি এখন বহুজাতিক, যার নিয়ন্ত্রণক্ষমতা এখনও রয়ে গেছে পশ্চিমের আর্থিক শক্তিধর দেশেদের হাতে । সাম্প্রতিক দশ পনেরো বছরে ভারত, ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়া, সাউথ কোরিয়া, সাউথ আফ্রিকা প্রভৃতি দেশে যে উতপাদন শিল্পের বাড়বাড়ন্ত তাকে অনেকেই বিশ্বপুঁজির ক্রমপ্রসারণ, প্রথম বিশ্ব থেকে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বিশ্বে পুঁজির ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ বলে দেখাতে চাইছেন । ভাবখানা এমন যে বাজার দখলে এসে বহুজাতিক পুঁজি সস্তা শ্রম এবং উতপাদন ব্যয় কমানোর সমস্ত সুবিধার জন্য বাধ্য হচ্ছে তার উতপাদন ব্যবস্থাটাই তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নিয়ে আসতে, আর এর সুফল হিসেবে আমাদের কর্মসংস্থান বাড়ছে, দেশীয় উতপাদকের জন্য সরবরাহের নতুন নতুন সুযোগ তৈরি হচ্ছে, সর্বোপরি দেশীয় শিল্পদ্দ্যোগীরাও তাদের বাজার প্রসারণে বহুজাতিকের সঙ্গে জোঁট বাঁধতে পারছেন, উন্নত কারীগরী ব্যবহারের সুযোগ খুলে যাচ্ছে, তৈরি হচ্ছে ভারতীয় বা ইন্দোনেশিয়ান বহুজাতিক । কেমন এই ভারতীয় বহুজাতিক ? দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মূল কারখানাটি টয়োটা ভারতে করলে তাতে আমাদের কতটুকু লাভ ? পশ্চিমের তাবড় তাবড় পোশাক কোম্পানীর পৃথিবীব্যাপী উতপাদনের চল্লিশ বা পঞ্চাশ শতাংশ আমাদের চেন্নাই বা আমেদাবাদে হলে কতলোকের কর্মসংস্থান হবে আর কতলোক প্রত্যক্ষ্য বা পরোক্ষ ভাবে কাজ হারাবেন, আর কেমনই বা হবে এই সস্তাশ্রমের কর্মসংস্থান ? এই সমস্ত এবং আরো অনেক প্রশ্ন আজ নতুন করে তোলা জরুরী, বিশ্বায়নের মল সংস্কৃতি, হাইটেক জীবনধারায় প্রলুব্ধ স্বচ্ছল নাগরিক মধ্যবিত্তের দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, বিশ্বপুঁজির এই নতুন ধারার উপনিবেশে যারা কাজ, রুটি-রুজি, প্রজন্মলালিত ভিটে-মাটি-পরিবেশ হারাল তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে অথবা যারা কয়েক প্রজন্ম ধরে কণ্ট্রাক্টর-বিডিও-পঞ্চায়েত প্রধান-মুখিয়ার চতুর্মুখী জাঁতাকলে পিষে যাদের নতুন করে হারাবার বলতে শুধু মাথা গোঁজার চালা, ভাগচাষ বর্গাচাষের স্বত্ত বা বছরে শুধু তিন কি চার মাস পেট চালাবার মতো দুচার বিঘা জমি তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে ।
বাজার যেখানে সেখানেই উতপাদন উপরন্ত যতটা বেশী সম্ভব আধুনিক এবং সাম্প্রতিক যন্ত্রকুশলতা, কারিগরী এবং যতটা কম সম্ভব শ্রমশক্তি । শ্রমসংখ্যায় যতটা কম অনুপাতে সম্ভব দক্ষ, আধূনিক যন্ত্রকুশল শ্রমিক এবং যতটা সম্ভব বেশী অনুপাতে কোম্পানীর মূল উতপাদনের(ব্র্যান্ডনেমের) বাইরে আনুষাঙ্গিক বা সরবরাহ বা ঠিকেদারী কাজে সস্তা, অদক্ষ, গায়ে গতরে খাটা আধা সংগঠিত বা অসংগঠিত শ্রমিক । শহরের মধ্যবিত্ত ঘর থেকে অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে আসা যে ছেলেটি টয়োটার প্রডাকশান লাইনে কাজ করে সেই আত্মগর্বী পেশাদার নিজেকে শ্রমিক নয়, টেকনোক্র্যাট বলতেই পছন্দ করেন । আসলে ইনি প্রথম বিশ্বের শ্রমিক, পার্থক্য শুধু এই, গড়পড়তা আমেরিকান শ্রমিকের জীবনে যে আর্থিক হতাশা আছে আমাদের তৃতীয় বিশ্বে বহুজাতিকের প্রডাকশান লাইনের নব্য টেকনোক্র্যাটদের সেটুকুও নেই, উন্নত দেশের সম্পূর্ণ বিপরীতে এদের গড় আয় দেশের চাকরিজীবী জনতার গড় আয়ের তুলনায় অনেক বেশী । কোনো সন্দেহ নেই সিঙ্গুরে টাটার কারখানার জমি অধিগ্রহণের জন্য এরা সল্টলেকের সফটওয়্যার পার্কে দাঁড়িয়ে মিডিয়াকে বলবেন কেন কর্মসংস্থানের জন্য শিল্পায়ন এবং তার জন্য কৃষকের জমি অধিগ্রহণ জরুরী । পালটা যুক্তি, পালটা প্রশ্নগুলো কিছুদিনের জন্য আলোচনা, কথোপকথনে উঠে হারিয়ে যাবে, যেমন পাট, চা, কাগজ এইসব শিল্পগুলো সরকারের কাছে গুরুত্ব হারিয়ে ফেলল কেন, যেখানে প্ল্যাস্টিক বর্জনের যুগে পাট আর কাগজের চাহিদা বিশ্বব্যাপী ঊর্দ্ধমুখী আর ভারতীয় চায়ের গুণগত উতকর্ষের কারণেই এই শিল্পে কখনো চাহিদার সংকট আসেনি । এই শিল্পগুলো চরিত্র জনমুখী, কারণ এইসব শিল্পে প্রচুর সাধারণ মজদুর, চাষীর কর্মসংস্থান হয় (শ্রমনিবিড়) এবং এইসব শিল্পের উতপাদনও আমজনতার নিত্যব্যবহারের আওতায় পড়ে । কিন্ত সরকারের ফোকাসটাই তো অন্য শিল্পে, যে শিল্প হাইটেক, যে শিল্পে কারীগরী বিদ্যায় শিক্ষিত স্বল্পসংখ্যক লোকের কর্মসংস্থান হবে আর তার বিরাট প্রতিষ্ঠানের চাহিদা মেটাতে বহু চাষী তার রুটি-রুজির কৃষিজমি, প্রজন্মের ভিটেমাটি হারিয়ে সামাজিক উদবাস্ত হবেন, উপরন্ত বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই এই হাইটেক শিল্পের উতপাদিত পণ্য উচ্চবিত্ত, স্বচ্ছল নব্য মধ্যবিত্তের কথা মাথায় রেখে তৈরি করা ভোগ্যপণ্য যার সঙ্গে সত্তর শতাংশ দরিদ্র বা নিম্নআয়ের ভারতীয় জীবনযাপনের কোনো যোগ নেই । আসলে বিশ্বপুঁজির মন্দা রুখতে যে বিপুল অলস অর্থ রিজার্ভ ক্যাশ হয়ে ক্রমশ মুদ্রার সংকট ডেকে আনছে তাইই দিতে পারে বিশ্বপুঁজির মূল্যসংকটে নতুন রক্তসঞ্চালন, তাতে সত্তর শতাংশের কৃষিজীবী ভারতে দারিদ্র্যের মাত্রা আরো একটু বাড়বে কিন্ত অন্যদিকে ক্রমশ দেশের ক্রমবর্দ্ধমান আর্থিক সূচকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়বে নব্য কর্পোরেট মধ্যবিত্তের জীবনযাপনের মান, তার ভোগ্যপণ্য ব্যবহারের মাত্রা, এরাইতো আমাদের আর্থিক উন্নতির নিদর্শন । যে সরকার, সরকারী ব্যবস্থা (দলমত নির্বিশেষে) খোলাখুলি বিশ্বপুঁজির স্বার্থের ওকালতি করে আমভারতীয়ের জীবন-জীবিকার বিনিময়ে, বলা বাহুল্য সেই সরকার, সেই ব্যবস্থার কাছে এই সমস্ত প্রশ্নই অর্থহীন, সরকারী স্তরে আলোচনা, সেমিনার, অংশগ্রহণমূলক সিদ্ধান্তের আওয়াজ এইসব নেহাতই মানবাধিকারের বিগ্যাপন ।
যেকোনো ক্ষমতা তার দীর্ঘকালীন অস্তিত্বের জন্য চিরকালই একটা সুবিধাভোগী মধ্যস্বত্ত্বভোগী শ্রেণীর জন্ম দেয়, সঙ্গে জন্ম নেয় ক্ষমতার সমস্ত অনুষঙ্গ, উপকরণের সঙ্গে সহজ সম্পর্কে আসার জন্য নতুন সংস্কৃতি, বিপণন । নতুন এক্সিকিউটিভ মধ্যবিত্ত, কারীগরী শিক্ষিত, টেকনোক্র্যাট ভারতীয় নাগরিক শ্রেণীই এখন বহুজাতীক পুঁজির সামনের মুখ আর তাকে ঘিরে হাইটেক বিপণন সংস্কৃতি । বড় শহর, মেট্রোপলিটান ছাড়িয়ে দ্রুত ছোট ছোট শহরে গজিয়ে উঠছে ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, শপিং মল, জলাশয় বুঁজিয়ে, কখনো চা বাগানের জমির ওপর, কখনো গোটা একটা জনবসতিকে প্রলোভন বা প্রশাসনিক চাপে উচ্ছেদ করে একের পর এক মাথা তুলছে বহুতল ফ্ল্যাটবাড়ী । যারা বহুজাতিকের বহুমূল্য মধ্যস্বত্ত্ব সরাসরি পেল না তাদের অনেকেই এই বহুতল, মল, বিপণন সংস্কৃতির মধ্যে জায়গা করে নিল । যেকোনো শহরে দালাল, সরবরাহকারী, ঠিকেদার, প্রোমোটার আঞ্চলিক ক্ষমতার কেন্দ্র হিসেবে উঠে এসেছে । অর্থাভাবের থেকেও বেশী নাগরিক জীবনে জায়গা করে নিচ্ছে অনিশ্চয়তা, স্বচ্ছলতাকে ধরে রাখবার জন্য আরো দায়িত্বের চাপ, ব্যস্ততা । ‘এই ব্যবস্থায় এক জায়গায় তুমি সারাটি জীবন কাটিয়ে দেওয়ার কথা ভাবতে পার না, যেকোনো সময় তোমার থেকে আরো দক্ষ, কুশলী কেউ তোমার জায়গা কেড়ে নেবে ফলে তোমাকে আরো ভাল প্যাকেজ, আরো ভাল পারিশ্রমিকের জন্য পাশের লোককে আউটপারফর্ম করে যেতেই হবে’। প্রতিযোগিতার এই কর্পোরেট দর্শন শুধু কাজের সাফল্য, পারফর্মেন্সের কথা বলে না, কোম্পানীর বাজার দখলের লক্ষ্য(Vision), আর সেই লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছনোর জন্য প্রয়োজনীয় শৃঙ্খলা, ব্যবসায়িক মূল্যবোধ, লেনদেনের স্বচ্ছতা, কর্মীদের পারস্পরিক সম্মান(Values), এই প্রতিটির ওপর গুরুত্ব দেয়, কারণ মুনাফাসাম্রাজ্যের চালনা, বিস্তার, বৈধতার জন্য, ব্র্যান্ডনেমকে সামাজিক সম্মানে প্রতিষ্ঠা দিতে কোম্পানীকে কর্মীর পরিবার ভাবতে শেখানো হয় । এই কর্পোরেট কর্মসংস্কৃতি যে সমাজবিস্মৃত , একক, স্বার্থপর নাগরিকের জন্ম দেয়, বলা বাহুল্য, আদিবাসী, পিছড়ে বর্গ, কৃষিজীবী মানুষের জীবন-জীবীকা সম্পর্কে তার উদাসীনই থাকার কথা । এদের কাছে প্রত্যেকটি মানুষ স্বতন্ত্র দ্বীপের মতো যে তার পজিটিভ মনোভাবের জোরে যেকোনো আর্থ-সামাজিক উচ্চতায় পৌঁছতে পারে । এই কর্পোরেট নাগরিক বাকি দায়িত্ব ছেড়ে দেয় ক্লিশে হয়ে যাওয়া দুটি শব্দে, তাদের যোগাযোগের ঈঙ্গিতে – ‘কোরাপসান’ আর ‘পলিটিশিয়ান’ । খুব স্বাভাবিক, এদেরকে কর্পোরেট স্বচ্ছতা শেখানো হয় যে !
আর যারা হাইটেক শিল্পের অজস্র ছোট বড় যোগানদারী কারখানায় পড়ে রইল, ওভারটাইমের নামে যারা আসলে পরের দিন কাজে আসাটুকু নিশ্চিত করে অথবা যারা নিতান্তই অসংগঠিত, সরকার-বেসরকারে ঠিকেদারের প্রভাব প্রতিপত্তি যাদের কাজ পাওয়া না পাওয়ার একমাত্র নির্ণায়ক, যাদের জীবন-রুটি-রুজি-শ্রম ঠিকেদার নামক এক ক্ষুদ্র ক্ষমতার মর্জির ওপর নির্ভর করে, এই নতুন বহুজাতীক, বহুস্তরীয় শ্রমব্যবস্থ্যায় এদের অবস্থাটাই সবচেয়ে ভাসমান, সংকটাপ্নন । কেননা যেকোনো ব্র্যান্ডেড পণ্যের প্রোডাকসান লাইনে সামান্য অদল বদল হলে, বিপণন কর্তারা এক ক্যাটেগরির পণ্য থেকে অন্য ক্যাটেগরিতে ফোকাস বদলালে যোগানদারী শিল্পের লক্ষ্ লক্ষ শ্রমিকের পরের দিন বা পরের মাসটি অনিশ্চিত হয়ে পড়ে । আর ঘাটতি জর্জর প্রথম বিশ্বের বহুজাতিক অর্থব্যবস্থা সামান্য পা পিছলোলে তৃতীয় বিশ্বের ভাড়া করা প্রোডাকসান লাইনের কোম্পানী এমপ্লয়ীরাই প্রমাদ গোনে আর এই প্রান্তবাসী সরবরাহ শিল্পে তো ব্যয় সংকোচনের জেরে যে কেউ যেকোনোদিনই হয়ে যেতে পারে অতিরিক্ত । এরও পরের স্তরে যে ঠিকেদারী শ্রমিক সে তো সবসময়েই অনিশ্চিত, অনিয়মিত । দল বেধেঁ সকালের ট্রেনে এরা গ্রাম বা শহরতলী থেকে শহরে আসে, অথবা নির্মীয়মাণ বহুতলের অস্থায়ী আস্তানায় ম্যারাপের নীচে রাত্রিবাস, এদের অনেকেই মাস, এমনকি বছর পেরিয়ে ভারতের বিভিন্ন শহরে কাজ করে বেড়ায় । মুর্শিদাবাদের যে বাস্তশ্রমিক বা নির্মাণশ্রমিক মুম্বইয়ের হাইরাইজ বা দিল্লীর ফ্লাইওভার বানায়, তার দেশে হয়ত দু চার বিঘে জমি আছে কিম্বা সে ভাগচাষী কিন্ত তার আসল অভিগ্যতা, আসল গ্যান পূর্বপুরুষের হাত ধরে পাওয়া চাষবাসের, আর এই নতুন পেশার বিদ্যে, বাস্তশ্রমিক হয়ে ওঠার কুশলতার অবশিষ্ট দায়টুকু গ্রামীণ ভারতের রুগ্ন, অনাহার আখ্যায়িত কৃষির । শিল্পায়নের জন্য আজ যখনই কৃষিজমি অধিগ্রহণ জরুরী হয়ে পড়ছে, অবধারিত জীবন-জীবিকার উচ্ছেদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের ক্ষোভ সরকারী-বেসরকারী পরিকল্পনার সামনে তৈরি করছে চ্যালেঞ্জ, তখনই সরকারী উদ্যোগে, বাণিজ্যিক মিডিয়ার সহায়তায় একটা নতুন সংকটের গল্প চাউর করার চেষ্টা হচ্ছে, মিডিয়া থেকে নাগরিক মতামতে ক্রমাগত বলা হচ্ছে যে গ্রামের শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা আজ আর চাষবাসের কাজে আগ্রহী নয়, শহুরে নাগরিক প্রশ্ন তুলছেন পড়াশোনা শিখে গ্রামের শিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা কি চাষ-আবাদ করবে ? ঘুরিয়ে প্রশ্নটা কেউ সরকারকে করছেন না, গ্রামের নব্যশিক্ষিত মানুষের কাছে চাষবাস আজ আর গ্রহণযোগ্যে জীবিকা নয় কেন, তথাকথিত ডিগ্রীশিক্ষা, কারিগরী বিদ্যার সঙ্গে কৃষিগ্যান, চাষাবাদের কুশলতার বিরোধটা কোথায়, কেন একটি সম্মানীয় জীবিকা হিসেবে কৃষিকাজ চাষীকে তার ন্যূনতম ভরণ-পোষণ, আর্থিক নিরাপত্তা, সচ্ছলতার গ্যারান্টী দিতে পারে না ? ক্ষমতার কেন্দ্রের কাছে, তার প্রচার যন্ত্রের চারপাশে যে পণ্যবাস্তবতা সেইই জন্ম দিচ্ছে এই হীনমন্যতার, সামাজিক মতামতে হেয় করতে শেখাচ্ছে কৃষিকাজকে, মাটি-মানুষের আদিম সম্পর্ককে । আজ শহরের প্রান্তসীমায় বসবাসকারী মানুষদের অধিকাংশের জীবন জুড়েই উদবাস্তর আখ্যান, উচ্ছেদের স্মৃতি, কেউ শেকড়-বাকড়ের টানে সপ্তাহান্তে বা মাস পেরোলে বা বছর ঘুরে সেই ভেতরে শুনশান স্তব্ধ হয়ে পড়ে থাকা দেশ দেখতে যায় কেউ আর যায় না, ক্রমশ উপচে পড়া জীবন জীবীকার রোজকার হিসেবের ভেতর হারিয়ে যায় ।
টাটা, রিলায়েন্স বা এয়ারটেলকে বহুজাতীক বলতে পেরে অনেক নাগরিকই শ্লাঘা বোধ করেন, সঙ্গে মিডিয়ার কল্যাণে মুখে মুখে মুখে ফেরে কোনো বিদেশী কোম্পানীকে টাটার অধিগ্রহণের খবর, বিশ্বের ধনীদের তালিকায় আম্বানীর বিশেষ উচ্চতালাভ বা ভারতের বাইরে বিভিন্ন দেশে এয়ারটেলের পরিষেবার সফল বিগ্যাপন । ‘উজ্জ্বল ভারতে’র নাগরিকদের পক্ষে এটাই স্বাভাবিক কিন্ত যেটা লক্ষ্য করবার সেটা হল প্রথম বিশ্বের পুঁজি এবং চাহিদা তৃতীয় বিশ্বে যে সফল দোসর, যে দেশী ব্র্যান্ড ইমেজ তৈরি করতে চেয়েছে তাতে সে অনেকটাই সফল ।
পুঁজির যে জনমুখী বিকাশ, যে স্বতস্ফূর্ত স্ফূরণ ইউরোপ আমেরিকার অধিকাংশ দেশে হয়েছে তার গোড়ায় ছিল কৃষিব্যবস্থাটারই উতপাদনঘন কৃষিশিল্পে বদল – খামারব্যবস্থা, যেখানে কৃষকেরা শেয়ার হোল্ডার বা যৌথ মালিক, পুরনো কৃষিসরঞ্জাম, আবাদী পশুর ওপর নির্ভরতার বদলে আধূনিক যন্ত্রসরঞ্জাম, সেচব্যবস্থা, বৈদ্যুতিকরণ । বিশ্বায়নের পশ্চিমী হোতারা ভাল করেই জানেন তাদের নিজেদের দেশে সামন্ততান্ত্রিক কৃষির অবলোপনের মধ্য দিয়েই আধুনিক পুঁজিব্যবস্থার বিকাশের শুরু । সামন্তপ্রথা উচ্ছেদের যে সূচনা জমির বন্টনের মধ্য দিয়ে – যদিও তা সমবন্টন নয় – তাইই নিশ্চিত করেছিল জনতার ক্রয়ক্ষমতা, আর্থিক স্বয়ংম্ভরতাকে এবং ফলস্বরূপ ভোগ্যপণ্য, স্বচ্ছল জীবনযাপন সামগ্রীর বিরাট শিল্পায়নকে । প্রথম বিশ্বে পুঁজি স্বয়ংক্রিয় ক্ষমতা হয়ে ওঠার সময়ে পুঁজির বিকাশের, তার নিয়ন্ত্রণের যে মূল ফ্যাক্টরগুলো, রাজনৈতিক অতিকাঠামোয় বদলের কারণে বা উন্নত বিশ্বে পুঁজির সংকটের কারণে তৃতীয় বিশ্বের জঙ্গল নির্ভর পিছড়ে বর্গ, ক্ষুদ্রচাষ, ভাগচাষ নির্ভর জনজাতির দেশে সেই একই জরুরী ফ্যাক্টরগুলো কিভাবে বদলাতে পারে ? বদলায় না, কিন্ত আমাদের জন্য গোপনে লালন করা হয়েছে একই প্রশাসন, একই সরকার, একই মুদ্রাব্যবস্থা, একই আইনব্যবস্থা শাসিত একই ভৌগোলিক মানচিত্রের ভেতরে দুই দেশের ভাবনা। সংকটাপন্ন উন্নত বিশ্বের পুঁজি রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ক্ষমতার অলিন্দে যে মধ্যস্বত্ত্বভোগী শ্রেণীকে পালন করে এসেছে তারাই তো নেহরু, মনমোহন, আম্বানী, টাটা, মিত্তাল। এদেরকে ঘিরেই তো ‘উজ্জ্বল ভারতে’র প্রলুব্ধ নাগরিক।
এই উজ্জ্বল ভারতের লালসা সাম্রাজ্যের কর্তারা অন্য ভারতের কৃষক, আদিবাসী, জনজাতির সঙ্গে ঔপনিবেশিক আচরণ করবেন, এটাই তো স্বাভাবিক। যেমন স্বাভাবিক ‘উন্নয়ন’ নামক ‘উজ্জ্বল ভারতে’র সরকারী, কর্পোরেট আগ্রাসনকে মানুষ নিজের জীবন দিয়ে প্রতিরোধ করবে ।
৩)বর্তমান চীনঃ বিপ্লবের নতুন উপযোগিতা
প্যারিস কমিউন থেকে রাশিয়া, পূর্ব ইউরোপ, ভিয়েতনাম, কিউবা – সর্বহারা শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কতন্ত্র, সমাজতন্ত্রের যে স্বপ্ন, যুক্তি এবং অভিগ্যতা যে চরম ক্ষমতাবান একপার্টি, একমত, এক ইচ্ছামূলক প্রশাসনিক কেন্দ্রীকতার কথা বলে, যেখানে ক্ষমতার একস্বরকে প্রতিনিয়ত জনতার বহুস্বর বা সমস্বর বলে চালানো হয় তার সঙ্গে আজকের চীনের অনেক মিল এবং অমিল । কমিউনিষ্ট একপার্টি শাসনের সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলো বাদ দিলে চীনের বিপ্লব এবং বিপ্লোবত্তর সমাজ আমাদের জন্য একটা তাতপর্য রেখে যাচ্ছে, তা হল, প্রথম বিশ্বের আগ্রাসী পুঁজির ক্ষমতাকে রুখতে তৃতীয় বিশ্বে জনমুখী জাতীয় পুঁজির চূড়ান্ত বিকাশ যা পশ্চিমের ক্ষমতার কাঠামোর সঙ্গে পৃথিবীর অন্যপ্রান্তের প্রথম একটা প্রতিযোগিতামূলক ভারসাম্য তৈরি করতে পারল ।
বিপ্লোবত্তর চীনের সবচেয়ে বড় অবদান যার ওপরে আজকের বিত্তবান চীনের গোটা বর্তমান এবং ভবিষ্যতটা দাঁড়িয়ে আছে তা হল সামন্তপ্রথা, সামন্ততান্ত্রিক ভূমিব্যবস্থার সমূল উচ্ছেদ । ভূমিহীন চাষী, বর্গাদার, ভাগচাষী, সামন্ততান্ত্রিক শ্রমের সঙ্গে যুক্ত এই সামাজিক শ্রেণীগুলোই গোটা চীনে অত্যন্ত বিরল । কিন্ত হ্যাঁ, আর্থিক বৈষম্য, জীবনযাপন মানের বৈষম্য, সামাজিক ক্ষমতার বৈষম্য এই প্রত্যেকটিই আছে এবং প্রবল ভাবেই আছে । কিন্ত যা নেই তা হল কর্পোরেট হাউসের কাছে, মুনাফার দেশী বিদেশী লুটেরাদের কাছে সমস্ত অর্থনৈতিক, সামাজিক, প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের ঘৃণ্য আত্মসমর্পণ । শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, খাদ্য নিরাপত্তায় আজকের চীন এমনকি ইউরোপের অনেক দেশের খুব কাছাকাছি । বিপ্লবের পরে পরেই গ্রামীণ চীনে ভূমি মালিকানার সমূল বদল যার ফলে প্রত্যেক চাষীর কাছে পৌঁছল অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার রসদ, বাধ্যতামূলক এবং ন্যূনতম ব্যয়ভারহীন প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থা এবং উচ্চশিক্ষায় বিরাট সরকারী ভর্তূকী, উতসাহের নানারকম ব্যবস্থা, আর তিন স্তরের সরকারী চিকিতসাব্যবস্থা যেখানে একমাত্র নির্বাচিত কিছু বড় রোগ বা জীবন সংকটেই রোগীকে ন্যূনতম তিরিশ শতাংশ ব্যয়ভার বহন করতে হয় – এই জনমুখী কাঠামোই নিশ্চিত করে যে চীনের অর্থনৈতিক উন্নতির পেছনে আছে বিরাট সংখ্যক সামাজিক পিছিয়ে পড়া শ্রেণী, কৃষক সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণ । পশ্চিমের উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোতে অবস্থাটা এর থেকেও ভাল কিন্ত ট্রেন্ডটা মূলত একইরকম । আর্থিক বৈষম্য বা সামাজিক বৈষম্য থাক কিন্ত রাষ্ট্র অন্তত জনজীবনের মৌল কয়েকটি প্রয়োজনের ভার নিজে নেবে । আর আমাদের দেশ ? হ্যাঁ, যোজনা কমিশন আমাদের হতদরিদ্র্ জনতার সংখ্যাটা লঘু করতে একটা সহজ পদ্ধতি নিয়েছে – সারা বিশ্ব যেখানে রাষ্ট্রস্নংঘ নির্ধারিত ১.২৫ ডলার (ভারতীয় মূদ্রায় ১০০/১১০ টাকার মতো) দৈনিক আয়কে দারিদ্র্যসীমার মাপকাঠি মানে, আমাদের সরকারী পরিমাপ সেখানে গ্রামের ক্ষেত্রে মাসিক ৩৫০ টাকা আয় আর শহরে ৫৫০ টাকা । ফলে রাষ্ট্রসংঘের হিসেবে যেখানে দারিদ্র্যসীমার নীচে বসবাসকারী ভারতীয়ের সংখ্যা জনসংখ্যার ৪১ শতাংশ আমাদের দিল্লীর বাবুদের হিসেব সেখানে ২৫ শতাংশ । সত্যি, দারিদ্র্য দূরীকরণের কি আন্তরিক সরকারী পদ্ধতি ! তবু দারিদ্র্যসীমার এই নতুন ভারতীয় আবিষ্কার একটা ভাবনাকে উস্কে দেয়, খুব মর্মান্তিকভাবেই, - কিভাবে বাঁচে সেই মানুষ যে মাসে তিনশো পঞ্চাশ টাকাও রোজগার করে না ? রাষ্ট্রসংঘের ভাবা উচিত দারিদ্র্যসীমার নীচে হতদারিদ্র্যের আরো চরম কোনো সীমা, মাপকাঠি বেঁধে ফেলা যায় কিনা, অন্তত ভারতবর্ষের জন্য ! উজ্জ্বল ভারতের এত এত বিগ্যাপন করেও, আর্থিক সমৃদ্ধির এত ফলাও প্রচার করেও তবু দু-চারটি তীব্র, মর্মন্তদ, আর্ত পরিসংখ্যান প্রচারের তুমুল ব্যান্ডপার্টি অতিক্রম করে বার বার সামনে এসে পড়ছে, যেমন, শুধু ভারতেই পৃথিবীর অর্ধেক কম ওজনের শিশুর বাস, অপুষ্ট শিশুর সংখ্যায় আমরা পৃথিবীতে প্রথম, এমনকি আফ্রিকার সাহারা অঞ্চলের দেশেদের থেকেও আগে । আসলে চল্লিশ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নীচে বাস করা মানুষ আর বাকী হিসেব মিলিয়ে দিন গুজরান করা তিরিশ শতাংশের যে ভারত, যে ভারতের সন্ত্রাস ছাড়া, উপুর্যপরি মৃত্যু ছাড়া কোনো খবর হয় না, সেই ভারতকে তোয়াক্কা না করেই গড়ে উঠছে একের পর এক সফট্ওয়ার পার্ক, আস্ত একটা শহরের আয়তনের এসইজ়েড, চোখ ধাঁধানো শপিং মল, ল্যান্ডস্কেপ আবাসন, তারাখচিত হোটেল, প্রমোদ নগরী, হাইটেক স্কুল কলেজ, নাগরিক জীবনে ক্রমবর্দ্ধমান মোটরগাড়ীর চাহিদার সঙ্গে তাল রাখতে আট লেনের হাইওয়ে, ফ্লাইওভার, রাস্তায় চলছে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত বাস – বিশ্বায়নের বিগ্যাপনে এই স্বচ্ছল উচ্চাকাঙ্খী ভারতই তো জায়গা করে নিচ্ছে ! হ্যাঁ, বিশ্বায়নের পশ্চিমী বসেরা ঠিক এরকম বিগ্যাপনই চায় । বিশ্বায়নের পুঁজির যে বিপণন, সে চায় আরো গ্ল্যামার, চাকচিক্য, দূর্দান্ত প্রসাধন, ঝলমলে পরিবেশনা, কারণ সম্মোহনটাই এই বিপণনের আসল মনস্তত্ব । একপেটা খেয়ে থাকা পরিবারেও নতুন মোবাইলের চাহিদা তৈরি হবে, অধরা, অগ্যাত রয়ে যাবে পুঁজির বিকাশের ভেতরকার যুক্তি, উন্নতি, সমৃদ্ধির জনসড়ক ।
চিরাচরিত সমাজবিপ্লবের ভাবনায় আজ কি একটা বদল আসতে পারে না, অন্তত তার আশু লক্ষ্যের দিক থেকে ? পুঁজিবাদের সমূল উতপাটনের বদলে, সাম্যবাদ-সমাজতন্ত্রের ভাবনার পরিবর্তে বরঞ্চ পুঁজির ক্ষমতারই আরো সামাজিক বিকেন্দ্রীকরণ, ক্রমপ্রসারণের ভাবনা ভাবা যায় না ? চিরাচরিত সর্বহারা একনায়কতন্ত্রের মার্কসীয় শাস্ত্রবাক্যের বদলে আমাদের বিপ্লব প্রচেষ্টার লক্ষ্য কি হতে পারে না সামন্তপ্রথা, মুখিয়াপ্রথা, খাপ পঞ্চায়েত, বর্ণব্যবস্থা, ঠিকেদারী শাসনের জঙ্গম থেকে বেরিয়ে পুঁজির বিকাশের প্রকৃত গণব্যবস্থার কায়েম ?
যখন বিশ্বায়নের বিগ্যাপন বিপণনে পুঁজিবাদী চীন আর সামন্ততান্ত্রিক ভারতের ভাড়াটে পুঁজি পাশাপাশি জায়গা করে নেয় তখন বিপ্লবের লক্ষ্যও প্রতিবর্ত নিয়মে প্রকৃত পুঁজিবাদী সমাজ হতে পারে। বিশ্বায়নের মিথ্যাচারের সামনে পুঁজির ভেতরকার যুক্তিকে এভাবেই না আমরা প্রকাশ্যে নিয়ে আসতে পারি !
৪)সমাজ, সামাজিক শব্দের ধূসর অঞ্চলঃ অধূনান্তিক সংকট
প্রথম বিশ্বে বিপুল অলস উদ্বৃত্ত মুল্যের সংকট, প্রকান্ড উতপাদন ব্যবস্থার চাহিদার সঙ্গে তাল রাখতে না পারা বাজার সংকট নিশ্চিত করেছিল নতুন বিলম্বিত পুঁজিবাদের, বাজার অর্থনীতির, নয়া উদারনৈতিক অর্থব্যবস্থার । এই নতুন পুঁজিব্যবস্থার মূল মন্ত্র হয়ে উঠল পণ্যকে দেশীয়-মহাদেশীয়- আঞ্চলিক সীমারেখা থেকে বার করে বিশ্ববাজারের চাহিদার উপযোগী করে তোলা, কৃষিনির্ভর তৃতীয় বিশ্বে আধুনিক ভোগ্যপণ্যের চাহিদা তৈরি করা আর তার জন্য নতুন ব্যবহারিক সংস্কৃতি, সামাজিক সম্পর্ক হারানো জীবনবোধের বিপণন । একই সঙ্গে চাহিদা ধরে রাখতে ক্রমশ জরুরী হয়ে পড়ল উতপাদন ব্যয় কমানো, ফলে টয়োটা থেকে সোনি, জেনারেল মোটর্স থেকে জেনারেল ইলেক্ট্রিক, ফিলিপস থেকে ফাইজার সব বড় উতপাদককেই সস্তাশ্রমের জন্য বা বিভিন্ন দেশের আঞ্চলিক বাজারের কাছাকাছি থাকার জন্য বাধ্য হতে হল তাদের বিরাট রপ্তানীনির্ভর উতপাদনব্যবস্থাকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে দিতে । উতপাদনের ভৌগোলিক মানচিত্রের এই বদলে বিশ্ববাজারে পণ্যের বিপণনেও একটা নতুন মাত্রা এল, কেননা যা ছিল বিদেশী, আমদানীকৃত, ভোল পালটে আঞ্চলিক উতপাদনের গুনে তাকেই দেখাতে লাগল দেশী (দেশে তৈরি, দেশের মানুষের হাতে তৈরি, উতকৃষ্ট অথচ সুলভ) । বাজারের প্রসারণ চাহিদার আঞ্চলিক বৈচিত্র্যকে লক্ষ্য করে পণ্যও নিজেকে ক্রমশ ভেঙ্গে চলল, একই আমেরিকান পণ্যের ভারতীয় সংস্করণের মান অনেক খারাপ কিন্ত সস্তা, আবার ইউরোপে তারই ব্যবহারিক গুণাগুণ অনেক বেশী এবং ব্যয়বহুল । দৈত্যাকার শিল্পসাম্রাজ্যের বিরাট যোগানের সঙ্গে চাহিদার তাল রাখতে পণ্য আর তার উতপাদনব্যবস্থা উভয়েই নিজেকে ক্রমশ ভেঙ্গে চলেছে, মানুষের জীবনযাপনের এমন অনেক নিভৃত অঞ্চল, একান্তে অর্জিত ব্যবহারবিধির ভেতর পণ্য পৌঁছতে চাইছে । জীবনপ্রণালীর আলো আঁধারি ঘেঁষে পড়ে থাকা কোনো একটি প্রজন্মলালিত ব্যবহার একবার সেই জনতার সাধারণ আচরণে, উপরিস্তরে উঠে এলেই হল, অমনি শুরু হয়ে যাবে তার ব্যবসায়িক সম্ভাবনার হিসেবনিকেশ, চাহিদার জরিপ । কলকাতার বড়বাজারে ঘুরতে ঘুরতে একবার এক স্টোরহাউসের সামনে এমনই কিছু জিনিস চোখে পড়েছিল, খুবই সাধারণ, আমাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক-ধার্মিক আচরণে ব্যবহার্য অনেক জিনিস, জলে ভাসানো মাটির প্রদীপ, দেওয়ালির মোমবাতি থেকে শুরু করে আলপনা, এমনকি সবুজ তুলসীচারা পর্যন্ত, কিন্ত কারুর শরীরেই মাটির স্পর্শ, মানুষের লালনের চিহ্ন নেই, সব নকল, সিন্থেটিক, রেডিমেড । যত তুচ্ছই হোক না, জীবনযাপনের বৃত্তে যেকোনো সাধারণ, ন্যূনতম ব্যবহারিক প্রয়োজন দেখলেই পণ্য সেখানে ঢুকে পড়বে তার ব্যয়-বিপণন-বাজারের কথোপকথন নিয়ে । ক্রমশ বিশ্লিষ্ট হতে হতে ব্যবহারিক প্রয়োজনের আবিষ্কারে নিজেকে আরো আরো ভেঙ্গে ফেলতে ফেলতে পণ্যের আগ্রাসন এমন চূড়ান্ত রূপ নিচ্ছে যাকে আমরা পারমাণবিক বিক্রিয়া রাসায়নিকের চক্রাবৃত্ত প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে তুলনা করতে পারি । এই আগ্রাসী পণ্যব্যবস্থাকে ক্রমাগত জায়গা করে দিতে, ক্রেতা মনোভাবকে প্রতিনিয়ত প্রভাবিত করতে সমান্তরালে থাকছে বিপণনের মনস্তাত্বিক কারখানা, অভ্রভেদী সংবেদনশীলতা । ক্রেতা মনস্তত্বে দ্রুত জায়গা করে নেওয়ার, তাকে বাজারের অনুকূলে বদলে দেওয়ার এই যে বিরাট আধুনিক কুশলতা বিপণন সেটাই এই নতুন পণ্যব্যবস্থার প্রাণভোমরা । বিপণনে যে টেক্কা দিতে পারল বাজার দখলে বিক্রয়ের শেয়ারে সেইই আগে থাকবে, । এই নব্য পুঁজিব্যবস্থা একই সঙ্গে বিশ্বায়িত এবং আঞ্চলিক (যেমন একটি বিশেষ ব্যাঙ্কের আত্মবিগ্যাপন, “ World’s Local Bank ”), একই সঙ্গে বহুজাতীক এবং বহুধাবিভক্ত, একই সঙ্গে মুনাফার সাংখ্যভাষার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং স্থান, দেশ, বাজার অনুযায়ী আঞ্চলিক লক্ষণে চিহ্নিত । ফলে উত্তরোত্তর ব্যবসায়িক চাহিদার সঙ্গে দূরসংযোগের প্রযুক্তি এবং তার বিবর্তন অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠল । গোটা তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পটাই বিশ্বায়িত রূপ পেল আধুনিক শিল্পসাম্রাজ্যের পরিচালনায় সবচেয়ে জরুরী হয়ে উঠল, সেতো এই বিগত ত্রিশ বছরেই, বহুজাতীক বিশ্বায়নের একেবারে সমান্তরালে । তথ্য প্রযুক্তির গুণে বিপণনের জন্যও খুলে গেল এক মুহূর্তে বিশ্বের যেকোনো ক্রেতার অন্দরমহলে পৌঁছবার অবারিত সড়ক । উতপাদন থেকে বিপণন, দূরসংযোগের বিবর্তন থেকে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি, নব্য পুঁজিব্যবস্থার এই চক্রাবৃত্ত প্রক্রিয়ার শেষবিন্দু হল ক্রেতা । আরো আকর্ষক বিপণন, ক্রেতাচাহিদাকে আরো নিখুঁতভাবে তুলে আনতে, চাহিদা এবং যোগানের সম্পর্ককে আরো দ্রুত এবং মসৃণ করে তুলতে জরুরী হয়ে পড়ল এই হাইটেক প্রযুক্তি, তথ্যশিল্পের সঙ্গে ক্রেতার পরিচয় ঘটানো, তাকে এই নতুন প্রযুক্তি বাস্তবতায় আভ্যস্ত করানো, উপরন্ত জরুরী প্রযুক্তিশিক্ষিত জনতার এক অগ্রসর অংশকে যা একই সঙ্গে হবে এই নব্য পণ্যব্যবস্থার প্রাথমিক ক্রেতা এবং মোটা মাইনের চাকুরে । এই পণ্যসভ্যতা তার সূক্ষ্মতায়, ভেদশক্তিতে, সম্মোহনে, সাবলীলতায় এতই প্রবল যে আধুনিক নাগরিকের জীবনযাপন-মনন, আকাঙ্খা, উচ্চাশা, অনুভূতির অন্তরস্রোত, সম্পর্কের বিন্যাসে ক্রমাগত পণ্যের কথোপকথন, তার বিক্রয়-বিপণনের কুহক জায়গা করে চলেছে এবং বিনিময়মূল্য, অর্থের সংখ্যাভাষা বদলে দিচ্ছে সমস্ত সামাজিক মূল্যবোধ, জীবন বদলে যাচ্ছে জীবিকার রুদ্ধশ্বাস গণিতে । এই পণ্য আর বিপণন নির্ভর নতুন সভ্যতায় যে আপাদমস্তক প্রদর্শনমুখর, আত্মকেন্দ্রিক, বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি মানুষের জন্ম হচ্ছে, জীবন-জীবিতের অন্য সমস্ত বোধ-সত্বাকে ছাপিয়ে যে মানুষের ক্রেতা সত্বাই সবচেয়ে প্রধান সামাজিক পরিচয় হয়ে উঠছে, বলার অপেক্ষা রাখে না সেই মানুষ নিজেকে, তার চারপাশের জীবন-জগত, আগামী সম্ভাবনাকে প্রতিনিয়ত বিচার করে চলবে এই আগ্রাসী পণ্যব্যবস্থার বৃদ্ধি-বিকাশে-মুনাফায়-বিপণনে কার কতটুকু অংশগ্রহণ তার নিরিখেই । শহরের নাগরিক বৃত্তে যেমন বেশ কিছুকাল যাবত প্রতিনিয়ত শোনা যাচ্ছে সরকারী সংস্থাকে বেসরকারীকরণ, বাজারীকরণের পক্ষে সওয়াল, শপিং মল থেকে দ্রুতগতির সড়ক-যোগাযোগ, সুলভ ভোগ্যপণ্য থেকে মোটা মাইনের কর্পোরেট চাকরী এই সবে প্রতিটি শহর আর তার জীবনযাত্রার আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছনোর উচ্চাকাঙ্খা । বহুজাতীক কোম্পানীতে ছেলের আরও বড় দায়িত্ব, সঙ্গে বিরাট পে-প্যাকেজ- বাসে পাশের সীটে মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি তার পরিচিতকে বলতে বলতে আহ্লাদিত, যুবতীর হাতে হাজার হাজার টাকার পোশাকের থলে আর তার থেকেও বেশী আত্মশ্লাঘা উষ্কে দিচ্ছে থলের উপরের সব বিখ্যাত ব্র্যান্ডনেম, এই দৃশ্যগুলো, তৃতীয় বিশ্বের যেকোনো দেশে এই নতুন আত্মগর্বী নাগরিক, তার সদ্য জন্ম নেওয়া ব্র্যান্ড-চেতনা, পণ্য-লালসা, পাশের লোককে পিছনে ফেলে, দরকার পড়লে তার বুকের ওপর পা রেখে এগিয়ে যাওয়ার ঊর্ধটান আজ কত সুলভ, কত নিয়মিত ! আর পৃথিবীর অপর প্রান্তে, গোটা পণ্যসভ্যতার উতস ও বিকাশ যেখানে, সেই আমেরিকা-ইউরোপে যে এই পণ্যব্যবস্থা ক্রমাগত নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে তার মূলেও তো এই ক্রেতা-নাগরিক যে পণ্য আর তার কুহকী বিপণনে ইতিমধ্যে ক্লান্ত, কোনো নতুন ব্যবহারিক সুবিধা, সামাজিক উচ্চতার চিহ্নই আর তার মধ্যে ভোগ্যপণ্যের প্রতি কোনো উতসাহ তৈরি করতে পারছে না, সে এই পণ্যব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করছে ক্লান্ত এবং নিতান্ত অভ্যাসবশত অথবা নেহাতই পরিবর্ত কিছু নেই বলেই । আমেরিকায় অবস্থাটা এখনও ততটা উদ্বেগজনক না হলেও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ক্রমাগত কমে আসছে ভোগ্যপণ্য ব্যবহারের মাত্রা , কর্মক্ষেত্রে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কর্মবিরতি, ছুটি, ভ্রমণ, অবকাশ যাপনের দিন , স্বেচ্ছা আর শীঘ্র অবসরের চাপে কমে আসছে কর্মীসংখ্যা, ব্যয়বহুল হয়ে উঠছে উতপাদন, আর একসময় রোজগেরে নাগরিক তৈরি করতে যে বিচ্ছিন্ন, সুখী, ক্ষুদ্র পরিবারের ভাবনায় সরকার উতসাহ যোগাত আজ তাই হয়ে উঠল গোটা ইউরোপের পণ্যব্যবস্থায় কর্মী সংকটের প্রধান কারণ, কেননা প্রজনন আর মৃত্যুর হার দুইই এত কম যে অচিরেই বয়স্ক নাগরিক, অবসরপ্রাপ্তের সংখ্যা বাকি জনসংখ্যাকে ছাপিয়ে যাবে । পণ্যঅর্থনীতির এই সংকটে যেকোনো নাগরিক পরিষেবা, ন্যূনতম নাগরিক সুযোগ সুবিধার গ্যারান্টী, বিভিন্ন সরকারী ভর্তুকী, কর্মক্ষেত্রে সরকারী নিয়ন্ত্রণ, এককথায় যেসব জনমুখী ব্যবস্থা যেকোনো উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশের বৈশিষ্ট্য, সেগুলোও হয়ে উঠছে ব্যয়বহুল দায়ভার, সরকার নিস্কৃতি চাইছে দায়িত্ব আর ব্যয়ের এই উভয় সংকট থেকে, আর আরো প্রসারণ, আরো বেশী অংশীদারিত্বের জন্য, তার বিরাট বিপণন মঞ্চে সমস্ত নাগরিক সুবিধাকে নির্দিষ্ট মূল্যে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে দিতে এই বাজার আরো বেশী কর্তৃত্ব চাইছে, যা সে অনুন্নত তৃতীয় বিশ্বে বরাবর পেয়ে এসেছে । ফলে তৃতীয় বিশ্বের সচ্ছল নাগরিক যাতে প্রলুব্ধ এবং আহ্লাদিত, সেই বেসরকারীকরণ, বাণিজ্যিকিকরণের বিরুদ্ধে ইউরোপ-আমেরিকায় মানুষ ক্রমশ সোচ্চার হচ্ছেন । ধনকুবের বাণিজ্যিক শ্রেণীর পাশাপাশি ক্রমশ পায়ের তলা থেকে সামাজিক সুবিধার নিশ্চয়তা হারানো প্রথম বিশ্বের সচ্ছল নাগরিক, আগ্রাসী পণ্যসভ্যতার নতুন চাহিদার সামনে ক্রমশ অতিরিক্ত, উচ্ছিষ্ট হতে চলা তৃতীয় বিশ্বের হতদরিদ্র গ্রামীণ জনতা আর এই নতুন বহুজাতীক পণ্যব্যবস্থার একেবারে সামনের সারিতে তৃতীয় বিশ্বের সচ্ছল, উচ্চাকাঙ্খী নাগরিক – এই নতুন ব্যবস্থায় আর্থসামাজিক শ্রেণীগুলো, তাদের ভেতরকার দ্বন্দ্বগুলো আমূল বদলে গেল । শোষণ সম্পর্কের উল্লম্ব উপর-নীচ কাঠামো আর রইল না, বরঞ্চ তা অনেক বেশী আনুভূমিক এবং বিস্তৃত আকার নিল । এই জটিল, বহুস্তরীয়, ক্রমাগত নতুন স্রোতে দিক বদলানো আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় কখনো প্রযুক্তি হয়ে ওঠে নিয়ন্তা তো কখনো আন্তর্জাতিক বাজারে মুদ্রার দামের ওঠানামা, ইউরোপের কোনো দেশে মুদ্রা সংকটের জেরে আমাদের ক্রেতা চাহিদায় ভাটা আসতে পারে, কখনো বিশ্বের একপ্রান্তে রাজনৈতিক ক্ষমতার দ্বন্দ্ব আন্তর্জাতিক জ্বালানীর সংকটে বদলে যাবে, আবার কখনো ধনী রাষ্ট্রজোটের অর্থনৈতিক অবরোধের জেরে বিশ্বের কোনো প্রান্তে রপ্তানীতে আসবে মন্দা, কখনো এক দেশে সস্তা প্রযুক্তি শ্রমিকের বাড়বাড়ন্ত অন্য দেশে তৈরি করবে বেকারী । আর এই নতুন আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় ক্রমশ গুরুত্ব পাচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য, দূষণের মতো আপাত প্রান্তিক বিষয়গুলো। ক্রমশ চরম হয়ে ওঠা জলসংকট, খরা, বন্যা বা জ্বালানী সম্পদের অপ্রতুল হয়ে ওঠা এই বিষয়গুলো আর নিয়মিত প্রাকৃতিক দূর্যোগের মতো উপেক্ষিত থাকছে না , অন্তিম বিপদসংকেতের মতো উন্নয়ন, নগরায়ন, মুক্ত বাজারের আলোচনায় ঘুরে ফিরে আসছে । সঙ্গে এই নতুন পণ্যব্যবস্থা, বিশ্ববাজারের সমান্তরালে উঠে আসছে, সমস্ত আন্তর্জাতিক নিয়ম-কানুনকে ফাঁকি দিয়ে ক্রমাগত শক্তিশালী হয়ে উঠছে অন্ধকার জগতের চোরা বাণিজ্য, মাফিয়া অর্থনীতি । এশিয়া, লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকার অনেক দেশের মূল বাণিজ্যবস্তু হয় মাদক নয়তো বেআইনী অস্ত্র, অথবা পেটেন্ট আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখানো নকল বিলাসপণ্য । অস্বীকার করা যাচ্ছে না, কঙ্গো থেকে কলম্বিয়া বা আফগানিস্তান থেকে বার্মায় এই চোরাগোপ্তা অর্থনীতি অনেকটা গেরিলা যুদ্ধের কায়দাতেই আগ্রাসী বহুজাতীক পণ্যকে ঠেকিয়ে রেখেছে । আর এই সমান্তরাল তথাকথিত কালো অর্থনীতির ওপর দাঁড়িয়েই মাথা তুলছে একের পর এক কট্টর গোষ্ঠী আন্দোলন, জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম, বহুজাতীক বিশ্ববাণিজ্যের কেন্দ্রে আঘাত হানার অভিনব পদ্ধতি । যে দ্বন্দ্বকে একসময় দেখা যেত সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে মানুষের জাতীয়তা, আত্মনির্ভরতার দ্বন্দ্ব বলে আজ দেশে দেশে বিশ্বপুঁজির অংশীদারিত্বের যুগে সেই দ্বন্দ্বের চেহারাটা বদলে গেল । পণ্যের চেহারায় যেমন উত্তরোত্তর ধরা পড়ছে অঞ্চল বিশেষের চাহিদা , তেমনি মানুষের ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের সঙ্গে, তার আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অধিকারবোধের সঙ্গে এই পণ্য-বাজার ব্যবস্থার দ্বন্দ্বটাও হয়ে উঠছে বহুধাবিদীর্ণ, আঞ্চলিক । এই নতুন বাস্তবতায় আর্থ-সামাজিক শ্রেণীগুলির চরিত্র এতটাই পালটে গেছে যে আগেকার তথাকথিত মার্ক্সীয় শ্রেণীসংগ্রাম আজ আর শ্রমিকশ্রেণীকে সেভাবে উদবুদ্ধ করতে পারছে না । ফলে সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের লড়াই, সমাজতান্ত্রিক সমাজের স্বপ্ন নেহাতই আদর্শ রয়ে যাচ্ছে, সমকালীন বাস্তবতায় যা নিজেকে নতুন পরিপ্রেক্ষিতে দেখতে পারছে না । নতুন ধারার পণ্যসমাজে মানুষ যতটা না শ্রেণী ও সমাজের স্বার্থের অংশীদার তার থেকে অনেক বেশী তার আত্মসচেতন ক্রেতাস্বার্থ, বিপণন আর উচ্চাকাঙ্খা সম্বল পেশাস্বার্থ । আবার যারা এই পণ্যবাজারের ক্রেতা হয়ে ওঠা তো দূর এমনকি যাদের ন্যূনতম ভরণ-পোষণের নিত্য লড়াইটা এখনও রয়ে গেছে প্রাক-পুঁজিবাদী সামন্ততান্ত্রিক স্তরে, যারা বিশ্ববাজারের আগ্রাসনের সামনে ক্রমাগত উচ্ছিষ্ট, উদবাস্ত হয়ে চলেছে সেই অনাহার-অর্ধাহার আখ্যায়িত তৃতীয় বিশ্বের গ্রামীণ জনতা, তার অন্ত্যজ, ভূমিজ, গোষ্ঠীবব্ধ জীবনের মূল্যবোধ আজকের সমাজভাবনায় নিয়ে আসছে নতুন পরিপ্রেক্ষিত । আধুনিক মানুষের সম্পূর্ণ বিপরীতে পরিবেশ-প্রাণীজগতের সঙ্গে তার আচরণে পারস্পরিক মমতা, নির্ভরতার সম্পর্কই প্রধান । রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের লড়াই বা বিপ্লবী মতবাদে যে সমানাধিকারের দর্শন, সে কাদের সমানাধিকার, তারও আগে কিসের অধিকার, কে অধিকৃত ? প্রকৃতি-প্রাণীজগতকে আধুনিক সভ্য মানুষ যে ব্যবহারকারীর আস্ফালন, লালসা নিয়ে দেখে , তার সমস্ত আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক দর্শনের ভেতরে যে এই ব্যবহারিক কর্তৃত্বই কাজ করে, এই নতুন পরিপ্রেক্ষিত তাকেই তুলে আনছে । সমান্তরালে পশ্চীমী বিশ্ব যা এই পণ্যসভ্যতার গোটা বিবর্তনটার প্রথম এবং প্রধান অংশীদার, সেখানে আজ মানুষ পণ্যের কুহকী কথোপকথনে ক্লান্ত , তার বিচ্ছিন্ন একক ক্রেতা স্বত্ত্বা, পেশাদারী অস্তিত্ব নিজেকে অতিক্রম করে খুঁজে পেতে চাইছে সহজ পরম্পরার জীবনরীতি , ইতিমধ্যে বিরাট রাজনৈতিক-সামাজিক প্রগতির ধারণায় তার ধ্যানভঙ্গ হয়েছে , তার মনন নিবিষ্ট হয়ে ব্যাখ্যা খুঁজছে একেকটি ব্যক্তি, আঞ্চলিক জনজাতির সামাজিক লক্ষণে , তার নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যে , হয়ে ওঠার ইতিহাসে ।
এই নতুন বহুজাতীক এবং বহুধাবিভক্ত পণ্য, বাজার, বিপণনের যুগে মানুষ, তার সমাজ, সংস্কৃতি, সমাজকে দেখবার এই যে পরিপ্রেক্ষিতের বদল, তথাকথিত রাজনৈতিক মুক্তিসূর্যের স্বপ্নভঙ্গের পরে এই যে শেকড়ে ফেরার প্রয়াস হয়ত তারই সূচনা উত্তরআধুনিকের জীবন ও সমাজের দর্শনে।
কিন্ত এই বহুমত, পথে ক্রমাগত বিশ্লিষ্ট, বহুস্তরীয়, যেকোনো চিহ্নিত চিন্তাব্যবস্থা, অভিধা অতিক্রম করতে চাওয়া এই ধ্যানভঙ্গ মননও কি পণ্যের কথোপকথন থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারছে ? সন্দেহ নেই, উত্তরআধুনিক চিন্তায় মননে নতুন পণ্যব্যবস্থার লক্ষণগুলো স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ছে কিন্ত এই নতুন ধারার সমসাময়িক মননকে যারা শুধু নব্য পুঁজিব্যবস্থার বৈধতার সামাজিক সাংস্কৃতিক কথোপকথন হিসেবে দেখতে চাইছেন তারা দেখতে পেলেন না এই নতুন ধারার সামাজিক মননে ব্যবহারিক মূল্যবোধের সংকট, অভুতপূর্ব সমপর্ক মূল্যের ঈশারা, যেকোনো আর্থ-সামাজিক চিন্তায় প্রকৃতি-পরিপ্বেশ-মানব সমপর্কের অন্তর্ভুক্তি, যেকোনো জনজাতিকে শুধুমাত্র আর্থিক-রাজনৈতিক অতিকাঠামোর নিরিখে দেখবার পরিবর্তে সেই জনজাতির বিশেষ সামাজিক আচরণ, মুল্যবোধ, তার পুরাণ,ধর্মাচরণ, এককথায় তার বিশেষ সামাজিক মনস্তত্ত্বের ব্যখ্যায় ঝোঁকবদল । ছত্তিসগড়ের অনেক আদিবাসী গ্রামেই যেমন গাই-মহিষের দুধ দোয়ানোর রীতি নেই, কারণ ওদের প্রজন্মলালিত বিশ্বাস ‘ও দুধ মানুষ খেলে বাছুর খাবে কি’? প্রকৃতি, পরিবেশ, প্রাণীকুলের অবদমন, তার যথেচ্ছ ব্যবহারের ওপর দাঁড়িয়ে আছে যে পুঁজিবাদী এবং মার্কসীয় উন্নয়ন চিন্তা (অবশ্যই ভিন্ন ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে) তার চ্যালেঞ্জটা প্রথমত আসছে সভ্যতার এই প্রান্তিক মানুষদের কাছ থেকেই । সামাজিক সন্দর্ভে প্রান্তবাসী, তথাকথিত অসভ্য মানুষের জীবনবোধ, পরিবেশ গ্যানের এই অন্তর্ভুক্তিটা ক্রমশ উন্নয়ন, শিল্পায়ন এইসব বিতর্কে আর্থিক বৈষম্যের বাইরে নতুন পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে আসছে । কিন্ত যেখানে উত্তরআধুনিকেরা মার্কসীয় মহাআলেখ্যর যুক্তি খন্ডন করতে গিয়ে আঞ্চলিক ক্ষমতার সন্দর্ভে উত্তর খুঁজছেন, বিশ্বপুঁজির মহাআলেখ্যের বিপরীতে ঘটমান বিভিন্ন আঞ্চলিক প্রতিরোধের সাধারণ যোগসূত্র দেখতে চাইছেন না সেখানেই প্রকাশ হয়ে পড়ছে সমসাময়িক পণ্যব্যবস্থার প্রতি তাদের দূর্বলতা, বিশ্বায়নের মহাআলেখ্যর প্রতি পক্ষপাত ।
পশ্চিমী বিশ্ব থেকে তৃতীয় বিশ্বের নাগরিক বৃত্ত পর্যন্ত যে নব্য মিডিয়া-বাস্তবতা, সমস্ত ঘটমানতা, তার বিবৃতির মধ্যে যে অন্তর্দেশীয় যোগাযোগ, যে হাইটেক দুরসংযোগের অন্তর্জাল তা একদিকে যেমন হয়ে উঠছে বিশ্বপুঁজি, তার পণ্যব্যবস্থার প্রচার-সংযোগ, বিপণন-বিগ্যাপন, জনসম্মতি তৈরির প্রধান মাধ্যম, একইসঙ্গে তার একটা অন্যতর সামাজিক অর্থবহতা তৈরি হচ্ছে, যেখানে কোনো না কোনোভাবে মিডিয়ার হাত ধরে ক্ষমতাবিরুদ্ধ নাগরিক মতামত বিনিময়ের একটা স্বতন্ত্র পরিবেশ তৈরি হচ্ছে অথবা তার সচেতন গ্রাহক জনতার দাবি মেটাতে এবং অবশ্যই আধূনিক সংযোগ প্রযুক্তির গুণে মিডিয়া সংবাদে ক্রমশ জায়গা করে নিচ্ছে পুঁজি এবং তার অনুসারী রাজনৈতিক-প্রশাসনিক-ব্যবসায়িক-সামাজিক ক্ষমতার সঙ্গে জনমতের বিরোধ-সংঘর্ষের খবর । অবশ্যই মিডিয়ার একমুখী ফোকাস, সামাজিক বিষয়কে অন্যান্য ব্যবহারিক পণ্যের মত ব্যবহার, এই প্রশ্নগুলো থাকছেই কিন্ত অস্বীকার করা যচ্ছে না যে ভিন্নমত, বিরুদ্ধ কন্ঠস্বরের জন্য আজকের মিডিয়া বাধ্য হচ্ছে অনেক জায়গা ছাড়তে, ক্ষমতার সঙ্গে জনমতের কথোপকথনের উদ্যোগটা তাকে নিতে হচ্ছেই, কারণটা শুধুই ব্যবসায়িক স্বার্থ হয়ত নয়, বরঞ্চ আর্থ-সামাজিক স্থিতিজাড্যের সঙ্গে সে যেকোনো প্রতিরোধের একটা সমঝোতার রাস্তা করে দিতে চাইছে । ফলে মিডিয়ার এই মধ্যস্থতায় যেকোনোদিন যেকোনো বিরুদ্ধ কন্ঠই পৌঁছে যেতে পারে, জনসম্মতি অর্জনের কর্পোরেট-সরকারী মিডিয়া সংযোগকে সম্পূর্ণ বিপরীত অর্থে এবং অবশ্যই ভিন্ন মাত্রায় যেকেউ পারে ব্যবহার করতে । সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামে কর্পোরেট-সরকারী ক্ষমতার সন্ধি আর তার একরোখা ফ্যাসিস্ত সন্ত্রাসকে আমাদের নাগরিক সমাজ যেভাবে দলমতের ঊর্ধে উঠে প্রশ্ন করল, যেভাবে মিডিয়ার একটা বৃহত অংশকে এই নাগরিক বিক্ষোভের সুরে গলা মেলাতে হল তা অবশ্যই গণআন্দোলনের মিডিয়াক্ষেত্র ব্যবহারের এক নতুন দৃষ্টান্ত । কিন্ত আমাদের বিপ্লব প্রচেষ্টার, জনআন্দোলনের শরিকরা ? তারাও কি মিডিয়াকে এইভাবে দেখছেন বা মিডিয়ার এই নতুন সর্বত্রগামী চরিত্রকে তারাও কি এইভাবে ব্যবহারের কথা ভাবছেন নাকি তারা নেহাতই প্রতিনিয়ত খবরে আসতে চাইছেন আর তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ভার ছেড়ে দিতে চাইছেন মিডিয়ার বিপণনের হাতে ? এই ব্যবহার-কুশলতার প্রশ্নটিই আজকের সমস্ত জনপ্রতিরোধ, গণআন্দোলনের সাম্প্রতিক মাত্রা । নতুন মিডিয়া পরিবেশে কারিগরী-প্রযুক্তি-ব্যবহারবোধ-বিপণনের প্রতিনিয়ত পরিবর্তনের সঙ্গে যেকোনো জনমত কতটা সঙ্গতি রাখতে পারছে, এই নতুন মিডিয়া পরিবেশকে নিজের অনুকুলে ব্যবহারের জন্য সে প্রতিনিয়ত প্রস্তত থাকতে পারছে কিনা তার ওপরই নির্ভর করছে বৃহত জনসম্মতি, ক্ষমতার ভাষ্যকে চ্যালেঞ্জ করার নাগরিক প্রশ্রয় ।
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সঙ্গে যেকোনো গণআন্দোলন-বিক্ষোভ-বিদ্রোহের সংঘর্ষে আজ সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব পাচ্ছে মানবাধিকারের প্রশ্নটি । পৃথিবীর যেসব দেশে ন্যূনতম প্রয়োজনীয় জীবনযাপনসামগ্রীর নিরাপত্তা, চাকরী বা চাকরীর অবর্তমানে বেকারভাতার ব্যবস্থা সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত সেখানে মানবাধিকারের প্রশ্নটিকে মূলত স্বাধীন মতামত প্রকাশ, মুক্ত সামাজিক-রাজনৈতিক আচরণের অধিকার, যেকোনো অপরাধে আত্মপক্ষ সমর্থন, আত্মরক্ষার অধিকার এইসব নিরিখেই ভাবা হয় । মুশকিল হল, আমাদের মত দরিদ্রপ্রধান, পিছড়ে বর্গের দেশেও মানবাধিকারের সংগ্যাটি এই পশ্চিমী, বিত্তবান দেশের মতই রয়ে গেল, আমাদের মানবাধিকার চর্চা নেহাতই মুক্তভাষ্য, মুক্তআচরণের অধিকারের দাবি বা আইনী অধিকারের দাবিতেই সীমাবব্ধ রইল । আমাদের মানবাধিকার কর্মীরা কেন তুলতে পারলেন না খাদ্যনিরাপত্তা, শিক্ষা, চিকিতসা, বাসস্থান বা কাজের গ্যারান্টীর মতো জরুরী অধিকারগুলোর সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবি, সেকি এই জন্য যে আমাদের মানবাধিকার আন্দোলনের প্রথম সারীতে যে সচেতন নাগরিক মুখ, সে মূলত আর্থ-সামাজিকভাবে নিরাপদ শ্রেণীর প্রতিনিধি ? সত্যিই তো, যেখানে কোনো বিপ্লব প্রচেষ্টার স্লোগান নেই, বিক্ষোভ নেই, বিদ্রোহ নেই, পুলিশী সন্ত্রাস বা সিআরপিএফের পেট্রোলিং নেই কিন্ত চূড়ান্ত খাদ্যসংকট, অপুষ্টি, অকালমৃত্যু এর প্রত্যেকটিই আছে এবং প্রবলভাবেই থেকে আসছে সেই ব্রিটিশ ভারতেরও আগের রাজরাজড়ার আমল থেকে, যেখানে মানুষ এখনও খাদ্যসংগ্রহের আদিম জৈব প্রয়োজনটিকেই পেরিয়ে উঠতে পারেনি সেখানে খাদ্যনিরাপত্তাই তো সবচেয়ে প্রাথমিক মানবাধিকার । যেকোনো জনবিক্ষোভ বনাম রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের দ্বৈরথে আমদের মানবাধিকার আন্দোলন যে সদর্থক ভূমিকা রাখছে তার আজ আরো প্রসারণ জরুরী, আপাত শান্ত, নিরুপদ্রব অভাবের সন্ত্রাস যাকে ক্ষমতার প্রাতিষ্ঠানিক সন্দর্ভ গ্রাহ্য করে না তাকে আমাদের মানবাধিকার ভাবনা কি একইভাবে উপেক্ষা করতে পারে ?
অধুনান্তিক সংস্কৃতি ভাবনা যখন বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক রূপের উচ্চনীচ স্তরভেদকে অস্বীকার করতে চাইছে, বৈগ্যানিক সভ্যতার যুক্তিসাম্রাজ্যের বাইরে পড়ে থাকা পৃথিবীর বিভিন্ন আদিবাসী জীবনসংস্কৃতি, তার প্রকৃতি-পরিবার-যৌথ সমাজের বিনিময়মূলক সংহতি (আধুনিক শিল্পসভ্যতার আগ্রাসনের সামনে বহু বিকলাঙ্গতা সত্ত্বেও যা এখনও অনেক বোধ-বিশ্বাস-আচরণের ভিতর টিঁকে আছে) যখন পণ্য এবং বিপণনজর্জর ছিন্নমূল নাগরিক জীবনবোধের বিপরীতে কোনো বিকল্প জীবনরীতির সন্ধানপথ হয়ে উঠছে তখন এই অধুনান্তিক অবস্থান অবশ্যই হয়ে উঠছে যেকোনো আর্থ-সামাজিক বিকাশের ভাবনায় সবচেয়ে জরুরী সংযোজন । কিন্ত পণ্যের সংলাপও যেকোনো প্রান্তিক বোধ-বিশ্বাস-কারিগরী-কুশলতা-জীবনপ্রণালীকে তার বিপণন প্রক্রিয়ার অন্তর্গত করে নিতে ততটাই ততপর । আর পণ্যের সংলাপের ধরণই হল সে সবকিছুকেই তার নিহিত গুরুত্ব, অন্তর্মূল্য থেকে বাজার মূল্যে নামিয়ে নিয়ে আসবে, আজকের বিপণন পরিবেশে সবকিছুকেই সমান্তরালে পরিবেশন করা যেতে পারে, সবকিছুই হতে পারে গ্রাহক আকর্ষণের সামগ্রী, চমকপ্রদ প্রদর্শনের বিষয় । বাজারের নিয়ন্ত্রক ক্ষমতার আওতায় আইপড্ থেকে সমাজভাবনার পত্রিকা, খেলোয়াড়ের স্বাক্ষর করা টিশার্ট থেকে সাঁওতাল তীরধনুক, বাঁকুড়ার মৃতশিল্প, হিমাচলী কাংড়া পট থেকে শুরু করে অর্থনীতিবিদের সেমিনার, ছত্তিসগড়ের জঙ্গলে ভূমিজ মানুষের জীবনশৈলী, যেকোনো কিছুই আসতে পারে, বিপণন আর বাজার মূল্যের ভিন্নতা নিয়েই, কিন্ত কেউ এড়িয়ে যেতে পারে না বাজারের এই সমান্তরাল পরিবেশনকে । অধুনান্তিক ভাবনায় যখন নাগরিক আবাসনরীতি, থিমপার্ক, সেক্স ট্যুরিজম্, ফ্যাশানশিল্প, ইন্টারনেট ক্লাব এইসমস্ত বিনোদন-জীবনযাপন শৈলীর পাশাপাশি, একই গুরুত্বে প্রান্তিক, ভূমিজ মানুষের প্রাকৃত জীবনধারা স্থান পাচ্ছে, তখন আমরা টের পেতে শুরু করি এই গুরুত্বের স্তরভেদ, অন্তর্মূল্যকে খারিজ করার পেছনে বাজারের স্বয়ংক্রিয়তা, সমান্তরাল বিপণনের পণ্যসংলাপ ।
উত্তরআধুনিক সমাজচিন্তায় যখন প্রত্যেকটি আঞ্চলিক সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলন-সংঘর্ষ-প্রতিরোধকে রাজনৈতিক ক্ষমতালিপ্সার অতিকাঠামো বা মতবাদের সমগ্রতায় দেখার পরিবর্তে সেই অঞ্চলের নির্দিষ্ট সামাজিক ইতিহাস, ক্ষমতার সমীকরণ, বিকাশের ভাবনা, সেই অঞ্চলের নিজস্ব সংস্কৃতি, প্রজন্মলালিত বোধ-বিশ্বাসের জগত, এইসব আঞ্চলিক পরিপ্রেক্ষিত থেকে দেখার কথা বলা হচ্ছে তখন এই বিভিন্নতা, বিশিষ্টতাকে মর্যাদা দেওয়ার দর্শন অবশ্যই পুঁজিবাদী উন্নয়ন বা আমাদের দেশে উন্নয়নের নামে ভাড়াটে পুঁজির আগাসনের বিপক্ষে একটা স্পষ্ট সামাজিক অবস্থান নিচ্ছে । ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে, উন্নয়নের সূচকে পিছনে থাকা গ্রামীণ ভারতের বহু জায়গায় কারুশিল্প, প্রাকৃতিক উপকরণে বানানো নানাধরণের হাতের কাজ, চিরায়ত অঙ্কন বা গৃহস্থালীর নানা প্রয়োজনের জিনিস বানানোর কুটীর শিল্প ইত্যাদি অনেক প্রজন্ম ধরে চলে আসছে । সরকারী সদিচ্ছা যদি এইসব সামগ্রীকে আধুনিক বিপণন বা উতপাদন পরিকাঠামোর সুবিধা দিতে পারত (এক্ষেত্রে শিল্পসমবায়ের ভাবনাটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক), তাহলে কি উন্নয়নের ধারণা আরো অংশগ্রহণমুলক হত না ? অথবা ফল-প্রক্রিয়াকরণ শিল্প ফল উতপাদকদের নিজেদের গ্রাম বা তহশীলেই তো হতে পারে, বাগিচামালিকদের যৌথ স্বত্তে, সরকারী উদ্যোগে কারিগরী-যন্ত্রপাতি আর বিপণন সহায়তায় ? উত্তরআধুনিক ভাবনায় এই অঞ্চলবিশেষের নিজস্ব দৃষ্টিকোণ কর্পোরেট-সরকারী উন্নয়নবাণিজ্যের সামনে নিয়ে আসছে নতুন চ্যালেঞ্জ । কিন্ত যাবতীয় আর্থ-সামাজিক সংকটের উত্তর শুধুমাত্র আঞ্চলিক বিভিন্নতার সংলাপে খুঁজতে গিয়ে উত্তরআধুনিক চিন্তা অনেক সময়েই আগ্রাসী বিশ্বায়নের সাধারণ যোগসূত্রকেই আড়াল করে ফেলছে । উত্তরআধুনিক পশ্চিমী চিন্তকদের একটা বড় অংশই এই আঞ্চলিক বিশিষ্টতার মুখোমুখি আগ্রাসী বাজার অর্থনীতি, বিশ্বপুঁজি, বিশ্বায়নের মহাআখ্যান নিয়ে বিস্ময়করভাবে নীরব । বিস্ময়কর, কেননা সমাজচর্চার এত ব্যাপক, বহুধাবিদীর্ণ পথ পেরিয়ে এসে তার মনীষা সমস্ত মহাআখ্যানের কর্তৃত্বকে নাকচ করছে অথচ বিশ্বায়িত পণ্যব্যবস্থার সর্বোময় কর্তৃত্বের প্রতি তার কোনো প্রশ্ন নেই । এটা কি রাশিয়া, পূর্ব ইউরোপের অভিগ্যতার পরে মার্কসীয় হতাশা ? নাকি তৃতীয় বিশ্বের লুটেরা বিনিয়োগ আমার স্বচ্ছলতা নিশ্চিত করে এই স্বার্থবোধের
আনুগত্য ?
নর্মদা বাঁচাও আন্দোলনের মঞ্চ থেকে যখন নদীর জল, বনাঞ্চল ইত্যাদি প্রাকৃতিক সম্পদকে নাগরিক পণ্যসভ্যতার চাহিদা মেটাতে যথেচ্ছ ব্যবহারের পরিবর্তে প্রকৃতি-মানুষ-প্রাণীকুলের ভারসাম্যমূলক জীবনধারার উপর জোর দেওয়া হয়, মেধাজী (মেধা পাটেকর)যখন নগরসভ্যতার লালসাসাম্রাজ্য, তার আগ্রাসী ব্যবহারবোধের বিপরীতে নর্মদা নদীতীরের ভূমিজ, আদিবাসী মানুষের প্রকৃতির সঙ্গে আদিম প্রজন্মলালিত সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেন, তখন আমরা পুঁজিবাদী পণ্যমূল্য বা মার্কসীয় দর্শনের বিশুদ্ধ ব্যবহারমূল্যকে অতিক্রম করে অন্য বিকল্পের সন্ধান পাই । দেরিদা তাঁর ‘স্পেক্টর অফ্ মার্কস’ গ্রন্থে পুঁজিবাদী পণ্যমুল্যের শিকড় খুঁজলেন বস্তর ব্যবহারমূল্যের ভেতর, প্রশ্ন করলেন মার্কসীয় ব্যবহারিক মূল্যবোধের নৈতিকতাকে, পণ্যের শোষণসম্পর্কের উতস হিসেবে উঠে এল বস্তজগতের সঙ্গে মানুষের নিছক ব্যবহারিক প্রয়োজনের সম্পর্ক । দেরিদা কোথাও স্পষ্ট উল্লেখ করলেন না কিন্ত আধুনিক সামাজিক দর্শনের পরিপ্রেক্ষিতে নতুন মূল্যবোধের ইঙ্গিত পাওয়া গেল, পুঁজিবাদী পণ্যমূল্য বা মার্কসীয় ব্যবহারমূল্যের পরিবর্তে মানুষ-প্রকৃতি-বস্তজগতের পরিপূরক সম্পর্কমূল্য । এই সম্পর্কমূল্যের আভাস আমরা অনেককাল আগে সেই ঊনবিংশ শতকে ফরাসী দার্শনিক মিশেলের লেখায় পাই যখন মিশেলে কৃষকের সঙ্গে কৃষিজমির সম্পর্ককে স্বা্মী-স্ত্রীর সম্পর্কের সঙ্গে তুলনা করেন (এই তুলনায় অবশ্যই পিতৃতান্ত্রিক দ্যোতনা আছে কিন্ত মিশেলের তুলনা, এই সম্পর্কের অনপুঙ্খ, মেদুর বিবরণের আসল প্রাণভোমরা কৃষিজমির সঙ্গে কৃষকের পরিপূরক টান, ব্যবহারবোধের অতিরিক্ত রোম্যান্টিকতা)। আর আমাদের প্রাচ্যে, যেকোনো আদিবাসী, ভূমিজ মানুষের জীবনে জল-জমি-জঙ্গল-পশুপালনের একাত্ম সম্পর্কের ইতিহাস অনেক প্রাচীন, সামন্ততান্ত্রিক শোষণসম্পর্কের পাশাপাশি যা বরাবর ভূমিজ জীবনের সমান্তরাল আখ্যান, অথচ আমাদের মার্কসবাদী বিপ্লবী সমাজচিন্তায় কখনো এই আদিম সম্পর্কের ইতিহাস আমল পেলনা । আসলে মার্কসবাদী বিগ্যানচিন্তা, যুক্তিবোধের ভেতরেও সেই পণ্যশিল্পসভ্যতার আগ্রাসী ব্যবহারিক মূল্যবোধ, প্রকৃতি-প্রাণীকুলের উপরে মানুষের সর্বোময় কর্তৃত্বের দর্শন । উদবৃত্ত মূল্য বা বাজারব্যবস্থার অবলুপ্তি, আর্থ-সামাজিক সমানাধিকার এই জরুরী সন্দর্ভগুলোর বাইরে সোভিয়েত রাশিয়া থেকে চীন মার্কসীয় সমাজবীক্ষা উতপাদনের পেশীশক্তি, তার সুষম ব্যবহারের প্রায়োগিক ধারণার মধ্যেই সীমায়িত রইল । এই পরিপ্রেক্ষিতে অরুন্ধতী রায়ের সন্দিহান অবস্থান অত্যন্ত সদর্থক যখন তিনি প্রশ্ন তোলেন প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহারে বিপ্লবী অবস্থান নিয়ে “ওদের খনিজসম্পদ ব্যবহারের নীতি কি (বর্তমান)সরকারী নীতি থেকে খুব আলাদা হবে ? ওরা কি (পাহাড়ের)বক্সাইটকে পাহাড়েই ছেড়ে দেবে ?” যেকোনো সমাজবিপ্লবের দর্শন যতক্ষণ ব্যবহারিক মূল্যবোধকে অতিক্রম করে প্রকৃতি-জীবনের পরিপূরক সহাবস্থানের মূল্যবোধ অন্তর্গত করে নিতে না পারছে ততক্ষণ এই সন্দেহটা থাকছেই ।
সমস্ত সন্দেহ, প্রশ্নচিহ্ন, অভাববোধের পরেও যা আমাদের নাগরিক মননকে প্রতিনিয়ত জেরবার করছে তা আমাদের দায়বদ্ধতার প্রশ্ন, যেকোনো বিরুদ্ধ মতামতকে সন্ত্রাসবাদী চিহ্নিত করা দমনমূলক রাজনৈতিক-প্রশাসনিক ব্যবস্থার বিপরীতে আমাদের অবস্থানের প্রশ্ন, ভূমিজ, আদিবাসী জনজাতির উপর বিশ্বায়ন এবং তার দেশীয় প্রতিনিধিদের ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের সামনে আমাদের সুবিধাভোগী নাগরিক অস্তিত্ত্ব কোন পক্ষ নেবে সেই প্রশ্ন । কোনো সন্দেহ নেই ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে আজকের আদিবাসী গণবিক্ষোভ একটি বিশেষ বিপ্লবী রাজনৈতিক মতাদর্শের দ্বারা প্রভাবিত আর যারা সেই আর্য রাজতন্ত্র থেকে ব্রিটিশ শাসন হয়ে আজ পর্যন্ত কখনো অস্পৃশ্য, কখনো ভূস্বামীর ক্রীতদাস বা স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে বনদফতর-কন্ট্রাক্টর-বড় জমি মালিক-প্রশাসনিক কর্তাদের লুটের সামগ্রী আর সাম্প্রতিক কালে বড় শিল্পোদ্যোগ বা খনির জন্য যাদের মাথার ওপর ঝুলছে ভিটেমাটি ছেড়ে উদবাস্ত হওয়ার সরকারী পরোয়ানা, এই চিরঅবহেলিত মানুষেরা আজ যদি ব্যবস্থাটাকে নিজেদের অনুকূলে বদলাবার স্বপ্ন দেখে, সেটাই তো স্বাভাবিক । যারা কমিউনিষ্ট একপার্টি-একমতের শাসনের বিপদ দেখিয়ে বা হিংসার বিরুদ্ধতায় এই জনআন্দোলনের ভেতরের যুক্তিকে অস্বীকার করছেন তারা ক্ষমতার স্থিতিজাড্যের সঙ্গে একটা সুবিধাজনক রফায় আসতে চাইছেন । আর ঠিক উলটো দিকে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের বিপ্লবী স্বপ্নকে যতটা না তার থেকেও বেশী জরুরী মনে হচ্ছে এই একতরফা, উচ্চবর্গীয় ক্ষমতার স্থিতিজাড্যে আঘাত হানাটা, অনেক জরুরী হয়ে পড়ছে বিশ্বায়ন আর তার দেশী বিদেশী লুটেরা হানাদারদের সবক শেখানোটা।
No comments:
Post a Comment